নেপাল বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবার কত টাকা ক্ষতিপূরণ পাবে?

নেপাল বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবার কত টাকা ক্ষতিপূরণ পাবে?

ঢাকা, ৯ জুলাই (জাস্ট নিউজ) : নেপালে বিমান দুর্ঘটনার পর প্রায় চারমাস পেরিয়ে গেছে। ইতিমধ্যেই ক্ষতিপূরণের পরিমাণ এবং আন্তর্জাতিক কোন্ আইন অনুসরণ করে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে, তা নিয়ে নিহতদের পরিবার এবং ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের মধ্যে দেখা দিয়েছে মতভেদ।

ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের প্রস্তাবিত ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নিয়ে ইতিমধ্যেই অসন্তোষ জানিয়েছে নিহতদের পরিবার।

কিন্তু ক্ষতিপূরণ নিয়ে এই সংশয় কেন তৈরি হলো? এক্ষেত্রে সরকার কি বলছে?

ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন আঁখিমনি এবং মিনহাজ। বিয়ের নয়দিনের মাথায় হানিমুনে রওয়ানা হয়েছিলেন কাঠমান্ডু। ফ্লাইটটি ছিল ইউএসবাংলা ফ্লাইট ২১১।

হানিমুন করা হয়নি তাদের। বদলে লাশ ফিরেছিল তাদের।

চার মাস পর এখনো রোজ মেয়ের স্মৃতি হাতড়ে ফেরেন আঁখিমনির মা হাসিনা বেগম।

সন্তান হারানোর কষ্টের সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে আক্ষেপ ও সংশয়। ইউএস বাংলা কর্তৃপক্ষ উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেবে তো?

"আমরা কি পাব আর পাব না কিছুই বুঝতেছিনা। আমাদের কিছুই জানানো হচ্ছে না। ইউএস বাংলাকে ফোন করলে তারা কিচ্ছুই বলতে পারেনা।"

ঐ দুর্ঘটনায় বিমানের ক্রু-মেম্বারসহ মোট ৭১ জন যাত্রীর ৫১ জনই নিহত হয়েছিলেন। বাংলাদেশী নিহত হয়েছিলেন মোট ২৭ জন। নিহতদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ছিল নেপালের নাগরিক।

সোয়েতা থাপা বাংলাদেশে এসেছিলেন ডাক্তারি পড়তে। ছুটিতে নেপালি বন্ধুদের সাথে বাড়ি ফিরছিলেন। সোয়েতাও তার মায়ের কাছে আজ স্মৃতি।

ক্ষতিপূরণ প্রশ্নেও দেখা যাচ্ছে সোয়েতার মায়ের রয়েছে অভিন্ন অভিজ্ঞতা

"এখনো পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ হিসেবে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আমি একটি পয়সাও পাইনি। আমি এমনকি জানিও না ক্ষতিপূরণ পাবার প্রক্রিয়ায় কোন অগ্রগতি আছে কি না। একবার ইউএস বাংলা কর্তৃপক্ষ আমাদের ডেকেছিল, কিন্তু খুব খারাপ ব্যবহার করেছিল।"

"আমার মেয়েকে আমি ডাক্তার বানাতে চেয়েছিলাম যাতে সে দেশের সেবা করতে পারে, কিন্তু এখন আমাদের সমস্যা সমাধানে আমাদের দেশ এগিয়ে আসছে না। সরকারী কর্মকর্তারা আমাদের অধিকারের ব্যপারে একটি কথাও বলছে না।"

আরো যেসব নেপালি নাগরিক এই দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে তাদের অনেকের পরিবারের সাথেও কথা বলেছে বিবিসি এবং তাদের তরফ থেকেও একই ধরণের অভিযোগ আসছে।

বাংলাদেশে এ ধরণের বিমান দুর্ঘটনার ঘটনা বিরল। সর্বশেষটি ঘটেছিল ১৯৮৪ সালে, যে কারণে বিমান দুর্ঘটনায় হতাহতদের ক্ষতিপূরণের বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা নেই অনেকেরই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের শিক্ষক বেনজীর ইমাম মজুমদার বলছেন, "বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাংলাদেশে দুটি আন্তর্জাতিক আইনের ধারা অনুসরণ করা হয়।

একটি ওয়ারশ কনভেনশন এবং অপরটি মন্ট্রিয়েল কনভেনশন। বাংলাদেশ দুটি কনভেনশনই সই করেছে। কিন্তু নেপাল কেবল ওয়ারশ কনভেনশন সই করেছে।"

