‘এক ব্যক্তির ওপর আস্থা তৈরি করতেই বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করা হয়েছে’

‘এক ব্যক্তির ওপর আস্থা তৈরি করতেই বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করা হয়েছে’

'সংকট ৩ ধরনের হতে পারে—অকস্মাৎ, ধীরে ধীরে চলমান, এবং অত্যাসন্ন। বাংলাদেশের সংকট আস্তে আস্তে তৈরি হয়েছে।'

গতকাল শনিবার সকালে ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের আয়োজনে 'বাংলাদেশ রাজনীতি: কোথায় দাঁড়িয়ে, গন্তব্য কোথায়?' শীর্ষক বিশেষ ওয়েবিনারে এ কথা বলেন আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজ।

ওয়েবিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে আলী রীয়াজ জানান, আন্তর্জাতিকভাবে যেসব সংস্থা গণতন্ত্রের অবস্থার মূল্যায়ন করে তারা ২০১৮ সালের পরে বাংলাদেশকে অটেক্রেটিক বা স্বৈরাচারী বলেই চিহ্নিত করেছে।

গণতন্ত্র ক্ষয়ের প্রক্রিয়া বিস্তারিতভাবে তুলে ধরে আলী রীয়াজ বলেন, 'বাংলাদেশে নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা কুক্ষিগত করা সহজ হয়েছে, কেননা আইনসভা একদলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।'

তিনি বলেন, 'এখানে শাসন ব্যবস্থার ধরন এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক। সংবিধান প্রধানমন্ত্রীকে যতটা ক্ষমতা দিয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তারচেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন। অন্যত্র রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহৃত হয়, নিয়ন্ত্রিত হয়। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর করা হয়েছে, ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। এসব করা হয়েছে এক ব্যক্তির ওপরে আস্থা তৈরির উদ্দেশ্যে।'

তিনি এর সঙ্গে ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদসহ সাংবিধানিক বিভিন্ন ধারা ও রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের ওতপ্রোত সম্পর্কের কথা ব্যাখ্যা করেন।

বর্তমান শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সম্পর্ক উদঘাটন করে আলী রীয়াজ বলেন, 'আদর্শ বন্দোবস্ত টেকে কনসেন্ট বা সম্মতির ভিত্তিতে। অন্যথায় সেটা টিকে থাকে ৩ উপাদানের মধ্য দিয়ে—বলপ্রয়োগ, পক্ষভুক্তি (কো-অপটেশন) ও আদর্শিক বৈধতা। বর্তমান বাংলাদেশে যে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত, সেখানে সম্মতির দরকার নেই। ২০১৪ সাল থেকে দাঁড়িয়ে আছে বলপ্রয়োগ এবং "আদর্শিক বৈধতা"র ওপরে। ২০১৪ সালে সেটা ছিল ছিল "মুক্তিযুদ্ধের চেতনা" এবং ২০১৮ সালে ছিল "উন্নয়ন"।'

তিনি আরও বলেন, 'এই ব্যবস্থার অর্থনৈতিক দিক হচ্ছে, এখানে স্বল্প কিছু মানুষ সুবিধা পায়, রেন্ট সিকিংয়ের ধারা শক্তিশালী হয়, লুটপাট বাড়ে। বাংলাদেশের অর্থনীতির সংকটটা এইভাবেই তৈরি হয়েছে। যেহেতু শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে শাসন হয়, মানুষের ভেতরে ভীতি থাকে, আইন ও বিচার বহির্ভূত ব্যবস্থা প্রাধান্য পায়, সেহেতু এক ধরনের স্থিতিশীলতা থাকে যা চাপিয়ে দেওয়া স্থিতিশীলতা।'

'এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য বিরোধীরা ঐকমত্যে পৌঁছতে পারছেন কি না, সেটাই আগামী কয়েক মাসে দেখা যাবে। সেই কারণেই আগামী কয়েক মাসেই রাজনীতির ভবিষ্যৎ পথরেখা নির্ধারিত হবে। বাংলাদেশে প্রকৃতপক্ষে একটি কার্যকর বহুদলীয় ব্যবস্থা থাকবে কি না, আগামী নির্বাচনে কারা অংশগ্রহণ করছেন এবং কীভাবে অংশগ্রহণ করছেন, সেটাই নির্ধারণ করে দেবে', যোগ করেন তিনি।

আলী রীয়াজ সতর্ক করে বলেন, 'রাজনীতিতে অনেক দলের উপস্থিতিই বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রমাণ করে না। গণতন্ত্রের অন্যান্য উপাদানের কথা বাদ দিয়েও বলা যায় ক্ষমতাসীনদের নির্ধারিত সীমানার ভেতরে অনেক দলের উপস্থিতি বহুদলীয় ব্যবস্থা নয়।'

এই ওয়েবিনারে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার এবং অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ক্যানবেরার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক বীনা ডি কস্টা।

আলী রীয়াজের উপস্থাপিত প্রবন্ধের ওপর আলোচনা করেন অধ্যাপক বীনা। তিনি বলেন, 'আমরা সবসময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলছি, মুক্তিযুদ্ধের কথা বলছি, কিন্তু এখন বলার সময় এসেছে, কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে নীরবতার প্রক্রিয়াগুলো এখানে হাজির করা হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করা হচ্ছে।'

সুশাসন ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ওপর জোর দিয়ে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, 'বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় দুর্বৃত্তায়নের কবলে পড়েছে।'