রাশেদের বাবাকে ছাত্রলীগ সভাপতির ফোন, ‘আপনার ছেলেকে গুম করে ফেলা হবে’

রাশেদের বাবাকে ছাত্রলীগ সভাপতির ফোন, ‘আপনার ছেলেকে গুম করে ফেলা হবে’

ঢাকা, ৭ জুলাই (জাস্ট নিউজ) : কোটা সংস্কার আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খানকে গ্রেফতারের আগের দিন তাকে গুম করে ফেলার হুমকি দেয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। ওই দিন রাশেদের বাবাকে ফোন করে ছাত্রলীগ সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ বলেছিলেন, ‘আপনার ছেলেকে গুম করে ফেলা হবে।’

শনিবার বিকালে রাজধানীর ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ক্র্যাব) মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই অভিযোগ করেন রাশেদের বাবা নবাই বিশ্বাস।
এ সময় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে ক্যাম্পাসগুলোতে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অতি দ্রুত গ্রেফতারকৃতদের নিঃশর্ত মুক্তি, মামলা প্রত্যাহার ও রিমান্ডে নির্যাতন বন্ধ, সরকারকে ছাত্রলীগের হামলায় আহতদের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহনের দাবি জানানো হয়। কোটা সংস্কারের প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বলেও আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে বলা হয়।

‘সারা দেশের সাধারণ শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ ও অহিংস কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রলীগের হামলা, অন্যায়ভাবে গ্রেফতার ও গুমের প্রতিবাদে নির্যাতিত পরিবারের পক্ষে’ এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন রাশেদের মা ছালেহা বেগম, রাশেদের স্ত্রী রাবেয়া আলো, বোন সোনিয়া প্রমুখ।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ‘সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’-এর যুগ্ম আহ্বায়ক আতাউল্লাহ। নিরাপত্তাজনিত কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনটি না করে ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ক্র্যাব) মিলনায়তনে করছেন বলেও জানান তারা।

এ সময় রাশেদের বাবা নবাই বিশ্বাস বলেন, ‘রাশেদকে গ্রেফতারের আগের দিন ঝিনাইদহ ছাত্রলীগের সভাপতি রানা আমার মোবাইল নম্বরের জন্য কয়েকজনকে আমাদের বাড়িতে পাঠায়। এরপর ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ আমার মোবাইলে ফোন দেয়। ফোনে আমাকে বলে- আপনি কেমন সন্তান জন্ম দিয়েছেন, সে তো একটা কুলাঙ্গার। ছেলেকে এসব থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন, না হলে গুম করে দেয়া হবে।’

মোবাইলে হুমকির পর বাড়িতে এসে হুমকি দিয়ে যাওয়ার ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এরপর আবার ১০ জন কর্মী মোটরসাইকেল নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসে। ছেলেকে ফিরিয়ে আনার জন্য আমার ঘাড় ধরে হুমকি দিয়ে যায়। পরদিন আমার ছেলেকে গ্রেফতার করা হয়।’

তবে ছাত্রলীগ সভাপতি সাইফুর রহান সোহগের কাছে পরিবারের এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি তা অস্বীকার করেন।

রাশেদের বাবা বলেন, ‘আমরা ছেলের খোঁজে শাহবাগ থানায় গেলে আমাদের দেখে তারা হাসেন। আমরা এখন পর্যন্ত রাশেদের সঙ্গে দেখা করতে পারি নাই। কোথায় আছে, কী অবস্থায় আছে, আমরা কিছুই জানি না। অনেকেই বলে, আমি নাকি জামায়াত-শিবিরের লোক, আমি নাকি রাজাকার। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল ৬ মাস। আমি একজন সাধারণ দিনমজুর, কাজ করে খাই। আমার এবং আমার পরিবারের কোনো নিরাপত্তা নেই, আমরা নিরাপত্তা চাই।’

