বিদ্যুতের দাম আরও বাড়বে

বিদ্যুতের দাম আরও বাড়বে

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) টাকার অভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল পরিশোধ করতে পারছে না। গ্যাস বিলও বকেয়া। এর মধ্যেই ১৮ জানুয়ারি জ্বালানি মন্ত্রণালয় গ্যাসের দাম বাড়ানোয় পিডিবির ব্যয় বাড়ছে ৯ হাজার কোটি টাকার বেশি। তাই অর্থসংকট কাটাতে বিদ্যুতের দাম আবার বাড়ানোর চিন্তা করা হচ্ছে।

বিদ্যুৎ বিভাগ ও পিডিবির চারজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অর্থসংকট কাটাতে না পারলে পিডিবি গ্যাস ও জ্বালানি তেলের মূল্য পরিশোধ করতে পারবে না। বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিলও দিতে পারবে না। এতে আগামী গ্রীষ্ম মৌসুমে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে, লোডশেডিং বাড়তে পারে। তাই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো ছাড়া উপায় দেখছেন না তাঁরা।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, জ্বালানি তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরকার সরে আসতে চায়। বিশেষ করে ডিজেলচালিত সব বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হবে। এতে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে হবে। শিল্পেও বাড়তি গ্যাস দরকার। এ কারণে আমদানি বাড়াতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। এখন বিদ্যুতের দাম কিছুটা সমন্বয় করার প্রয়োজন হতে পারে।

এর আগে গত নভেম্বরে পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয় প্রায় ২০ শতাংশ (কার্যকর হয় ডিসেম্বর থেকে)। এটি সমন্বয়ে ১২ জানুয়ারি ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি ইউনিট (কিলোওয়াট ঘণ্টা) বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। সব মিলিয়ে গত ১৪ বছরে পাইকারি পর্যায়ে ১০ বার ও খুচরায় ১১ বার বেড়েছে বিদ্যুতের দাম।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র বলছে, পাইকারি বিদ্যুতের দাম নতুন করে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বাড়ানো হতে পারে। আর খুচরায় বাড়তে পারে ৫ শতাংশের মতো। তবে হিসাব এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আর দাম বাড়ানোর বিষয়ে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হবে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে।

বাড়তি ব্যয় ৯০০০ কোটি টাকা

জ্বালানির অভাবে গত বছর জুলাই থেকে ঘোষণা দিয়ে লোডশেডিং করতে হয়েছে সরকারকে। বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় খোলাবাজার থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কেনা ওই সময় বন্ধ করে দেয় সরকার। এখনো এটি চালু হয়নি। এলএনজি আমদানি বাড়ানোর কথা বলে এ মাসে (১৮ জানুয়ারি) গ্যাসের দাম রেকর্ড (গড়ে ৮২ শতাংশ) হারে বাড়ায় সরকার। সর্বোচ্চ ১৭৯ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুৎ খাতে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম।

দেশের সব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে চুক্তি অনুসারে নির্ধারিত দামে বিদ্যুৎ কিনে নেয় পিডিবি। এরপর তারা দেশের ছয়টি বিতরণ সংস্থার কাছে পাইকারি দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করে। বর্তমানে ৬ টাকা ২০ পয়সায় প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রি করছে পিডিবি। সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, ইউনিটপ্রতি তাঁদের বর্তমান ব্যয় ৯ টাকার বেশি।

পিডিবি সূত্র বলছে, প্রতি ইউনিট (ঘনমিটার) গ্যাস ব্যবহার করে চার ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম বেড়েছে ৯ টাকা। তার মানে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বাড়বে গড়ে দুই টাকার বেশি। মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের অর্ধেক

আসে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্র থেকে। এতে সামগ্রিকভাবে প্রতি ইউনিটে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বাড়বে গড়ে এক টাকা।

পেট্রোবাংলার অধীনে থাকা ছয়টি বিতরণ সংস্থার কাছ থেকে গ্যাস নেয় পিডিবি। দিনে গড়ে ১০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ পায় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। বর্তমান দামে (৫ টাকা ৪ পয়সা) বছরে পিডিবির গ্যাস বিল দাঁড়ায় ৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা। আগামী মাস, অর্থাৎ ফেব্রুয়ারিতে কার্যকর হতে যাওয়া নতুন দামে (ঘনমিটারপ্রতি ১৪ টাকা) বছরে পিডিবির গ্যাস বিল দাঁড়াবে ১৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকার বেশি।

