যা শিখিয়ে গেলেন তারা

যা শিখিয়ে গেলেন তারা

ঢাকা, ৮ আগস্ট (জাস্ট নিউজ) : ২৯ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের হাতে ছিল সড়ক পরিবহণ ব্যবস্থা৷ এর মাধ্যমে তারা দেশবাসীকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে হয়৷ এখন সবার উচিত তাদের দেখানো পথেই হাঁটা৷

২৯ জুলাই দুপুরে ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের অদূরে বিমানবন্দর সড়কে (র‌্যাডিসন হোটেলের উলটো দিকে) বাসচাপায় রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দু'জন শিক্ষার্থী নিহত হন৷ দুপুর সাড়ে ১২টায় বিমানবন্দর সড়কের বাঁ-পাশে বাসের জন্য অপেক্ষা করার সময় জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাস তাদের চাপা দিলে এ ঘটনা ঘটে৷ নিহতরা হলেন – দিয়া খানম মীম ও আব্দুল করিম৷ এরপর থেকেই ঢাকার স্কুল কলেজেরশিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসেন৷শুধু ঢাকা নয়, ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামসহ আরো অনেক শহরে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে৷ ৫ আগস্টের পরে অবশ্য শিক্ষার্থীরা সড়ক থেকে উঠে যান৷ ফিরে যান ক্লাসে৷ অবশ্য তাদের ফিরে যেতে সরকারের পক্ষ থেকে যেমন আহ্বান ছিল, ছিল চাপও৷ এরপর তাদের সমর্থনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় ছিলেন৷ তারাও হামলার শিকার হন, হয় সংঘাত৷

স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনের শেষ দু'দিন সায়েন্স ল্যাবরেটরি, জিগাতলা এবং ধানমন্ডি এলাকায় হামলার শিকার হন শিক্ষার্থীরা৷ প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সাভানেত্রী শেখ হাসিনার ধানমন্ডি রাজনৈতিক কার্যলয়ও ভাঙচুর করা হয়৷

শিক্ষার্থীরা সড়ক নিরপদ করতে গিয়ে সড়ক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিজেদের কাধে তুলে নেন৷ তারা গাড়ির কাগজপত্র, ফিটসেন পরীক্ষা করেন, পরীক্ষা করেন ড্রাইভিং লাইসেন্স৷ একইসঙ্গে সড়কে তারা জরুরি লেন চালু করেন অ্যাম্বুলেন্সসহ জরুরি সেবার যানবাহনের জন্য৷ একই সড়কে রিক্সা, ভারী ও হালকা যানবাহনের জন্য আলাদা আলাদা লেন চালু করেন তারা৷ এই আট দিনে তারা দেখিয়েছেন কীভাবে সমতার নীতিতে আইন প্রয়োগ করতে হয়৷ তাদের হাতে পুলিশ, প্রশাসন, বিচারক, মন্ত্রী-এমপিদের গাড়িও আটক হয় বৈধ কাগপত্র বা চালকের বৈধ লাইসেন্স না থাকায়৷ তারা এ সব গাড়ি আটক করে কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশের হাতে তুলে দেন৷ পুলিশ মামলা করে৷ তবে তাদের এই কাজে কিছু জায়গায় বাড়াবাড়ির অভিযোগও পাওয়া গেছে৷ তারপরও তাদের এই কাজকে সাধারণ মানুষ স্বাগত জানায়৷ অভিভাবকরা থাকেন পাশে৷

মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূল খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের সড়ক ব্যবস্থাপনা যে কতটা ভেঙে পড়েছিল, এই শিশুরা তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে৷ তারা দেখিয়েছে আইন কীভাবে প্রয়োগ করতে হয়৷ আমাদের এখন উচিত হবে, তারা যে বিষয়গুলো দেখিয়েছে সেই অনুযায়ী সড়ক ব্যবস্থাপনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া৷’’

তিনি বলেন, ‘‘সড়ক দুর্ঘটনা ও সড়ক ব্যবস্থাপনার আইন এখন মেরামত করতে হবে৷ যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে, তা সংশোধন করতে হবে৷ এটা সমাজের মানুষের যাতে কাজে আসে এবং দুর্ঘটনা যাতে কমে আসে, সেই দিকটি নিশ্চিত করতে হবে৷’’