লিখিত বক্তব্যে কোটা আন্দোলনের নেতা আতউল্লাহ বলেন, ‘হামলাকারীদের নির্যাতন ও পুলিশের আটকের ভয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতাকর্মীসহ সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের মামলা থেকে মুক্তি দিতে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের পক্ষ থেকে আমরা সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছি। অতিদ্রুত গ্রেফতারকৃতদের নিঃশর্ত মুক্তি, মামলা প্রত্যাহার ও রিমান্ডের নামে নির্যাতন বন্ধের দাবি জানাচ্ছি। ছাত্রলীগের হামলায় আহতদের চিকিৎসার ব্যয়ভার সরকারকে বহনের অনুরোধ করছি। একই সঙ্গে আর কেউ যাতে হামলার শিকার না হয়, তার নিশ্চয়তা প্রদানের দাবি জানাচ্ছি।’

লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, গত ৩০ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে পূর্বঘোষিত সংবাদ সম্মেলনে হামলা চালায় ছাত্রলীগ। সেই হামলায় গুরুতর আহত হয় বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক নুর। এছাড়া আহ্বায়ক হাসান আল মামুনসহ কেন্দ্রীয় কমিটির ৮ জন সদস্য আহত হন।

একই দিন গণগ্রন্থাগারে হামলায় আহত ও আটক হন আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক জসীম উদ্দিন আকাশ। হামলার পর ঢাকা মেডিকেলে গেলে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে পরবর্তীতে আমাদের সেখান থেকে বের করে দেয়া হয়। জানতে চাইলে বলা হয় ওপরের নির্দেশে এটা করা হয়েছে।

আহত নুরকে আনোয়ার খান মেডিকেলে প্রথমে ভর্তি করানো হলেও পরবর্তীতে মধ্যরাতে তাকে সেখান থেকে বের করে দেয়া হয়। ১ জুলাই দুপুরে পরিষদের আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খানকে ভাসানটেক থেকে গ্রেফতার করা হয়। তার সঙ্গে যুগ্ম আহ্বায়ক মাহফুজ খানকেও গ্রেফতার করা হয়। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মিথ্যা মামলায় রাশেদকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বর্তমানে রিমান্ডের নামে তাকে অত্যাচার করা হচ্ছে।

আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার আরও ঘটনা তুলে ধরে আতাউল্লাহ বলেন, ‘হামলা-মামলা ও নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে গেলে ২ জুলাই শহীদ মিনারের মতো পবিত্র জায়গায় যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক হাসানসহ ৮-১০ জনকে মেরে আহত করা হয়। এরপর ছাত্রলীগ নেতারা বাইকে করে ফারুককে শাহবাগ থানায় নিয়ে যায়।

পরবর্তীতে তাকে মোটরসাইকেল পোড়ানোর মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। সেদিন শহীদ মিনারে নারী নিপীড়নের মতো ভয়াবহ ঘটনাও ঘটে। থানায়ও সেই ছাত্রীকে নির্যাতন করা হয়।

এসব ঘটনার প্রতিবাদ করতে গেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। এতে ১০ জন আহত হয়। রামদা, হাতুড়ি ও লোহার রড দিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক তরিকুল ইসলামকে পিটিয়ে জখম করা হয়। এতে তার পায়ের হাড় ভেঙে যায়। মেরুদণ্ডহ শরীরের বিভিন্ন অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এছাড়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ ও ছাত্রলীগ শান্তিপূর্ণ মানববন্ধনে বাধা দেয়। এছাড়াও কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ব্যবহৃত ফেসবুক গ্রুপটি হ্যাক করে ফেলে দুর্বৃত্তরা।’

এক প্রশ্নের জবাবে কোটা সংস্কার আন্দোলনের এই যুগ্ম আহ্বায়ক বলেন, কোটা সংস্কারের প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। প্রজ্ঞাপন জারির পর আর কেউ আন্দোলনে যুক্ত হবেন না। তবে কোন খাতে কত শতাংশ কোটা থাকবে তা সরকার নির্ধারণ করবে।

