নীরবেই ধ্বংস একটি গণতন্ত্র, বিচারিক হয়রানির মুখোমুখি বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস

নীরবেই ধ্বংস একটি গণতন্ত্র, বিচারিক হয়রানির মুখোমুখি বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস

অধিকার প্রতিষ্ঠার সংকল্পে বিরোধী নেতা-কর্মীদের যখন রাজপথে মিছিলে সামিল থাকার কথা, কিংবা অপশাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর পরিকল্পনায় যখন ব্যস্ত সময় পার করার কথা, তখন লক্ষ নেতা-কর্মীর দিন কাটছে কোর্টের বারান্দায়, আইনজীবীর চেম্বারে কিংবা নির্যাতনের খাচায়। শতশত মামলার স্তুপ আর গুম-খুন তাড়া করে ফিরছে ১৭ কোটির বাংলাদেশে লাখো লাখো মানুষ।

এমন ভয়ানক ফিরিস্তি দিয়ে অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস। পত্রিকাটির দক্ষিণ এশিয়ার ব্যুরো প্রধান মুজিব মাশালের তৈরী করা এই রিপোর্টের বাংলা অনুবাদ জাস্টনিউজ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:

এই রিপোর্টটি তৈরি করার আগে বাংলাদেশ দুইবার ঘুরে আসতে হয়েছে। বিদেশি সাংবাদিকদের বাংলাদেশ ভ্রমণে কড়াকড়ি আরোপ করেছে দেশটির সরকার।

১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশে আদালতের জনাকীর্ণ কোর্ট রুমগুলোতে বিচারের নামে কায়দা করে বহুদলীয় গণতন্ত্রকে হত্যা করা হচ্ছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের লাখো নেতা, সদস্য এবং কর্মীকে প্রায় প্রতিদিন বিচারকের সামনে হাজিরা দিতে হয়। তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার অভিযোগগুলো ঢাহা মিথ্যা আর প্রমাণগুলো একদম নকল করা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোটে লড়ই যখন আসন্ন, ঠিক সেই মুহূর্তে বিরোধীদের অচল করে দেবার যে আয়োজন চলছে, তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

প্রধান বিরোধী দল বিএনপির হিসেব অনুসারে সংগঠনটির ৫০ লাখ কর্মী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় জর্জরিত। সংগঠনটির সক্রিয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কয়েক ডজন মামলা দায়ের করা হয়েছে, এমনকি অনেকের বিরুদ্ধে শত শত মামলা দায়ের করা হয়েছে। যেখানে কঠিন আন্দোলনের সমাবেশ এবং নির্ঘুম পরিকল্পনা তৈরির মাধ্যমে জনগণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার কথা সেখানে তাদের অধিকাংশ সময় পেরিয়ে যাচ্ছে ঢাকায় আইনজীবীর চেম্বার আর কোর্ট রুমের খাচারধীর গতির নিষ্ঠুর নির্যাতনে।

সম্প্রতি এক সকালে সাইফুল আলম নিরব নামে এক বিরোধী নেতাকে হাতকড়া পরিয়ে ঢাকার ১০ তলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে ৩১৭ থেকে ৩৯৪টি মামলা রয়েছে। মামলার সংখ্যা এত বেশি যে, তিনি এবং তার আইনজীবীরা নিশ্চিত নন- ঠিক কতোটি মামলা রয়েছে। আদালতের বাইরে আরও এক ডজন সমর্থক পাওয়া গেল যাদের ওপরে রয়েছে প্রায় ৪০০ মামলা। তারা একটি সরু গলিতে দাঁড়িয়ে ছিলো। হঠাৎ করে বৃষ্টি নামায় আর আরেকজন রাজনৈতিক বন্দির জন্য জায়গা করে দিতে পুলিশের বাজানো বাঁশির হুইসেল তাদের ব্যস্ততায় বাগড়া বাধায়। আব্দুস সাত্তার নামে একজন সমর্থক বলেন, আমি আর কোনো চাকরি করতে পারছি না। তার বিরুদ্ধে ৬০টি মামলা রয়েছে। সপ্তাহে তিন বা চার দিন তার আদালতেই কেটে যায়। এটা যেনো মামলার পর মামলা, এমন একটা বিষয়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিক সাফল্যের জন্য পরিচিতি পেয়েছে বাংলাদেশ। গার্মেন্টস রপ্তানি শিল্পের উপর দৃঢ় ফোকাস বাংলাদেশকে ডলারের স্থির প্রবাহ নিশ্চিত করেছে। এই শিল্পের কারণে অর্থনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে এবং লাখ লাখ মানুষ দারিদ্র্য থেকে বের হয়ে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেকেই যে দেশকে দুর্ভিক্ষ আর রোগের ঝুড়ি মনে করতো সেই দেশটি মনে হচ্ছিলো কয়েক দশক ধরে চলা অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান আর রাজনৈতিক হত্যাকান্ড থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এই সফলতার নিচে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজনৈতিক একত্রীকরণের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন। বিরোধী নেতা, বিশ্লেষক ও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, এর লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশকে একটি একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করা।

