ঢাকায় উড়ালপথ নির্মাণে মানা হচ্ছে না নির্ধারিত মানদণ্ড

ঢাকায় উড়ালপথ নির্মাণে মানা হচ্ছে না নির্ধারিত মানদণ্ড

উড়ালপথ যখন কোনো সড়ক অবকাঠামো অতিক্রম করবে, তখন নিচের সড়কের উপরিভাগের সঙ্গে উড়ালপথের তলভাগ পর্যন্ত মধ্যবর্তী দূরত্ব (হেডরুম) রাখতে হবে ৫ দশমিক ৭ মিটার। উড়ালপথের নিচ দিয়ে যানবাহন চলাচল নির্বিঘ্ন রাখতে হেডরুমের উচ্চতার এ মানদণ্ড নির্ধারণ করা আছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের ‘জিওমেট্রিক ডিজাইন স্ট্যান্ডার্ডস’-এ। তবে ঢাকায় উড়ালপথ নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটছে এ মানদণ্ডের। নির্মাণাধীন ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একাধিক স্থানে সড়ক অবকাঠামোর ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় হেডরুমের উচ্চতা রাখা হয়েছে ৫ দশমিক ৭ মিটারের কম।

শুধু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েই নয়; মেট্রোরেল, নির্মিত একাধিক ফ্লাইওভার, ওভারপাস ও ফুটওভারব্রিজের ক্ষেত্রেও হেডরুমের উচ্চতা রাখা হয়েছে সওজ অধিদপ্তরের নির্ধারিত মানদণ্ডের চেয়ে কম। হেডরুমের উচ্চতা কম হওয়ায় এসব অবকাঠামো দিয়ে যানবাহন, বিশেষ করে পণ্যবোঝাই যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটার পাশাপাশি দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকার বিমানবন্দর থেকে চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত তৈরি করা হচ্ছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। উড়ালপথটির বিমানবন্দর-তেজগাঁও অংশের অনেকটাই এখন দৃশ্যমান। এ অংশে এক্সপ্রেসওয়ের গতিপথে রয়েছে কুড়িল ফ্লাইওভার, বনানী ওভারপাস, মহাখালী ফ্লাইওভার ও বিজয় সরণি ওভারপাস। এসব অবকাঠামো অতিক্রমের সময় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের হেডরুমের উচ্চতা রাখা হচ্ছে ৫ দশমিক ৫ মিটার।

ফার্মগেট আর কারওয়ান বাজারে নির্মাণাধীন মেট্রোরেলের উড়ালপথের নিচ দিয়ে নেয়া হবে একই এক্সপ্রেসওয়ের দুটি র্যাম্প। ফার্মগেটের র্যাম্পটির কাজ এরই মধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে। নকশা অনুযায়ী দুই জায়গাতেই নিচের সড়ক থেকে এক্সপ্রেসওয়ে এবং এক্সপ্রেসওয়ে থেকে মেট্রোরেলের উড়ালপথের মধ্যবর্তী দূরত্ব বা হেডরুম রাখা হবে ৫ মিটার, যা সওজ অধিদপ্তরের নির্ধারিত মানের চেয়ে দশমিক ৭ মিটার কম।

হেডরুমের উচ্চতা নিয়ে একই ধরনের জটিলতা দেখা দেয় পদ্মা সেতু ও পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পেও। সেতুর দুই পাশের সংযোগে নিচের সড়কপথ আর ওপরের রেলপথের মধ্যকার উচ্চতা প্রথমে রাখা হয়েছিল ৫ দশমিক ৫ মিটার। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের আপত্তির মুখে নকশা সংশোধন করে হেডরুমের উচ্চতা ৫ দশমিক ৭ মিটারে উন্নীত করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়কের নকশা সংশোধন হলেও ঢাকায় হেডরুমের নির্ধারিত মানদণ্ডের ব্যত্যয় ঘটিয়ে তৈরি করা হচ্ছে উড়ালপথ।

হেডরুমের উচ্চতা কম হলে যানবাহন চলাচলে কী ধরনের সমস্যা হতে পারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোয় হেডরুমের উচ্চতা খুব বেশি রাখা হয় না। সেসব দেশে এটা ৫ মিটারের আশপাশে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এখানে অনেক সময় পণ্যবোঝাই একটি ট্রাকের উচ্চতা ৫ দশমিক ৭ মিটারের কাছাকাছি চলে যায়। স্বভাবতই পণ্যবোঝাই ট্রাক উড়ালপথের হেডরুমে এসে আটকে যাবে। অন্যদিকে বাংলাদেশে যেসব উড়ালপথ তৈরি করা হয়েছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেগুলোর হেডরুমের নিচের সড়ক বিটুমিনের। এখানকার প্র্যাকটিস অনুযায়ী বছর বছর পিচ ঢালাই করা হয়। এ পিচ ঢালাই করা হয় আগের পিচের ওপরে। ফলে নিচের সড়কটি ক্রমেই পুরু হয়ে ওপরে চলে আসতে থাকে। এতে হেডরুমের উচ্চতা কমে যায়, যা তুলনামূলক উঁচু যানবাহন চলাচলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। এমন প্রেক্ষাপটে সড়ক অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে হেডরুমের উচ্চতা নিয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা এবং নিখুঁত নকশা প্রণয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