"বাংলাদেশ ১৯৯৯ সালে মন্ট্রিয়েল কনভেনশনে সই করলেও, সেটি সংসদে র‍্যাটিফাই বা আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়া হয়নি।

ফলে নিহত হয়েছেন যারা ক্ষতিপূরণ হিসেবে তাদের বাংলাদেশী টাকায় ৩৮ লক্ষ টাকার মত আসে। কিন্তু মন্ট্রিয়েল কনভেনশন অনুযায়ী অর্থের পরিমাণ হতো এক কোটির টাকার বেশি।"

"এখন হতাহত পরিবার যদি এই ক্ষতিপূরণে সম্মত না হয়, তাহলে বিষয়টি আদালত নিষ্পত্তি করবে।"

বিষয়টি নিয়ে ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের প্রধান নির্বাহী ইমরান আসিফের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ইউএসবাংলা দুর্ঘটনায় হতাহতদের পরিবারের তরফ থেকে এই যে অভিযোগগুলো আসছে, সে নিয়ে তার বক্তব্য কি?

"এখানে জুরিসডিকসনের একটি ইস্যু ছিল যে, কোন জুরিসডিকসন থেকে আমরা ইনস্যুরেন্সের ক্লেইম সেটেল করব। এখানে আইনি একটা প্রক্রিয়া আছে, আর রাতারাতি তো সেটা করা যাচ্ছে না।

আমাদের দেশের কিছু আইনি জটিলতা আছে, সেগুলো সলভ করে আগামী মাসখানেকের মধ্যে আমরা আশা করছি ক্ষতিপূরণের অর্থ প্রদান শেষ হবে।"

সেক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ হিসেবে একেকজন নিহত ব্যক্তির পরিবার ঠিক কত টাকা পাবে?

"ওয়ারশ কনভেনশনে এ বিষয়ে যে নিয়ম বলা আছে, সেটাই অনুসরণ করছেন আমাদের ইন্সুরাররা। এতে প্রতিজন নিহত যাত্রী তিনি যে দেশেরই হোন না কেন, পাবেন ৫০ হাজার মার্কিন ডলার। আহতদের ক্ষেত্রে এটা ভিন্ন রকম হবে।"

কিন্তু নেপালে নিহতদের পরিবারগুলো একটি অ্যাসোসিয়েশন গঠন করে বলছে, তারা প্রস্তাবিত ক্ষতিপূরণের অংক মেনে নিতে নারাজ।

আর বাংলাদেশে নিহতদের পরিবারগুলো বলছে, মন্ট্রিয়েল কনভেনশনের ধারা অনুযায়ী প্রত্যেক নিহতের পরিবারের সোয়া লাখ সুইস ফ্রাঁর সমপরিমাণ বাংলাদেশী টাকা পাওয়া উচিত, যে কনভেনশনে বাংলাদেশ একটি স্বাক্ষরকারী দেশ।

কিন্তু দেখা যাচ্ছে ওয়ারশ এবং মন্ট্রিয়েল দুটি কনভেনশনে সই করার পর বহু বছর পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশের সংসদ এখনো এগুলোকে স্বীকৃতি দেয়নি, যে সুযোগটাই কাজে লাগাতে চাইছে ইউএসবাংলা।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন সচিব মোহাম্মদ মহিবুল হক বলছেন, বাংলাদেশে মন্ট্রিয়েল কনভেনশন স্বাক্ষর করার পর সে অনুযায়ী কোন আইন বানানো হয়নি। কিন্তু এখন সরকার নতুন একটি আইন করতে যাচ্ছে।

"নেপাল দুর্ঘটনার পর সবাই সচেতন হয়েছে, আমরাও সচেতন হয়েছি। এখন 'আকাশ পথে পরিবহন আইন' নামে আমরা একটা নতুন আইন করতে যাচ্ছি। যা পাস হলে নিহতদের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ যথাযথ করতে বাধা থাকবে না।"

"কিন্তু এই আইনের সুফল নেপাল দুর্ঘটনার ক্ষতিগ্রস্তরা পাবেন না। কারণ এই আইনটি পাস হতেও কয়েক মাস সময় লাগবে।"

দেখা যাচ্ছে, সরকারের গাফিলতির কারণে এই পরিবারগুলো আকাঙ্ক্ষিত ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে না, যা তাদের স্বজন হারানোর কষ্ট কমাতে না পারলেও, কিছুটা স্বস্তি দিতে পারতো। সূত্র: বিবিসি

(জাস্ট নিউজ/ডেস্ক/একে/২৩০৭ঘ.)