উৎপলের পর ফিরলেন মোবাশ্বার, সন্দেহ রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দিকে

উৎপলের পর ফিরলেন মোবাশ্বার, সন্দেহ রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দিকে

ঢাকা, ২২ ডিসেম্বর (জাস্ট নিউজ) : সাংবাদিক উৎপল ফিরে আসার তিন দিন পর, ফিরে এলেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষক মোবাশ্বার হাসান সিজার। ৭ নভেম্বর নিখোঁজ হওয়ার ৪৪ দিন পর বৃহস্পতিবার রাত ১টার দিকে দক্ষিণ বনশ্রীতে নিজের বাসায় ফিরে আসেন তিনি।

দীর্ঘ দু'মাস ১০ দিন নিখোঁজ থাকার পর মঙ্গলবার ফিরে আসেন সাংবাদিক উৎপল। ফিরে এসে তিনি বলেন, অপহরণকারীরা তার কাছে টাকা চেয়েছিল। আড়াই মাস নিখোঁজ থাকা উৎপলকে একটি মাইক্রোবাসে করে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সিএনজি ফিলিং স্টেশনে রেখে যাওয়া হয়েছিল। এ ঘটনার তিন দিন পর, বাড়ি ফিরে সিজারও একই কথা বলেছেন। তিনি জানান, তাকেও বৃহস্পতিবার রাতে চোখ বেঁধে একটি মাইক্রোবাসে করে ঢাকা বিমানবন্দর এলাকায় নামিয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে নিজেই বাসায় ফেরেন তিনি।

বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, কোন ফৌজদারি অপরাধী তাদের তুলে নিয়ে গেলে দাবি-দাওয়ার বিষয় থাকত। কিন্তু এখানে কোনো ধরনের মুক্তিপণ বা অপরাধীদের চাহিদা পূরণ করা ছাড়াই তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ এখানে কোনো লেনদেন হয়নি। একজন অপরাধী কাউকে তুলে নিয়ে গিয়ে কিছু প্রাপ্তি ছাড়াই দীর্ঘ সময় রেখে আবার ফেরত দিচ্ছে, সেটা তো হতে পারে না। আবার রাষ্ট্রীয় বাহিনী তাঁদের খুঁজে পাচ্ছে না, সেটাই বা কীভাবে সম্ভব? তাই এখন রাষ্ট্রীয় বাহিনীকেই আমাদের সন্দেহ হচ্ছে। রাষ্ট্রকেই এখন প্রমাণ করতে হবে যে তারা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত না। না হলে মানুষের মনের মধ্যে একটা সন্দেহ থেকেই যাবে, যেটা রাষ্ট্রের জন্য ভালো হবে না।

মোবাশ্বার যা বললেন

ফিরে আসার পর মোবাশ্বার হাসান সিজার শুক্রবার সকালে বাসার নীচেই সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। সেখানে তিনি বলেন, আমাকে টাকার জন্য অপহরণ করা হয়ে থাকতে পারে বলে মনে হচ্ছে। কারণ আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আমার পরিচিত কেউ আছে কিনা যে টাকা দিতে পারবেন। তবে আমার কাছে সরাসরি কেউ টাকা চায়নি। ওদের (পরিবারের সদস্যদের) কাছে টাকা চেয়েছে। যেখানে রাখা হয়েছিল, সেখানে টাকা-পয়সা নিয়ে কথা হয়েছিল জানিয়ে মোবাশ্বার আরো বলেন, তারা (যারা তাকে আটকে রেখেছিল) ‘কনভারসেশন' করেছে টাকা-পয়সা নিয়ে। আমার কাছে ২৭ হাজার টাকা ছিল, সেটা তারা নিয়ে নিয়েছে। তবে একটা জিনিস নিয়ে তাদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা ছিল – আমাকে ছাড়বে নাকি মারবে তা নিয়ে। তাদের কেউ একজন মিসিং ছিল, আমি ঠিক জানি না, যেটা নিয়ে ভয়ে ছিল তারা। এছাড়া তাদের মধ্যে অনেক ধরনের ‘ডিসকাসন' হয়েছে।

অপহরণের দিনের (৭ নভেম্বর) বর্ণনা দিয়ে মোবাশ্বার বলেন, আমি আগারগাঁওয়ের ইউএনডিপি ভবন থেকে বের হয়ে উবার নিয়ে রোকেয়া সরণির দিকে যাওয়ার সময় মোবাইলে ‘ব্রাউজ' করছিলাম। তখন কয়েকজন গাড়িটা থামায়। বলে, এটা চোরাই গাড়ি, নামেন। নেমে আমি পেছনে অন্য কোনো গাড়ি খুঁজছিলাম। তখন পেছন থেকে কেউ একজন আমার চোখে কিছু একটা মাখিয়ে দেয়। তারপর ধাক্কা দিয়ে একটা গাড়িতে তোলে এবং একটা কাপড় আমার মুখে ধরে। তখন আমি ‘সেন্স' হারাই। এরপর অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি, আমি একটা অন্ধকার রুমে বন্দি, পেছনে হাত বাঁধা। ময়লা একটা তোষক, ঘরের জানালা আছে কিন্তু বাইরে থেকে সিল করা। পাশে আরেকটা রুম আছে। চার-পাঁচজন কথা বলত, শুনতে পেতাম। হোটেল থেকে ঠান্ডা খাবার দিত খাওয়ার জন্য। আজ অনেকদিন পর দিনের আলো দেখলাম।

