বাংলাদেশে মাদকবিরোধী অভিযানে লাশের সংখ্যা বাড়ছে

বাংলাদেশে মাদকবিরোধী অভিযানে লাশের সংখ্যা বাড়ছে

ঢাকা, ৯ জুন (জাস্ট নিউজ) : একটি বন্দুকের শব্দ। একজন নারী কাঁপতে কাঁপতে প্রার্থনা করতে লাগলেন। একটি গুলি বেরিয়ে গেল। এক দলা বেদনা ছড়িয়ে পড়লো। দ্বিতীয় গুলির শব্দে ছড়িয়ে পড়লো বাতাসে আর্তনাদ। পাশেই সাইরেন বেজে উঠলো।

শোনা গেল একজন পুরুষের ফিসফিসানি শব্দ। গত সপ্তাহে প্রকাশিত দু’সন্তানের মা আয়েশা বেগমের ধারণ করা রেকর্ডিংয়ের অংশ এটুকু। তবে এ বিষয়ে যাচাই করতে পারেনি সিএনএন। আয়েশা বেগম বলেছেন, কক্সবাজারে গত ২৭ মে তার স্বামী আকরামুল হকের শেষ সময়টাকে তিনি ১৫ মিনিটের ওই রেকর্ডিংয়ে ধারণ করেছেন। কর্তৃপক্ষ বলছে, তিনি মাদকের ব্যবসায়ী ছিলেন। তার পরিবার বলছে, তিনি ছিলেন জেলা পর্যায়ের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। তিনি মাদক ব্যবসার বিরুদ্ধে কথা বলতেন। বাংলাদেশে যখন মাদকের বিরুদ্ধে দমনপীড়ন চলছে তখন জাতিসংঘ বলছে, বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো গত তিন সপ্তাহে ১৩০ জনকে হত্যা করেছে। তার মধ্যে অন্যতম আকরামুল হক। নিজের স্বামী হত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করছেন আয়েশা বেগম। তিনি বলেন, আমার মেয়েরা তাদের পিতাকে হারিয়েছে।

অনেক বছর ধরে বাংলাদেশ মাদকের সমস্যা মোকাবিলা করছে। এখানে অ্যামফেটামিনে বাজার সয়লাব এবং ডিলাররা যুব সমাজকে টার্গেট করছে। অপ্রত্যাশিতভাবে ১৫ মে বাংলাদেশ সরকার মাদকের ডিলার ও সরবরাহকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। বাংলাদেশ পুলিশের কর্মকর্তা সাহেলি ফেরদৌস সিএনএনকে বলেছেন, গত তিন সপ্তাহে সারাদেশে এ অভিযানে প্রায় ১৫০০০ মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রড্রিগো দুতের্তে মাদকের বিরুদ্ধে যে নৃশংস লড়াই করেছেন বাংলাদেশের এই অভিযানকে তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। সরকারের বিরুদ্ধে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ তুলেছে মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপ। তারা চাইছে, মাদকের বিরুদ্ধে এই অভিযান স্থগিত করুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার এবং প্রতিটি নাগরিককে তার যথাযথ আইনি সহায়তা দিক। বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেছেন, এসব মানুষের মানবাধিকারের বিষয়টি অবশ্যই দেখতে হবে যাতে কোনো নিরাপরাধ মানুষ ভিকটিমে পরিণত না হন। যেসব মানুষ মাদকের সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে বিষয়টি মানবাধিকারের দৃষ্টিতে দেখা উচিত। এটা করা উচিত সংবিধান অনুযায়ী।

নতুন মাদকাসক্তদের মধ্যে প্রিয় হলো অ্যামফেটামিন ও ক্যাফেইনের সমন্বয়ে তৈরি ইয়াবা। মুসলিম এ দেশটিতে এলকোহল নিষিদ্ধ। তবে মাদক ছড়িয়ে পড়েছে, যদিও তা বিপজ্জনক। সরকারের ২০১৬ সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, সর্বশেষ তথ্য বলছে, ২০১৬ সালে কমপক্ষে ২ কোটি ৯০ লাখ ইয়াবা ট্যাবলেট জব্দ করা হয়েছে। অথচ ২০১১ সালে তা ছিল মাত্র ১৩ লাখ। এর বেশির ভাগই আসছে মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে। ওই এলাকায় সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ফলপ্রসূ হয় নি।

