ড. আলী রীয়াজের বিশ্লেষণ

যুক্তরাষ্ট্র, ইরান, ইরাক: সবশেষ পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ

যুক্তরাষ্ট্র, ইরান, ইরাক: সবশেষ পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ

গোটা মধ্যপ্রাচ্যে, উপসাগরীয় অঞ্চলে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ইরাকে ইরানের প্রভাব বেড়েছে এবং এটা বাড়তে থাকবে। এখন দু’পক্ষই স্টেপ ব্যাক করবে। কিন্তু যা ক্ষতি হওয়ার তা কিন্তু হয়ে গেছে। এই ক্ষতিগুলোর দায় কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রকে নিতে হবে। এমন মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ড. আলী রীয়াজ। তিনি ভয়েস অব আমেরিকার সঙ্গে এ নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, এখন পর্যন্ত আমরা দেখতে পাচ্ছি, কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার পর যুক্তরাষ্ট্র যে সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, তার অন্যতম বিষয় হচ্ছে- ওই এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের যে সমস্ত সৈন্য আছে তাদেরকে সম্পূর্ণ সতর্কতার মধ্যে রাখা হয়েছে। যে সমস্ত ঘাঁটি রয়েছে, বিশেষ করে ইরাকে যেসব ঘাঁটি রয়েছে, সেগুলোতে বড় ধরণের সতর্কতা পালন করা হচ্ছে। ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের ২টি ঘাঁটিতে মিসাইল নিক্ষেপ করেছে ইরান।

ইরানের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এটা একটা ‘প্রোপোসনেট রেসপন্স’ এবং তারা কোনরকম যুদ্ধ চায় না। কিন্তু তারা তাদের জেনারেল কাসেম সোলাইমানির হত্যার প্রত্যুত্তর দিয়েছেন। এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি তো ওই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। দু’পক্ষই আসলে এক ধরণের উত্তেজনার মধ্যে আছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পদক্ষেপটা কে নেবে প্রথম অর্থ্যাৎ যদি যুদ্ধপরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তাহলে যুদ্ধের দিকে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে কার পদক্ষেপটা প্রথম হবে। আমার যেটা ধারণা সেটা হচ্ছে এই যে, ইরান এই মূহুর্তে কোন যুদ্ধের মধ্যে যেতে চাইবে না। প্রত্যক্ষ যুদ্ধে যাওয়ার আগ্রহ, উৎসাহ কিংবা সক্ষমতা কোনটাই আসলে ইরানের নেই এবং ইরানের জন্য সেটা আত্মঘাতীও হবে। ইরান সেটা চাইবে না। ইরানের জন্য কূটনৈতিকভাবেও সেটা খুব ইতিবাচক পদক্ষেপ নয়।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কি পদক্ষেপ নেয়া হবে সেটা খানিকটা ফ্লুইড। ফ্লুইড এই কারণে যে, ট্রাম্পের আসলে ফরেন পলিসির যে ইতিহাস তার ওপর ভিত্তি করে আমরা নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারবো না। আমরা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বক্তব্যের জন্য অপেক্ষা করছি তার কারণটা হচ্ছে এই যে, আপনি আসলে কিছুই অনুমান করতে পারছেন না। তবে আমার ধারণা যে, মি. ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত দেশকে এই ধরণের যুদ্ধপরিস্থিতির দিকে নিয়ে যেতে পারবেন না। আমি পারবেন না কথাটার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি এই কারণে যে, তার ওপরও বিভিন্ন রকমের চাপ আছে। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ ছাড়াও রাজনৈতিক চাপ আছে। তিনি সে সমস্ত চাপ কতটা মানবেন তা নিয়ে সংশয় থাকে। কিন্তু আমার মনে হয় না যে, এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিকদের একটা যুদ্ধপরিস্থিতি বা যুদ্ধে যাওয়ার মতো এপেটাইট আছে। মি. ট্রাম্প তার যে বেইজ তিনি তাদের কখনোই বুঝাতে পারবেন না যে, কেন তিনি এই যুদ্ধে যাচ্ছেন।