সড়কের ওপর উড়ালপথ নির্মাণের ক্ষেত্রে সওজ অধিদপ্তরের ‘জিওমেট্রিক ডিজাইন স্ট্যান্ডার্ডস’-এ বলা আছে, বাংলাদেশে যেসব ট্রাক চলাচল করে, সেগুলোর গড় উচ্চতা ৪ মিটারের আশপাশে। তবে পণ্যবাহী যানবাহনগুলো যখন অস্বাভাবিক ভার বহন করে, তখন উচ্চতা এর চেয়ে বেশি হয়ে যায়। এমন প্রেক্ষাপটে সড়কের ওপর উড়ালপথ নির্মাণের ক্ষেত্রে মধ্যবর্তী উচ্চতা রাখতে হবে ৫ দশমিক ৭ মিটার। পিচ ঢালাইয়ের কারণে নিচের সড়ক উঁচু হয়ে যাওয়ার বিষয়টিও হেডরুম নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়ার কথা বলা হয়েছে ‘জিওমেট্রিক ডিজাইন স্ট্যান্ডার্ডস’-এ।

বাংলাদেশে যেসব দ্বিতল বাস চলে, সেগুলোর উচ্চতা ৪ দশমিক ২৭ মিটার। অন্যদিকে টাটা, হিনো, আইসার ও অশোক লেল্যান্ডের আনলোডেড ট্রাকের উচ্চতা ৩ মিটার। আর চলাচলরত আইসার, অশোক লেল্যান্ড ও টাটার কাভার্ড ভ্যানগুলোর উচ্চতা ৩ দশমিক ৯৬ মিটার। বাংলাদেশে যে উচ্চতার দ্বিতল বাস ও পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল করে, তাতে হেডরুমের উচ্চতা সওজ অধিদপ্তরের নির্ধারিত মানদণ্ডের চেয়ে কম হলেও সমস্যা হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা বলছে, লোডেড অবস্থায় কোনো কোনো ট্রাকের উচ্চতা ৫ দশমিক ৮ মিটার পর্যন্ত হয়ে যায়, যা সওজ অধিদপ্তরের হেডরুমের জন্য নির্ধারিত উচ্চতার চেয়েও বেশি।

‘প্রভিশন ফর এডিকুয়েট হেডরুম ফর ফুটওভারব্রিজ অ্যান্ড ফ্লাইওভারস’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়েছে, মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার এবং মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের ওপরে হেডরুমের উচ্চতা রাখা হয়েছে ৭ দশমিক ২ মিটার। কিন্তু নিচের সড়কের সঙ্গে ফ্লাইওভার দুটির হেডরুমের উচ্চতা সওজ অধিদপ্তরের নির্ধারিত মানদণ্ডের চেয়ে কম। অন্যদিকে বলাকা সিনেমা হল, নিউমার্কেট, সায়েন্স ল্যাব ও কলাবাগানের ফুটওভারব্রিজে হেডরুমের উচ্চতা রাখা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ মিটার। আর রমনা ফুটওভারব্রিজে হেডরুমের উচ্চতা ৫ দশমিক ৩ মিটার। হেডরুমের উচ্চতা কম হওয়ায় এসব অবকাঠামোর নিচ দিয়ে পণ্যবোঝাই যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে, ঘটছে দুর্ঘটনাও।

ঢাকার সড়কে হেডরুমের উচ্চতা নিয়ে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি জটিলতা তৈরি করেছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প। এ অবকাঠামোয় হেডরুমের উচ্চতা কেন নির্ধারিত মানে রাখা হয়নি, জানতে একাধিকবার চেষ্টা করেও প্রকল্প পরিচালক এএইচএমএস আক্তার এবং সেতু বিভাগের সচিব মনজুর হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে সেতু বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে হেডরুমের যে উচ্চতা রাখা হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক মানের চেয়েও বেশি। এ উচ্চতার হেডরুমে স্বাভাবিক যানবাহন চলাচলে কোনো ধরনের সমস্যা হবে না।

ওই কর্মকর্তার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, হেডরুমের উচ্চতার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আদর্শ মানদণ্ড হলো ৪ দশমিক ৫ মিটার, সেখানে সওজ অধিদপ্তর ৫ দশমিক ৭ মিটারের যে মানদণ্ড নির্ধারণ করেছে তা অযৌক্তিক। উঁচু অবকাঠামো তৈরি করে খরচ বাড়ানোর কোনো যুক্তি আমি দেখি না। নিয়ন্ত্রণ যদি করতেই হয়, সেটা করতে হবে যানবাহনকে। পৃথিবীর কোনো দেশেই বাংলাদেশের মতো ভার নিয়ে ট্রাক চলে না। অতিরিক্ত পণ্যবোঝাই গাড়ি চলাচলকে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কিন্তু এ কাজটিই আমাদের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো করতে পারছে না এবং এর দায়টা পড়ছে সড়ক অবকাঠামোর ওপর।-বণিক বার্তা