সন্দেহভাজন বদি ওমরায় গেলেন কী করে: সৈয়দ আনোয়ার

সন্দেহভাজন বদি ওমরায় গেলেন কী করে: সৈয়দ আনোয়ার

ঢাকা, ২ জুন (জাস্ট নিউজ) : সন্দেহভাজন মাদক পাচারকারী হওয়া সত্ত্বেও সরকার দলীয় সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি কী করে ওমরা পালনের নামে সৌদি আরব চলে গেলেন তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। মাদকের ‘গডফাদারদের’ ছাড় দেয়া হচ্ছে অভিযোগ করে চলমান অভিযান সফল হওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন তিনি।

শুক্রবার মধ্যরাতে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে সংবাদপত্র পর্যালোচনাভিত্তিক অনুষ্ঠান ‘আজকের সংবাদপত্রে’ অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানটির সঞ্চালক ছিলেন মীর মাসরুর জামান।

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে কক্সবাজার-৪ আসন থেকে জয়ী বদির বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইয়াবা কারবারে সম্পৃক্ততার অভিযোগ জমা পড়ে ২০১০ সালেই। পরে বিজিবির তালিকাতেও তার ও তার ঘনিষ্ঠদের নাম আসে। যদিও পরে সর্বশেষ তালিকা থেকে তার নাম বাদ পড়ার তথ্যই পাওয়া গেছে। গত ৪ মে থেকে দেশব্যাপী চলা মাদকবিরোধী অভিযানে আলোচিত এই সাংসদ ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় অনেকে এই অভিযানের সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। এর মধ্যেই বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে বদি ওমরার উদ্দেশ্যে সৌদি আরব চলে গেছেন।

সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বদির বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও প্রমাণ নেই। আর প্রমাণ পেলে তাকেও ছাড়া হবে না।

এ প্রসঙ্গে সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, একজন সাংসদ যিনি আগে থেকে পরিচিত, বিতর্কিত বহুদিন থেকে সরকারের পাঁচটি গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে অন্তত তিনটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে সেই সাংসদ সম্পর্কে তথ্য আছে। তারপরও কিন্তু সরকার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে যদি প্রমাণ থাকে তখন তৎপর হওয়া যাবে। কথাটা আপাতত দৃষ্টিতে অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত, যথোপযুক্ত তথ্য প্রমাণ দরকার। যদি সরকারের গোয়েন্দার সংস্থার প্রতিবেদনে তথ্য না থাকে তাহলে আর কোথায় থাকবে। সাধারণ মানুষতো আর গায়ে পড়ে তথ্য দেয় না কখনও। এটা জানবার দায়িত্ব ও কর্তব্য সরকারেরই।

ইতিহাসের এই অধ্যাপক বলেন, আমাদের দেশে আইনের অভাব নেই। যেটা অভাব সেটা হচ্ছে আইন প্রয়োগের। রাজনীতিমুক্ত পরিবেশে যদি আইনের প্রয়োগ হতো তাহলে দেশটি অনেক স্বস্তিদায়ক হতো। মাদক নিয়ন্ত্রণে নতুন আইন হচ্ছে এতে আমি বিস্মিত নই। কারণ যে আইনগুলো বিদ্যমান আছে তাতেই মাদকবিরোধী তৎপরতা চালানোর জন্য যথেষ্ট সহায়ক। এবং আইন যদি না থাকে তাহলে এখন মাদক চোরাচালানকারীদের, গডফাদারদের বিরুদ্ধে বা তাদের চেলাচামুন্ডাদের বিরুদ্ধে কীভাবে অভিযান চলছে, সেটি একটা প্রশ্ন উঠে আসে? আরো একটি প্রশ্ন উঠে, মাদকের সমস্যাতো আজকের নয়, অন্তত বিগত দুই দশক ধরে মাদকের সমস্যা চলমান।

আইনের প্রয়োগ বা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখবার মতো রাজনীতিমুক্ত একটা দৃঢ় মানসিকতা ও পরিবেশ রক্ষা করা। কারণ আমরা জানি, ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়ে গেছে, রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেক মাদকের গডফাদার এই অভিযানের আওতামুক্ত রয়ে গেছে। যেমন দেখা যায়, যেটা আমরা সব সময় শুনেছি, জেনেছি গণমাধ্যমে, যে বাংলাদেশে ইয়াবা ব্যবসায় সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হয় টেকনাফ ও উখিয়া থেকে। সেখানে কিন্তু সেভাবে কোনো অভিযান আমরা দেখি না। উপরন্তু অতি সাম্প্রতিক যে তথ্যটা (কাউন্সিলর একরামুল নিহতের ঘটনা) আমাদের কাছে এলো, সেটা বেশ শঙ্কা ও উৎকণ্ঠার কারণ।

সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, সরকার অনেক বেশি সচেতন, অনেক বেশি তৎপর, আইন যত দ্রুত হয় তত ভালো। তবে এর আগে মাদক থেকে নিষ্কৃতি কীভাবে পাওয়া যায়, সেটা একটু ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শুধু গুলি করে হত্যা করলে বা আটক করে বিচারের মুখোমুখি করলেই যে মাদক নির্মূল হবে তাতো নয়, হয়তো কিছুটা কাজ হবে। কারণ একটা ত্রাসের সৃষ্টি হয়েছে ইতিমধ্যে। আমরা শুনেছি যারা ছোটখাট তারা নাকি তাবলিগ জামাতে ঢুকে গেছে, যাতে তাদেরকে ধরা না যায়। আর বড় যারা তারা কিন্তু দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে।

শুধু অভিযানে মাদক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয় জানিয়ে তিনি বলেন, ফিলিপাইনে এই ধরনের মাদকবিরোধী যুদ্ধ ঘোষণা করেও লাভ হয়নি। মাদক রয়ে গেছে। বাংলাদেশেও এর আগে বিএনপি সরকারের আমলে অপারেশন ক্লিন হার্ট হয়েছিল দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে। দুর্বৃত্ত বা সন্ত্রাস বাংলাদেশ থেকে নির্মূল করা যায়নি। উপরন্তু অপারেশন ক্লিন হার্টের পরে একটা দায়মুক্ত অধ্যাদেশ বিধিবদ্ধ করতে হয়েছিল।

তিনি বলেন, আমারতো সন্দেহ হচ্ছে, উৎকণ্ঠা আছে এবারও এমন একটা দায়মুক্তি অধ্যাদেশের হয়তো ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ তথাকথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হত্যা করা হচ্ছে বিনাবিচারে।

আনোয়ার বলেন, সংবাদমাধ্যম কিন্তু কৌশলে খবরগুলো দিচ্ছে। সেটা বৈদ্যুতিক মাধ্যমে হোক বা মুদ্রণ মাধ্যমে হোক। বলছে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ এবং র‌্যাব পুলিশের দাবি যে, এতজন হত্যা করা হয়েছে যাদের কাছে মাদক ছিল। অর্থাৎ সংবাদমাধ্যম নিজে দায়িত্ব নিচ্ছে না খবরের সত্যতা নির্ধারণ করবার। এ দায়িত্বটি হয়ে যাচ্ছে সরকারের ওপরে বা সরকারের বাহিনীগুলোর ওপরে। কাজেই এক ধরনের অনাস্থা এসে গেছে গোটা প্রক্রিয়ার উপরে। আমরা খুবই খুশি যে, একটা উদ্যোগ চলছে, একটা আয়োজন চলছে, সরকার একটা শক্তপোক্ত অবস্থান গ্রহণ করেছে।

তিনি বলেন, তবে যে প্রক্রিয়ায় এই আয়োজন চলমান তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, আমরাতো চাই প্রশ্নাতীত পদ্ধতিতে সমস্যাগুলোর সমাধান হোক।

এই বিশ্লেষক বলেন, মাদকের সরবারহ বন্ধ করতে হবে। আমরা জানি মিয়ানমার থেকে অনবরত আসছে ইয়াবা, আর মিয়ানমারের কারখানাগুলো সব বাংলাদেশ মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকায়, ওখানে একটু বাধা দিতে হবে। আর ভারত থেকে আসছে ফেনসিডিল। এই দুই প্রতিবেশীদের কাছ থেকে দুই ধরনের মাদক আমরা পাচ্ছি। যেকোনো মূল্যে সরবরাহ বন্ধ করতে হবে।

তিনি বলেন, এই ধরনের অভিযান চলমান থাক। তবে আইনগত প্রক্রিয়ার মধ্যে থাক। গ্রেপ্তার করা হোক, বিচার করা হোক। বিচারিক আদালতে তারা দোষী সাব্যস্ত হোক। একজন মানুষের বিরুদ্ধে যতই গুজব থাক, যে প্রক্রিয়াই হোক অভিযোগ প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত তাকে দোষী বলা সম্ভব নয়। সমস্যাটা সেখানে রয়ে গেছে। আর একটা হচ্ছে, সামাজিক একটা আন্দোলন দরকার। সরকারই এর সূচনা করতে পারে। মাদকবিরোধী যাবতীয় প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে।

জাস্ট নিউজ/এমআই/১৫৩৪ঘ.)