সোহেল টানছেন ৪৫১ মামলার ঘানি

সোহেল টানছেন ৪৫১ মামলার ঘানি

তার রাজনীতির বয়স ৩৯। এ সময়ে আসামি হয়েছেন ৪৫১টি মামলায়। আর কারাগারে ছিলেন সব মিলিয়ে বছর পাঁচেক। কিন্তু এখন সপ্তাহের প্রায় প্রতিদিনই মামলার হাজিরা দিতে দিতে হয়রান তিনি। বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেল কেবল হাবিব উন নবী খান সোহেলের বিরুদ্ধে এই সংখ্যক মামলার তথ্য। তার আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলেও এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

বিএনপির করা তালিকা অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে গত এক যুগে দলটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১ লাখ ১১ হাজার ৪২৭টি। দলটির নেতারা বলছেন, নির্বাচনে প্রার্থী হলফনামায় যাতে সঠিক তথ্য দেওয়া যায় সেজন্য তারা মামলা হলেই সেটা তালিকা করে রাখছেন। দলটির দেওয়া তথ্য দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। যদিও তা সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের তথ্যের সঙ্গে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

হাবিব উন নবী খান সোহেল ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবকদল ও বিএনপির ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব থাকাকালে তার বিরুদ্ধে মামলাগুলো হয়েছে। তবে বেশিরভাগই মামলা হয়েছে গত ১২ বছরে।

নথি ঘেঁটে দেখা যায়, সোহেলের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলোর বেশির ভাগই পুলিশের কাজে বাধা দেওয়া, গাড়ি ভাঙচুর ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগে করা।

তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট শারমিন জাহান শিমুর কাছে রয়েছে ১০৫টি মামলার কাগজপত্র। তিনি দেশ রূপান্তরকে জানান, ২৫টি মামলার বিচারকাজ চলছে। আরেক আইনজীবী অ্যাডভোকেট সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার কাছে থাকা তথ্য ও অন্যা সহকর্মীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী হাবিব উন নবী খান সোহেলের নামে যেসব মামলা রয়েছে তাতে যদি ন্যূনতম ২ বছর করেও সাজা হয়, তাহলে ৮-৯শ’ বছর জেল হবে তার।’

বর্তমানে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব পদে থাকা এই নেতার সঙ্গে সম্প্রতি কথা হয় রাজধানীর তার বাসায়। রাজনীতিতে পোড় খাওয়া ও আত্মবিশ্বাসী এই নেতার সঙ্গে কুশল বিনিময়ের পর জানতে চাইলে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘৩৯ বছর ধরেই এভাবেই চলছে। এই আইনি মারপ্যাঁচ নিয়ে চিন্তা করে আর কী হবে। ৪৫১টি মামলার আসামি হয়ে আদালতের বারান্দায় দিন কাটাই। মাসের ৩০ দিনের ২০/২২ দিনই হাজিরা থাকে। হয় পুরান ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট বা জজ কোর্টে অথবা রমনার হাইকোর্টে। মাঝে যে ২/৪ দিন সময় পাই সেদিন ঈদ ঈদ মনে হয়।’

আরও জানালেন, ‘কোর্ট থাকা মানে ওই দিন কমপক্ষে ৬/৭টি মামলায় হাজির। এখন চাকরিজীবীদের অফিসে যাওয়ার মতোই সকাল সোয়া ৮টায় উঠে ১০টার মধ্যে আদালতে থাকতে হয়। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরি। অথবা কোনো কর্মসূচিতে যাই। প্রতিদিনই বাসা থেকে বের হই জেলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে।’

ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা এই নেতা নিজ খরচে এসব মামলা লড়ছেন বলে জানান। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন কমপক্ষে ৩ হাজার টাকার মতো খরচ আছে। ভাগ্য ভালো সিনিয়র আইনজীবীরা তাদের ফি নেন না। সেটি হলে তো মাস শেষে ১০ লাখ টাকায়ও পেরে ওঠা যেত না।’

হাবিব উন নবী খান সোহেল বলেন, ‘এমনও হয় সকালে এক কোর্টে গিয়েছি, সেখান থেকেই আরও ৪/৫টা কোর্টে এক সঙ্গে ডাক পড়ে। কোনটা রেখে কোনটায় যাব, এই কোর্ট থেকে সেই কোর্ট করতে করতে নাভিশ্বাস অবস্থা। তখন ভাবি আমার মতো মধ্য পর্যায়ের নেতার এই অবস্থা হলে, দলের নিচের দিকে নেতা বা কর্মীর কী চরম ভোগান্তি হচ্ছে। জেলা বা ইউনিয়ন নেতাদের কথা না-ই বললাম।’

নিজেই হিসাব কষে বললেন, ‘সবচেয়ে বেশি মামলা ও জেল খাটতে হয়েছে গত ১৪ বছরে। বিশেষ করে যখন স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি ও পরে ঢাকা মহানগরের দায়িত্বে ছিলাম।’

বিদেশে থাকা বন্ধুরা মামলার তথ্য পাঠাতে বলেছেন এ কথা জানিয়ে এই নেতা হেসে বলেন, ‘তারা নাকি গিনেজ বুক রেকর্ডে আবেদন করবে। যদি বিশে^র সবচেয়ে বেশি মামলা খাওয়া ব্যক্তি হওয়া যায়। কিন্তু বিভিন্ন কোর্ট থেকে মামলার কাগজ উঠাতে যে টাকা দরকার তা তো আমার কাছে নেই।’

২০০৮ সালে ঢাকা-৮ আসনে ধানের শীষ প্রতীকে নিয়ে নির্বাচন করা এই নেতার মতোই অবস্থা বিএনপির শীর্ষস্থানীয় থেকে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের।

সোহেল জানান, জাতীয় সংসদ নির্বাচন করেন এমন নেতারা নিজেরাই নিজেদের মামলার হিসাব রাখছেন। কেননা, জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে হলে নিজ হলফনামায় মামলার বিবরণীসহ যাবতীয় তথ্য সংযুক্ত করতে হয়।

দেশ রূপান্তরের হাতে থাকা বিএনপির দপ্তরের নথি অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে ২০২২ সালের ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে দলটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছে তাতে দেখা যায়, যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাহ উদ্দিন টুকুর বিরুদ্ধে ৩০৩টি, যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকারের নামে ৩২৪টি, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ২৩৪টি, যুবদল সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নীরব ২৩৫টি, যুবদলের সাবেক সহ-সভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর ২৭৮টি, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান ১৪৩টি, দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী ১৩৫টি, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহসানের নামে ১৪৬টি, চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসের নামে ১০১টি মামলা আছে।

এ ছাড়া বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু ৯৫টি, সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর ৫৫টি, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানির ৬৬টি, বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক সালাহ উদ্দিন আহমেদের ৯২টি, স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক সরাফত আলী সফুর ৮৭টি, প্রকাশনা সম্পাদক হাবিবুল ইসলাম হাবিবের ৫১টি, কৃষক দল সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবুলের নামে ৫৩টি মামলা রয়েছে।-দেশ রুপান্তর