বিগত ১৪ বছর ক্ষমতায় থেকে তিনি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছেন। যার মধ্যে রয়েছে পুলিশ এবং সেনাবাহিনী, বিশেষ করে নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন আদালতের। এসব জায়গা তার অনুগতদের দিয়ে ভরে ফেলেছেন- কোনো সমস্যায় যাতে না পড়তে হয় এটা নিশ্চিত করার জন্য। রাষ্ট্রের এসকল প্রতিষ্ঠানগুলোকে তিনি হাতিয়ার বানিয়ে বসেছেন বিরোধীদের কন্ঠরোধ করতে এবং রাজনৈতিক শত্রুদের বিরুদ্ধে তার ব্যক্তিগত প্রতিশোধের খায়েশ মেটাতে। তার টার্গেটে রয়েছেন শিল্পী, সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্ট এবং এমনকি নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসও। এটার লক্ষ্য হলো- দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটিকে (বাংলাদেশ) একদলীয় শাসনের দেশে পরিণত করা ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ আবারো উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। বিরোধীরা ভোটটিকে দেখছে তাদের শেষ লড়াই হিসেবে। অপরদিকে শেখ হাসিনার সহযোগীরা বলছেন,

অনিশ্চয়তার মধ্যে থেকে কোনো ভাবেই বিএনপিকে জিততে দেয়া যাবে না। কারণ তারা যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে তারা আমাদেরকে ‘হত্যা করবে।’

একটি সাক্ষাৎকারের সময় বিরোধীদের হয়রানি করার জন্য বিচার বিভাগকে ব্যবহার করার বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল শেখ হাসিনাকে। তিনি সে সময় তার এক সহযোগীকে একটি ছবির অ্যালবাম নিয়ে আসতে বলেন। সেই অ্যালবামজুড়ে ছিল অসংখ্য অগ্নিসংযোগ, বোমা বিস্ফোরণ এবং অন্যান্য হামলার পর বিকলাঙ্গ মৃতদেহের গ্রাফিক ছবি। তিনি বলেন, বিষয়টি রাজনৈতিক নয়। এরপর বিএনপি’র ‘বর্বরতার’ উদাহরণ হিসেবে তিনি ছবিগুলোর দিকে ইঙ্গিত করেন। তিনি বলেন, তাদের অপরাধের কারণেই এই বিচার হচ্ছে।

বিএনপির নেতারা বলছেন, ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকে তাদের প্রায় ৮০০ সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে এবং ৪০০ জনেরও বেশি নিখোঁজ হয়েছে। সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন একই কাজ করেছিল। তার দলের সমর্থকদের জেলে পুরা ও হত্যা করা হয়। তারাই (বিএনপি) এটা শুরু করেছে।

গত তিন দশক ধরে বাংলাদেশের গল্প হচ্ছে মূলত দুই শক্তিশালী নারীর মধ্যে তিক্ত প্রতিদ্বন্দিতার। তাদের একজন হচ্ছেন শেখ হাসিনা (৭৫) এবং অন্যজন হচ্ছেন বিএনপি নেত্রী এবং বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া (৭৭)। ১৯৭১ সালে শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার সব থেকে বড় নেতা ছিলেন। দেশ স্বাধীনের চার বছর পর তিনি একটি সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন এবং তার পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যকে হত্যা করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর তৈরি হওয়া চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে ক্ষমতায় আসেন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান। তার স্ত্রীই হচ্ছেন খালেদা জিয়া। জিয়াউর রহমানও ১৯৮১ সালে সৈন্যদের হাতে নিহত হন।

এরপর অধিকাংশ সময়টাতে এই দুই নেত্রীই বাংলাদেশের গণতন্ত্রে একে অপরের প্রতিদ্বন্দী হয়ে উঠেন।

শেখ হাসিনা বলেন, আসলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামটা ছিল আমারই। এই বিরোধীদল গঠন করেছিল একজন সামরিক স্বৈরশাসক। অপরদিকে বিএনপি দাবি করে যে, শেখ হাসিনার পিতা একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠার পর তারাই বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের সেই অপূর্ণ স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করছেন শেখ হাসিনা।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, তারা (আওয়ামী লীগ) গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না।