বাংলাদেশ সরকারের প্রতি কড়া নিন্দা জানিয়ে একটি বার্তা দিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার জায়েদ রাদ আল হোসেন। তিনি বলেছেন, সরকারের মাদক বিরোধী অভিযান বিপদজনক এবং এতে আইনের শাসনের মোটেও তোয়াক্কা করা হচ্ছে না বলেই ইঙ্গিত মেলে। যেহেতু ব্যাপক সংখ্যক মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাই এক্ষেত্রে খেয়ালখুশিমতো অনেক লোককে গ্রেপ্তার করা হয়ে থাকতে পারে। এক্ষেত্রে তাদের মানবাধিকারের বিষয়টি মাথায় রাখা হয় না। বুধবার একটি বিবৃতি দিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। এতে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগগুলো নিরপেক্ষভাবে তদন্তের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।

সংগঠনটির এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ব্রাড এডামস বলেছেন, যতক্ষণ না এসব হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত হজেচ্ছ এবং জনসাধারণকে রক্ষার বিষয়টিতে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত এই অভিযান স্থগিত করা উচিত। এক্ষেত্রে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণের গুরুত্বের কথা বলেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া বার্নিকাটও। গত সপ্তাহে তিনি বলেছেন, আমাদের সমাজে যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা দোষী প্রমাণিত না হচ্ছি ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা নিরপরাধী। তাই সবারই এই অধিকার থাকা উচিত। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ বলছে, এই অভিযান স্থগিতের কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই। গত সপ্তাহে তিনি প্রকাশ্যে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, এতসব ঘটনার মধ্যে আপনি কি আমাকে এমন একজন নিরপরাধ মানুষ দেখাতে পারবেন যিনি এর মধ্যে পড়ে শিকারে পরিণত হয়েছেন?

এ সপ্তাহে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সিএনএনকে বলেছেন, যতক্ষণ সমস্যা নিয়ন্ত্রণে না আসবে ততক্ষণ মাদক বিরোধী অভিযান চলবে। বুধবার বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে এক র‌্যালিতে অংশ নিয়েছিলেন কয়েক ডজন মানুষ। ঢাকার শাহবাগে একটি মানববন্ধন করার চেষ্টাকালে উচ্চ পর্যায়ের অধিকারকর্মী ইমরান এইচ সরকারকে সাত ঘন্টা আটক করে রাখে পুলিশের বিশেষ বাহিনী।

আরেকটি পরিবার বিপর্যস্ত: ২৫ মে গুলি করে হত্যা করা হয় কামরুল ইসলামকে (২৫)। তিনি ছিলেন উচ্চ পর্যায়ের মাদক ব্যবসায়ীর তালিকায়। মাদক ও অবৈধ অস্ত্র রাখার দায়ে তার বিরুদ্ধে ১৫টি মামলা আছে। তবে তিনি অভিযুক্ত হয়ে শাস্তি পান নি। তিনি ঢাকায় একটি বাস টার্মিনালের কাছে রাস্তার পাশে খাবারের ব্যবসা করতেন। তিনি ছিলেন তার সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার স্ত্রী তাসলিমা স্বীকার করেন, তিনি মাদকের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু ১০ বছর আগে তার প্রথম মেয়ের জন্মের পর তা বাদ দিয়েছেন। তার ভাষায়, তারপর থেকে আমাদের ছিল সুখী দাম্পত্য জীবন। আরো দুটি কন্যাকে নিয়ে আমরা সুখী ছিলাম। এখন আমরা একেবারে অসহায়। আমাদেরকে কেউই কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়নি। (অনলাইন সিএনএন-এ প্রকাশিত লেখার অনুবাদ), সৌজন্যে : মানবজমিন

(জাস্ট নিউজ/ডেস্ক/একে/০০২৫ঘ.)