জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হলে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার নয়: যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত

জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হলে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার নয়: যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত

ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেছেন, জবাবদিহির আওতায় না আসা পর্যন্ত র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এবং এর সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে। নিষেধাজ্ঞাগুলো শাস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে নয়, বরং আচরণ পরিবর্তন ও তাদের জবাবদিহির আওতায় আনার জন্য।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর গুলশানে একটি হোটেলে ‘মিট দ্য অ্যাম্বাসেডর’ অনুষ্ঠানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস এসব কথা বলেন। বাংলাদেশি বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) ও জার্মান গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ফ্রেডরিখ এবার্ট স্টিফটাং এ আয়োজন করে।

গত বছরের ১০ ডিসেম্বর গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) এবং বাহিনীর সাবেক ও বর্তমান সাতজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। র‌্যাবের সাবেক ডিজি হিসেবে পুলিশের বিদায়ী আইজিপি বেনজীর আহমেদও নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়েন। আবার র‌্যাবের বিদায়ী ডিজি হিসেবে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের ওপরও একই নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আবদুল্লাহ আল–মামুন নতুন আইজিপির দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন।

তবে নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই সম্প্রতি জাতিসংঘে পুলিশপ্রধানদের সম্মেলনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রে যান বেনজীর আহমেদ। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে ৩১ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর ওই সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের নেতৃত্বে আইজিপি বেনজীর আহমেদসহ ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল অংশ নেয়।

আজ পিটার হাস বলেন, ‘গত বছরের ডিসেম্বরে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। এটা খুব ভালো সংকেত। আমরা আশা করছি, র‍্যাবের আচরণের পরিবর্তন হবে।’

আজকের মিট দ্য অ্যাম্বাসেডরে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে।

এক প্রশ্নের জবাবে পিটার হাস বলেন, নির্বাচন শুধু একটি দিনের ঘটনা নয়। বাংলাদেশে আসন্ন নির্বাচন স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছভাবে হবে কি না, তা নির্ভর করছে বেশ কয়েকটি বিষয়ের ওপরে। কারণ, রাজনৈতিক দলগুলো স্বাধীনভাবে তাদের কর্মসূচি পালন করতে পারছে কি না, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ তাদের মতপ্রকাশের সুযোগ পাচ্ছে কি না, তার ওপর নির্ভর করছে এটি।

যুক্তরাষ্ট্র রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে যে রাজনৈতিক সহিংসতা চলছে, তা একটি সঠিক নির্বাচনের জন্য সহায়ক নয়। নির্বাচনের আগে ও পরের ঘটনাও একটি অবাধ, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের অংশ, তাই বাংলাদেশের বর্তমান সহিংসতার ঘটনা যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও বিশ্ব সম্প্রদায় নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।

পিটার হাস বলেন, ইন্দো প্যাসিফিক কৌশলে (আইপিএস) বাংলাদেশের যোগ দেওয়া না–দেওয়াটা কোনো বিষয় নয়। এটা একটি নীতি। এটা বাংলাদেশ কীভাবে নেয়, সেটাই দেখার বিষয়। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) যোগ দেওয়াটা বাংলাদেশের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশ কোন জোটে যোগ দেবে, সেটা তাদের বিষয়।

এক প্রশ্নের উত্তরে যুক্তরাষ্ট্র রাষ্ট্রদূত পিটার বলেন, আমরা চাই বাংলাদেশে একটি আন্তর্জাতিক মানের নির্বাচন হোক।

ভারতের চোখ দিয়ে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র দেখে কি না- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, না, মোটেই না। আর আমার এখানে কাজ বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক উন্নয়ন করা।

রোহিঙ্গা ফেরতের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছি। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে চাপ দেওয়ারও চেষ্টা করছি। এছাড়া রোহিঙ্গাদের সহায়তা দিচ্ছি। আমাদের নানা উদ্যোগ রয়েছে।

রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে পাঁচটি বিষয়কে প্রাধান্য দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে একটি হচ্ছে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন। এই প্রত্যাবাসন পর্যন্ত তাদের সহায়তা করা। একই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের নিরাপদে ও স্বেচ্ছায় নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের জন্য একটি সমস্যা হচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থী। তারপরও বাংলাদেশ সরকার আন্তরিকভাবে এবং মানবতার সঙ্গে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের পক্ষে।

পিটার হাস আরও বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে পাঁচটি বিষয়কে প্রাধান্য দেয় যুক্তরাষ্ট্র। প্রথমত, শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল বাংলাদেশ; গণতন্ত্র, বহুদলীয় গণতন্ত্র, সহিষ্ণুতা, স্বচ্ছতা, সুশাসন ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা; সামাজিক ও পরিবেশগত প্রতিকূলতা মোকাবিলায় সক্ষমতা; রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও স্বেচ্ছায় নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত তাদের সহায়তা করা- এই চার লক্ষ্য সার্থকভাবে পালন করলে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শ্রমমান উন্নয়নে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করা।

সার্ককে আরও কার্যকর করতে যুক্তরাষ্ট্র ভূমিকা নিতে পারে কি না জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত বলেন, আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়ানো যুক্তরাষ্ট্রের নীতি। এ অঞ্চলের নিরাপত্তা ও উন্নয়নে আঞ্চলিক কানেকটিভিটিকে আমরা প্রাধান্য দিয়ে থাকি।

বাংলাদেশে মানবাধিকার, গুম, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট নিয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এক্ষেত্রে সর্বদা সচেতন এবং এটা নিয়ে তারা বার বার বাংলাদেশে কথা বলেছে। মানবাধিকার তাদের কাছে সবসময় প্রাধান্য পায় বলেও তিনি জানান।

বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ে জিল্লুর রহমানের করা একটি প্রশ্নের উত্তরে রাষ্ট্রদূত বলেন, দুই দেশেরই বাণিজ্যিক সম্পর্কোন্নয়নের সুযোগ রয়েছে। মার্কিন কোম্পানিগুলো এদেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী বলেও তিনি উল্লেখ করেন। স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণ প্রসঙ্গে তিনি বাংলাদেশকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধাসহ (জিএসপি) অন্যান্য বাণিজ্যিক সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, যার মধ্যে শ্রমিক নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত। এটা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা করবে যুক্তরাষ্ট্র।

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো হবে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলারের অস্থিতিশীল অবস্থা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সময়ে প্রত্যেকটি রাষ্ট্রই কঠিন সময়ের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। তবে, প্রত্যেকটি সরকারের স্বতন্ত্র কিছু পন্থা আছে এসব সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য।

সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে দেশের বিশিষ্ট নাগরিক, সাবেক রাষ্ট্রদূত, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, শিক্ষক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা উপস্থিত ছিলেন।