২০১৮ সালে দুর্নীতির অভিযোগে খালেদা জিয়াকে জেলে পাঠানো হয়। এখন তিনি গৃহবন্দি অবস্থায় আছেন। স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়ায় এখন তিনি টেলিভিশন দেখা এবং সংবাদপত্র পড়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেন। তার ছেলে তারেক রহমান ২০০৪ সালে শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলায় জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ আনা হয়েছে, যা বিএনপি অস্বীকার করে। বর্তমানে লন্ডনে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন তারেক রহমান। এমন অবস্থায় দলের ডি-ফ্যাক্টো নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার বিরুদ্ধেও রয়েছে ৯৩টি মামলা। এর পেছনেই বড় একটি সময় ব্যয় করতে হয় তাকে।

বিগত বছরগুলোতে নিজের অবস্থান নিয়ে শঙ্কা তৈরি হবার কারণে বিরোধীদের ওপর আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়েছেন শেখ হাসিনা।

মহামারির কারণে বৈশ্বিক চাহিদা ব্যাহত হওয়ার পর বাংলাদেশ এখন তার পোশাক শিল্পকে আগের ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে। তবে এমন সময় ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানের কারণে আমদানি করা জ্বালানি এবং খাদ্যের দাম বেড়ে গেছে। এর ফলে দেশে ডলারের সরবরাহ বিপজ্জনকভাবে কমে যায়। শেখ হাসিনা বলেন, এটি আমাদের অর্থনীতিতে প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করেছে।

নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনে বিরোধীদের দাবি অস্বীকার করেছেন শেখ হাসিনা। ক্রমবর্ধমান খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি, বিদ্যুতের ঘাটতি, নির্বাচনে কারচুপির সম্ভাবনা নিয়ে জনমনে যে ক্ষোভ সেটিকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে রাজপথে নিজেদের শক্তির জানান দিতে চেয়েছিলো সরকারের দ্বারা নির্যাতিত বিরোধী দল। জুন মাসে একটি বিশাল সমাবেশের সময় বিএনপির বক্তারা অবাধ নির্বাচন ও রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির দাবি জানান। ঢাকার রাজপথে বিরোধীদের বিক্ষোভ উত্তপ্ত পরিস্থিতির আভাস দিচ্ছে।

এসময় পাল্টা একটি সমাবেশ আয়োজন করে শাসক দল আওয়ামী লীগ। সেখানে বক্তারা স্বীকার করেন যে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতন্ত্রের দিকে নজর রাখছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের সিনিয়র নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং ভিসা বিধিনিষেধের হুমকি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় কর্মকর্তারা সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি সফর করেছেন।

সমাবেশের কয়েক সপ্তাহ পর বিএনপি যখন আরেকটি সমাবেশের আয়োজন করে তখনি ক্ষমতার চিন্তায় অস্থির হাসিনা সেটাকে বলপ্রয়োগে দমন করে। দলটির কর্মীরা বড় সমাবেশ করার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের ওপর লাঠি চার্জ ও টিয়ার গ্যাস হামলা চালায়। নতুন করে ৫০০ মামলা দেয়া হয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। এই ক্র্যাকডাউন এটাই প্রমাণ করে যে, পশ্চিমারা সতর্ক করলেও তা শেখ হাসিনার মতো নেতার ওপর সীমিত প্রভাব ফেলেছে। তিনি এশিয়ার দুই প্রধান শক্তি চীন ও ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রেখেছেন।

বাংলাদেশি আইনজীবী এবং প্রবাসে থাকা অ্যাক্টিভিস্ট আশরাফ জামান এশিয়ান মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গে কাজ করেন। তিনি বলেন, সরকার ব্যাপক মাত্রায় বল প্রয়োগ করছে।

আশরাফ জামান বলেন, পুলিশ একটি মামলায় অনেক লোককে গ্রেপ্তার করে। এরপর তাদের বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ’ বা পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগ আনা হয়। একই মামলায় ডজন ডজন বা এমনকি শত শত ‘বেনামি ব্যক্তিদের’ রাখা হয় যাতে নতুন করে অন্যদেরও ওই মামলায় যুক্ত করা যায়।

মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, বিচারকের সামনে প্রমাণ উপস্থাপন করার আগেই অভিযুক্তরা মাসের পর মাস জেলে কাটান। এ ছাড়া জেলে তাদের হযরানি বা নির্যাতনের ঝুঁকি থাকে। আইনজীবী ও আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক মামলায় জামিন পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তি মুক্তি পেলে, সরকার এটিকে একটি মহান উপহার হিসেবে উপস্থাপন করে। কিন্তু এ ব্যক্তিটিকে প্রথমেই যে আটক করা উচিত ছিল না তা অবশ্য মেনে নেয়া হয় না।