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোটা আন্দোলনে কোনো রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা নেই। এটি সব সাধারণ শিক্ষার্থীর প্রাণের দাবি। দাবি আদায়ে শিক্ষার্থীরা নিজেদের অর্থ ও সময় দিয়ে আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। দাবি আদায় হলেই আমরা আন্দোলন থেকে সরে যাব। তখনই প্রমাণ হবে আমরা রাজনৈতিক নাকি অরাজনৈতিকভাবে আন্দোলন করেছি।

রাশেদের স্ত্রী রাবেয়া আলো বলেন, 'রাশেদ যেদিন গ্রেফতার হয়, সেদিন দুপুর ১২টার দিকে আমাকে ফোন দিয়ে বলে খাবার রেডি করতে। এদিকে আধাঘণ্টা ধরে একজন লোক ঘোরাঘুরি করতেছে এবং রাশেদকে খুঁজতেছে বলে জানতে পারি। আমি এ কথা রাশেদকে জানালে সে ভয় পেয়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পর রাশেদকে তারা টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়। তার কাপড় খুলে ফেলার মতো অবস্থা হচ্ছিল। রাশেদ বারবার ও রকম করতে না করছিল। তাদের সঙ্গে সে এমনিতেই যাবে বললেও তারা কোনো কথা শোনে নাই। তারা বলছিল- তোকে রাতে ধরলে ভালো হতো। তাকে নিয়ে যাওয়ার পর দৌড় দিয়ে থানায় যাই কিন্তু সেখানেও কিছু জানাতে পারে নাই। অথচ রাশেদকে যারা ধরে নিয়ে গেছে তাদের থানা থেকে বের হতে দেখেছি। কিন্তু ওসি সাহেব বলেছেন- উনি তাদের চেনেন না।'

রাবেয়া আরো বলেন, ‘পরেরদিন আমরা শাহবাগ থানায় যাই। সেখানে খোঁজ করতে গেলে তারা আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করে। ওসি সাহেবের রুমে অনুমতি নিয়ে ঢুকে রাশেদের কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি বলে ওঠেন- একে ঢুকতে দিছে কে? এরপর একটা কাগজ দেখায় বলেছেন- গুরুতর মামলা হয়েছে তার নামে। কিন্তু তাকে কোথায় রাখা হয়েছে কিছুই বলে নাই। শুধু জানতে পারলাম রাশেদকে কোর্টে হাজির করা হবে। সময়টাও কেউ বলে নাই। আমরা সুপ্রিমকোর্টে যাই, জজ কোর্টে যাই। পরে দেখি দুজন ডিবির লোক তাকে টেনে কোর্টে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা মানবাধিকার সংগঠনের মাধ্যমে আইনি লড়াই করে যাচ্ছি।’

ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়াসহ ২০ জন আইনজীবী বিনামূল্যে রাশেদের পক্ষে আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘গতকাল (শুক্রবার) স্যারকে (ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া) জিজ্ঞেস করলাম- ‘কী অবস্থা?’ তিনি বললেন, ‘আমাদেরও কিছু জানানো হচ্ছে না’।’’ রাশেদকে আবার কোর্টে তোলার ব্যাপারে রাবেয়া বলেন, ‘এখন শুনেছি রোববার নাকি আবার তাকে (রাশেদ) কোর্টে হাজির করা হবে কিন্তু সময় কেউ বলে না।’

রাশেদের সঙ্গে আরও একজনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘রাশেদের সঙ্গে মাহফুজকেও তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। অথচ মাহফুজেরও কোনো খোঁজ নাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তারা অথচ কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত কোনো খোঁজ নেয় নাই। আমরা রাশেদসহ গ্রেফতারকৃত সবার মুক্তি চাই। তাদের পরীক্ষা বাকি আছে, সেটা দিতে দেয়া হোক। অবিলম্বে প্রজ্ঞাপন জারি করা হোক।’ তবে সংবাদ সম্মেলনের কিছুক্ষণ পর কোটা আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন জানান, আতাউল্লাহকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। তার সন্ধান পাওয়া গেছে।

(জাস্ট নিউজ/একে/২৩৫০ঘ.)