ফলে দেখা যাচ্ছে, গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণে পিডিবির ব্যয় বাড়বে ৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ উৎপাদনে দিনে ১৩০ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ করার কথা ভাবছে সরকার। সেটা হলে পিডিবির খরচ আরও বাড়বে।

বকেয়া ২৭ হাজার কোটি টাকা

অক্টোবর পর্যন্ত হিসাবে পিডিবির কাছে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর পাওনা ২৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পাবে ২১ হাজার কোটি টাকা। গত কয়েক মাসের বিলের হিসাব এখনো চূড়ান্ত হয়নি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিল বকেয়া থাকায় বেসরকারি খাতের তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালানো যাচ্ছে না। এতে বসিয়ে রেখে কেন্দ্র ভাড়া (ক্যাপাসিটি চার্জ) দিতে হচ্ছে। উৎপাদনে থাকুক বা না থাকুক, চুক্তি অনুসারে কেন্দ্র ভাড়া পায় সরকারি-বেসরকারি প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্র।

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন-পেট্রোবাংলাও পিডিবির কাছে টাকা পায়। সূত্র বলছে, গত মে মাসের পর থেকে পিডিবি গ্যাসের বিল দিচ্ছে না। তিন হাজার কোটি টাকার বেশি বকেয়া জমেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিডিবির একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত অর্থ মন্ত্রণালয় ভর্তুকি ছাড় করেছে ১৩ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। এটি ২০২১-২২ অর্থবছরের ভর্তুকি হিসেবে পেয়েছে তারা। একই অর্থবছরের জন্য আগে পেয়েছে আরও ১০ হাজার কোটি টাকা। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরের ভর্তুকির কোনো টাকা এখনো পাওয়া যায়নি। পিডিবি ভর্তুকি চাহিদা জানিয়ে চিঠি দিলেও টাকা ছাড় করতে নিয়মিত দেরি করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

‘জনজীবন আরও বিপর্যস্ত হবে’

কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমান দামে কয়লা, জ্বালানি তেলসহ সব ধরনের জ্বালানি পেলেও চলতি অর্থবছর (২০২২-২৩) শেষে পিডিবির ঘাটতি দাঁড়াতে পারে ৪০ হাজার কোটি টাকা। নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ানোয় ঘাটতি ৫০ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে। অথচ বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভর্তুকি বরাদ্দ আছে ১৭ হাজার কোটি টাকা।

তবে বিদ্যুৎ খাত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে চাহিদার চেয়ে ৪০ শতাংশ বাড়তি সক্ষমতা তৈরি করা হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ থাকার কথা। অতিরিক্ত সক্ষমতার অলস রেখে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে হাজার হাজার কোটি টাকা কেন্দ্র ভাড়া দিতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ খাতে ভুল পরিকল্পনার কারণেই উৎপাদন খরচ বাড়ছে।

সংসদীয় কমিটিকে দেওয়া বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ২০২০-২১ অর্থবছরে কেন্দ্র ভাড়া দিতে হয়েছে ১৮ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকার বেশি। সূত্র বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৯ হাজার ৭০০ কোটি টাকার বেশি কেন্দ্র ভাড়া দিতে হয়েছে। একদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রকে বসিয়ে বসিয়ে ভাড়া দিতে হচ্ছে, অন্যদিকে এই শীতেও লোডশেডিংয়ে পড়তে হচ্ছে মানুষকে।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনার কারণেই লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বাড়ছে। আর এটি চাপানো হচ্ছে ভোক্তার ওপর। গ্যাসের দাম বাড়িয়ে এখন বিদ্যুতের দাম আবার বাড়ানো হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির কারণে বিপর্যয়ের মধ্যে থাকা জনজীবন আরও বিপর্যস্ত হবে। তিনি আরও বলেন, সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। অন্যায় ও অযৌক্তিক ব্যয় সমন্বয় না করে মূল্যবৃদ্ধি করা হচ্ছে। এর চেয়ে অন্যায় আর কিছু হতে পারে না।-প্রথম আলো