আশরাফ জামান বলেন, আসামিপক্ষের আইনজীবীরা সাধারণত আদালতে যুক্তি দেন যে- তাদের মক্কেলের একটি পরিবার আছে, তিনি ইতিমধ্যে দীর্ঘ সময় জেলে কাটিয়েছেন, তাই আপনি যদি দয়া করে তাকে জামিন দেন তবে আসামি কৃতজ্ঞ থাকবে। এরপরই প্রসিকিউশন মুক্তির অনুমতি দেয়।

রাজনৈতিক মামলার জন্য ব্যস্ততম স্থানগুলোর মধ্যে একটি হলো ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। সেখানেই জুনের এক সকালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বিএনপি নেতা নিরবকে। তার আইনজীবী সৈয়দ নজরুল বলেন, তার মক্কেলের বিরুদ্ধে শহরের প্রতিটি থানায় অন্তত একটি করে মামলা রয়েছে। প্রতিদিন সকালে বিচার শুরু হওয়ার আগে বার এসোসিয়েশন ভবনের ২০৫ নম্বর কক্ষে প্রায় এক ডজন আইনজীবী ভিড় করেন, যেখানে সৈয়দ নজরুল শেষবারের মতো কাগজপত্র পরীক্ষা করেন। ১২ই জুন অফিসের বড় খাতায় দেখা যায় যে, এই দলটি সেদিন ৩৩ জন ক্লায়ান্টদের হয়ে লড়েছে। এরমধ্যে ৩২টিতেই বিএনপি নেতা-কর্মীরা জড়িত। সৈয়দ নজরুল বলেন, শুনানি সর্বোচ্চ ২০ মিনিট ধরে চলে। এরপর সারাদিন এই হয়রানির মধ্যেই কেটে যায়।

এই দুই দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াও অন্য মামলায় যারা তাদের আদর্শের জন্য লড়ছেন তাদেরকেও চড়া মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে।

কম্পিউটার প্রকৌশলী দিদারুল ভুঁইয়া অস্ট্রেলিয়ায় পডাশোনা শেষ করে ঢাকায় ফিরেছেন। তিনি একটি ছোট সফটওয়্যার কোম্পানি স্থাপন করেছেন, বিয়ে করেছেন এবং তিন ছেলেকে বড় করেছেন। কিন্তু প্রায়ই একটি প্রশ্ন তার মাথায় আসে যে, তার ফিরে আসার সিদ্ধান্ত কি সঠিক ছিল? এরপরই তিনি সুশীল সমাজ আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে ওঠেন, যার লক্ষ্য ছিল সিস্টেমে নজরদারি জোরদার করা। তার সন্তানরা যাতে বিদেশে জীবন কাটাতে বাধ্য না হয় সেটি নিশ্চিত করতে চান তিনি। দিদারুল ভুঁইয়া বলেন, কেউ ক্ষমতায় গেলেই তিনি আইনের ঊর্ধ্বে চলে যান। দিদারুল ভূঁইয়ার গ্রুপ মহামারি চলাকালীন ত্রাণ তহবিলের ব্যবস্থাপনার সমালোচনা করার পর সাদা পোশাকে নিরাপত্তা বাহিনী তাকে একটি ভ্যানে করে তুলে নিয়ে যায়।

তার স্ত্রী দিলশাদ আরা ভুঁইয়া তার স্বামীর জামিনের জন্য আদালত থেকে আদালতে দৌঁড়েছেন। কিন্তু তারা তার মামলা শুনতে অস্বীকার করেন, যদিও সরকার তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দায়ের করেনি। বিচারকরা নাম ও মামলাটি দেখেই বলে দেন যে, ‘দুঃখিত, আমি পারবো না’। অবশেষে পাঁচ মাস জেলে থাকার পর জামিন পান তিনি। রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অস্পষ্ট অভিযোগ তুলে তাকে গ্রেপ্তারের প্রায় এক বছর পরও পুলিশ কোনো অভিযোগ দায়ের করেনি। প্রমাণের মূল অংশ হিসেবে পুলিশ দিদারুল ভুঁইয়ার একটি ফেসবুক পোস্ট জমা দিয়েছে। সেটি আবার তিনি মুক্তির কয়েক মাস পর লিখেছিলেন।

দিদারুল ভুঁইয়ার গ্রেপ্তারের সময়ই গ্রেপ্তার হওয়া আরেক অ্যাক্টিভিস্ট মোশতাক আহমেদ জেলেই মারা যান। মোশতাক আহমেদের একটি বড় প্রতিকৃতি দিদারুল ভুঁইয়ার হোম অফিসে ড্রয়ারে রাখা আছে। তিনি মোশতাক আহমেদের মৃত্যুকে রাজনৈতিক হত্যা বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, বিনাবিচারে কাউকে ১০ মাসের কারা নির্যাতন হত্যার জন্য যথেষ্ট।