তিনি আরো বলেন, ‘‘পুরো পরিবহণ সেক্টরকে সিন্ডিকেটের হাত থেকে বাইরে নিয়ে আসতে হবে৷ পরিবহণ মাস্তান নয়, পরিবহণ সেক্টরে সত্যিকারের ট্রেড ইউনিয়ন চালু করতে হবে৷’’

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘রাস্তায় কীভাবে চলতে হয় এবং পরিবহণ খাতে কীভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করতে হয়, তা আমাদের শিক্ষার্থীরা দেখিয়ে দিল৷’’

তিনি বলেন, ‘‘পরিবহণ খাতে নৈরাজ্য চলছিল৷ তবে এখন সুশাসন প্রতিষ্ঠার সময় এসেছে৷ বাস কোম্পানিগুলোকে আইনের আওতায় আনতে হবে৷ চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে৷ তাদের চুক্তিভিত্তিক নয়, বেতনের আওতায় আনতে হবে৷ তাহলে প্রতিযোগিতার মাধমে বেপরোয়া ড্রাইভিং কমবে৷ এছাড়া সড়ক ব্যবহারকারী হিসেবে যাত্রী এবং পথচারীদের সচেতন হতে হবে৷ আইন মানতে হবে সবাইকে৷’’

গত ২৫ বছরে নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলন করছেন চিত্রনায়ক ইলিয়াম কাঞ্চন৷ তাঁর আন্দোলনের নাম ‘নিরাপদ সড়ক চাই'৷ ইলিয়াস কাঞ্চন ডয়চে ভেলেকে জানালেন, ‘‘বাচ্চারা আমাদের দেখিয়েছে যে আমরা, এ দেশের মানুষরা, কেউই আইন মানি না৷ আমাদের যাদের ক্ষমতা আছে, তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করি শুধু৷ আইন যাঁদের হাতে, যাঁরা আইন প্রয়োগ করেন, তাঁরাও আইন মানেন না৷ সাধারণ মানুষ, চালকদের কথা না হয় বাদই দিলাম৷’’

তাঁর কথায়, ‘‘২৫ বছর ধরে আমি যে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করে আসছি, সেটা যে মানুষের প্রাণের দাবি – তা এই ছেলেমেয়ারা প্রমাণ করে দিল৷’’

নতুন সড়ক পরিবহণ আইন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘পরিবহণ আইনের সঙ্গে সড়ক নিরপত্তা বিষয়টি যুক্ত করতে হবে৷ তা না হলে আইনটি পূর্নাঙ্গ হবে না৷ চালকদের শাস্তি আছে, কিন্তু মালিকদের জরিমানা থাকলেও কোনো শাস্তি নেই৷ কোনো মালিক যদি অপ্রাপ্তবয়স্ক বা ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই – এমন কাউকে ড্রাইভার হিসেবে নিয়োগ দেন, তাহলে দায় কার? ওই ড্রাইভারের কারণে যদি কারুর মৃত্যু হয়, তার জন্য তো মালিকেরও শাস্তি হওয়া দরকার৷’’

তিনি বলেন, ‘‘পরিবহণ ও সড়ক নিরাপত্তার সাথে অনেক বিষয় এবং মন্ত্রণালয় জড়িত৷ সবগুলোকে আইনের আওতায় আনতে হবে৷ শুধু চালকদের দায়ী করার কোনো মানে হয় না৷’’

এদিকে সরকার এরইমধ্যে নতুন আইনসহ আরো কিছু কাজ শুরু করে দিয়েছে৷ শুরু হয়েছে বিশেষ ট্রাফিক সপ্তাহ৷ লাইসেন্সবিহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে অভিযান৷ গাড়ির কাগজপত্র ঠিক করতে এখন বিআরটিএ-তে লম্বা লাইন পড়ছে৷ ঢাকার স্কুল-কলেজের সামনে স্পিড ব্রেকার ও জেব্রা ক্রসিং-এর কাজ শুরু হয়েছে৷

পরিবহণ মালিক সমিতি বুধবার এক জরুরি বৈঠক করে চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালানোর নিয়ম বাতিল করেছে৷ অর্থাৎ এখন থেকে চালক ও বাসের অন্যান্য কর্মচারীরা মাসিক বেতন পাবেন৷ বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হবে গাড়ির কাগজপত্র পরীক্ষা করার কাজ৷

(জাস্ট নিউজ/ডেস্ক/একে/২১১৭ঘ.)