পুরো ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে আসলে আজকে নয়। প্রথম কথা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের প্রতি আগ্রাসী মনোভাব অতীতে পালন করেছে, তার চেয়ে বেশি করেছে আসলে ট্রাম্পের প্রশাসন আসার পর। ইরানের সঙ্গে যে পারমানবিক চুক্তি ছিলো, আন্তর্জাতিক পারমাণবিক চুক্তি। অনেক আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে দু’পক্ষ ছাড় দিয়ে তৈরি করেছিলো (এই চুক্তি)। মি. ট্রাম্প লেটার‌্যালি সেখান থেকে ফেরত এসছেন। তার সঙ্গে যদি ইউরোপিয়ান এলায়েন্সরা থাকেন তার মানে কি সাইকেলটা সেখান থেকে শুরু করবেন? চ্যালেঞ্জটা তো আসলে যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে করেছে। বাদ দিন এই প্রসঙ্গ, আমরা অতোদূর পেছনে যাবো না। ধরুন ঘটনাটার এই সাইকেলের সূত্রপাতটা কোথায়? এই সাইকেলের সূত্রপাতটা হচ্ছে কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার মাধ্যমে।

যদি তাই হয়, ধরুন, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের একজন শীর্ষ পর্যায়ের সামরিক চ্যানেল, টেরোরিস্ট নয়, আপনি যেভাবেই বলেন, আমি কাসেম সোলাইমানির রেকর্ড জানি, কাসেম সোলাইমানি ওই অঞ্চলে কি ধরণের প্রভাব বিস্তার করেছেন, বিভিন্ন রকম মিলিশিয়ার প্রতি তার সমর্থন, তার সাহায্য সবই আমি বিবেচনায় নেবো। কিন্তু এটাও বিবেচনায় নিতে হবে যে, কাসেম সোলাইমানি হচ্ছে ইরানের সেনাবাহিনীর একজন চ্যানেল। আপনি তাকে এসোসিনেট করতে পারেন না। তার অপরাধ আছে, আমি তাকে এক্সোনারেট করছি না। তাহলে সাইকেলটা হচ্ছে- ইরান চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়নি, যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে চ্যালেঞ্জ করেছে প্রথম। এবং ইরান আসলে রিটালিয়েট করছে। রিটালিয়েট করছে ইন এভারিলেশেন রিটালিয়েট হয়েছে।

ইরান ইরাকের মধ্যে যে মিসাইল আক্রমণ করেছে, তা দিয়ে কি ক্ষতি করতে চেয়েছে নাকি দেখাতে চেয়েছে যে, এই পর্যন্ত তার রেঞ্জটা আছে। রেঞ্জ যদি তার এই পর্যন্ত থাকে ইরাকের ভেতরে, তাহলে কিন্তু হাইপা পর্যন্তও থাকে। এবং মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের যেসমস্ত এলাইয়েন্স আছে তাদের পর্যন্তও আছে। ইরান যেটা বলেছে যে, যদি ইরান আক্রান্ত হয় তাহলে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নয়, যুক্তরাষ্ট্রের এলায়েন্স যারা, যারা তাদের মিত্র তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে। এটা সে দেখাতে চেয়েছে। ফলে আসলে আমার মনে হয় না যে, হামলায় ইরান আসলে ক্যাজুয়ালিটি খুঁজছিলো। আসলে তার রেঞ্জটা দেখাতে চেয়েছিলো।

জেনারেল সোলাইমানির কার্যক্রম সম্পর্কে সংশয় সন্দেহ, অভিযোগ আছে এবং অবশ্যই আছে, সেগুলোর কারণও আছে, এমনকি তার যারা সমর্থক তাকে যারা বীর মনে করেন, সমরাধিনায়ক মনে করেন তারাও তো এটা স্বীকার করেন যে, আসলে সোলাইমানির প্রভাব গোটা অঞ্চলেই ছিলো। পারস্য উপসাগরীয় এলাকায় বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে তার সংযুক্তি ছিলো, সমর্থন ছিলো, সহযোগিতা ছিলো। এগুলো অবশ্যই আপত্তিকর, এগুলো অবশ্যই অগ্রহণযোগ্য, কেনো একজন ইরানিয়ান জেনারেলের প্রভাব এতোটা থাকবে। কিন্তু এটাও আপনাকে মনে রাখতে হবে যে, এই সোলাইমানির সঙ্গে আইসিস মোকাবেলার সময় যুক্তরাষ্ট্রের একধরণের সহযোগিতার সম্পর্কও ছিলো। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে যেটা- এগুলি কেউই অগ্রহণ করছেন না। প্রেসিডেন্ট ট্র্যাম্প যেটা বলছেন যে, সোলাইমানির বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, অবশ্যই অভিযোগ আছে, কিন্তু তা এই বৈধতা দেয় না যে, যুক্তরাষ্ট্র কোনরকম এসাসিনেশনে যুক্ত হবে।