ফিরে আসার প্রসঙ্গে মোবাশ্বার বলেন, তারা আমাকে একটা গাড়ির মধ্যে বসায়। এক থেকে দেড় ঘণ্টা গাড়িটা চলে। চোখ গামছা দিয়ে বাঁধা ছিল। পুরো সময়টা আমাকে একজনের কোলে শুইয়ে রেখেছিল তারা। তারপর একসময় নামিয়ে দিয়ে বলে, তুই চলে যা। পেছনে তাকালে মেরে ফেলবো। নেমে দেখি এয়ারপোর্ট রোড। ওখান থেকে একটা সিএনজি নিয়ে বাসায় আসি। আমার কাছে কোনো টাকা ছিল না। সিএনজিওয়ালার ফোন থেকে বাবাকে ফোন দিয়েছিলাম। বাবা গেট খুলে পাঁচশ' টাকা নিয়ে এসে সিএনজিওয়ালাকে দেন।

মোবাশ্বারের বোন তামান্না তাসমিন ঐ সময় উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, আমার ভাই ফিরে এসেছে, আমরা এতেই খুশি। আমাদের কোনো প্রশ্ন নেই, কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন ডয়চে ভেলেকে বলেন, আমরা মানবাধিকার কর্মীরা বারবার বলছি, যারা নিয়ে যাচ্ছে আবার দু-তিন মাস পর ফিরিয়ে দিচ্ছে, তারা যদি রাষ্ট্রীয় বাহিনী না হয় তাহলে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর চেয়ে শক্তিশালী। এরা সুরক্ষিতভাবে রাখছে, আবার ফেরত দিচ্ছে। যারা ফিরে এসেছেন, তাদের একজনকেও তো রাষ্ট্রীয় বাহিনীর তৎপরতার কারণে ফিরিয়ে দেয়নি। যারা নিয়েছে তারা স্বেচ্ছায় ফিরিয়ে দিয়েছে। ফলে যারা রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে তাদের ব্যাপারে রাষ্ট্র চুপ কেন? রাষ্ট্রকেই কিন্তু এখন এ ব্যাপারে জবাব দিতে হবে।

রহস্যজনক ‘নিখোঁজের' তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ‘নিখোঁজ' হয়ে যাওয়ার তালিকা ক্রমশই লম্বা হচ্ছে। বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বৃহস্পতিবার একটি টুইট করেছেন। সেখানে তিনি দাবি করেন, গত ১০ বছরে ৭৫০ জনকে গুম করেছে সরকারি বাহিনী। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, নিখোঁজদের একটি অংশ পরিবারকে না বলেই জঙ্গি কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট হয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছে। তবে এ সব ঘটনায় যে জিডি করা হয়, তার তদন্ত কাজ এগোয় না।

গত বছরের ১ ডিসেম্বর রাজধানীর বনানী এলাকা থেকে একযোগে চারজন তরুণ নিখোঁজ হন। তারা হলেন – সাফায়েত হোসেন, জায়েন হোসেন খান পাভেল, সুজন ঘরামি ও মেহেদী হাওলাদার। এদের মধ্যে সাফায়েত ও পাভেল নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী। পরবর্তীতে ১৮ এপ্রিল মেহেদী হাওলাদার ও ২৮ মে সুজন ঘরামি ফিরে আসেন। তাদের ফিরে আসার বিষয়টিও রহস্যজনক। তারা কীভাবে ফিরে এসেছেন, এতদিন কোথায় ছিলেন, কারা তাদের ধরে নিয়েছিল – এমন সব প্রশ্নের সদুত্তর পরিবারের কাছ থেকে মেলেনি। ঐ বছরের ৩০ নভেম্বর ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থানার মাটিকাটা এলাকা থেকে কেয়ার মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ইমরান ফরহাদ ও ৫ ডিসেম্বর বনানী এলাকা থেকে সাঈদ আনোয়ার খান নিখোঁজ হন। এমন অন্তত দুই শতাধিক মানুষ এখনো নিখোঁজ রয়েছেন বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হিসাব থেকে জানা যায়। সূত্র: ডয়চে ভেলে

(জাস্ট নিউজ/ডেস্ক/একে/২০৪৫ঘ.)