ইরাক তো থিয়েটার অব ওয়ার হবে যদি শেষ পর্যন্ত কোন যুদ্ধ হয়- যেটা আমরা ইতিমধ্যে দেখতে পেয়েছি। যেমন ধরুন, যুক্তরাষ্ট্র যখন কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করে যেটা ইরাকের মাটিতে। এটা ভায়োলেশন অব সোভারেনটি। আবার ইরান যখন ইরাকের যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিতে আক্রমণ করে সেটাও ইক্যুয়ালি। একেবারে সম পরিমাণে ভায়োলেশন অব সভেরেনটি অব ইরাক। ইরাকের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে চুক্তি আছে, যার আওতায় যুক্তরাষ্ট্র সেখানে উপস্থিত আছে, তার ভেতরেও এরকম কোন উপায় নেই যে, যুক্তরাষ্ট্র চাইলেই কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করতে পারে। ফলে ইরান এখন পর্যন্ত কোন আগ্রাসী ভূমিকা নেয়নি।

মিসাইল যেগুলো মেরেছে যেটা আমি আগেও বলেছি আমার ধারনা এবং এখন পর্যন্ত যে তথ্য তাতে আমার মনে না, খুব হাই ক্যাজুয়ালটি ড্যামেজ করার জন্য, এটা মোরাললেস একটা মেসেজ দেয়ার জন্য যে, উই আর ক্যাপেবল অফ ইট- এই রকম কথাবার্তা। কিন্তু একটা পুরোনো প্রসঙ্গ তুলি, প্রসঙ্গটা হচ্ছে- প্রেসিডেন্ট টাম্প বলেছেন যে, ইরান সাম্প্রতিককালে ১৫০০ লোককে হত্যা করেছে ইরানে আন্দোলনে। সেটা ইরাকেও ছিলো। দেখুন এই কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার ঘটনা না ঘটলে ইরানের অভ্যন্তরে যে সরকার বিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধছিলো এখন সেটার সম্পূর্ণভাবে তিরোহিত হয়েছে। একমাত্র কারণ, একমাত্র দায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। অন্যদিকে ১৯৭৯ সালের পরে এতোবড় গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয়নি।

এই আন্দোলনের মুখে এই ধরণের একটা ঘটনা এক ধরণের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রবণতা তৈরি করেছে। তার মানে কি? ইরানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বা গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের প্রক্রিয়া বন্ধ করার কাজটি করলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। আপনি যাই বলুন না কেনো যে, ইরানে ১৫০০ লোক হত্যা করেছে, ইরানের শাসকরা দায়ি, কিন্তু ঘটনা তো তাই। একই বিষয় দেখুন, একই সময়ে ইরাকের যে আন্দোলনটা হচ্ছিলো তার একটা এলিমেন্ট ছিলো যে, ইরাকের ভেতরে ইরানের প্রভাব এতো বেশি যে তা কমানোর কথা বলা হচ্ছিলো। এখন এই পুরো প্রক্রিয়ার কারণে যেটা হয়েছে, গোটা মধ্যপ্রাচ্যে, উপসাগরীয় অঞ্চলে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ইরাকে ইরানের প্রভাব বেড়েছে এবং এটা বাড়তে থাকবে। এখন দু’পক্ষই স্টেপ ব্যাক করবে কিন্তু যা ক্ষতি হওয়ার ক্ষতি কিন্তু হয়ে গেছে। ইরানের ভেতরে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে ক্ষতি হয়ে গেলো, ইরাকের ভেতরে একটা ক্ষতি হয়ে গেলো।

এই ক্ষতিগুলোর দায় কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রকে নিতে হবে। এবং এটা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিবাচক কোনরকম ইমেজ তৈরি করবে না মধ্যপ্রাচ্যে। এখন অভ্যন্তরীন রাজনীতির কারণে হচ্ছে কিনা সেটা আমরা অনুমান করতে পারি কেবলমাত্র। এর বাইরে কিছু নয়। তবে আমার ধারণা, খুব বেশি লাভ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পাবেন না। রাজিৈনতকভাবে পাবেন বলে আমি মনে করি না।