বিশ্লেষণ

ঐক্যফ্রন্ট এখন ভারতের-চীনের সম্ভাব্য বিকল্প

ঐক্যফ্রন্ট এখন ভারতের-চীনের সম্ভাব্য বিকল্প

বিএনপির চার সদস্যের একটি দল এ সপ্তাহে চীন গেছেন চার দিনের জন্য। দলে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন টুকু, যিনি বিএনপির সর্বশেষ সরকারে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। চীনের কম্যুনিস্ট পার্টির নিমন্ত্রণে মূলত তারা বেইজিং সফওে গেছেন। অক্টোবরে আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের ২৩ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল এক সপ্তাহের সফরে বেইজিং-এ গিয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে একগাল বদনাম করে এসেছে। এর জবাব দেয়ার প্রয়োজন বোধ করাতেই টুকুর নেতৃত্বে এই সংক্ষিপ্ত সফর।

ভারতের কাঁধে ভর করে ক্ষমতায় এলেও চীন আওয়ামী লীগের জন্য অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর প্রধান কারণ হল চীনের কাছ থেকে খুব সহজেই লীগ সরকার বিপুল পরিমান ঋণ পেয়েছে। এই ঋণের টাকার ভাগ আওয়ামী লীগের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীরা দীর্ঘ দশ বছর ধরে কম বেশি পেয়েছেন। এই অর্থ দিয়েই তাদের বিরাট ক্যাডার বাহিনীর শ্রী বৃদ্ধি ঘটেছে। চীনকে হাতে না রাখতে পারলে টাকার এই দুধ-মধুর স্রোতধারা শুকিয়ে যাবে সহসাই, কারণ জাপান ও পশ্চিমা দেশগুলি খয়রাতি ও ঋণের অর্থ কঠোর মনিটরিং করে। তাদের টাকার রাজনৈতিক বা দলীয় কাজে ব্যবহারের কথা ভাবাই যায় না। অন্যদিকে, ভারতের পক্ষেও অতো টাকা দেয়া অসম্ভব। বন্দুক-ডাণ্ডা দিয়ে একদলীয় শাসন অব্যাহত রাখতে চীনের অর্থের আর কোন বিকল্প আওয়ামী লীগের কাছে নেই।

চীনের কম্যুনিস্ট পার্টি কেন আওয়ামী লীগকে নিমন্ত্রণ করল? এটা চীন করেছিলে এমন সময়ে যখন সাধারণ ধারনা ছিল আওয়ামী লীগ অনায়াসে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হবে। তখন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বর্তমান আকারে আত্মপ্রকাশ করেনি। রাজনীতির পুরো মাঠ ছিল লীগের একচ্ছত্র দখলে। বাংলাদেশ তাদের বিনিয়োগ সুরক্ষিত রাখতে বা বৃদ্ধি করতে ভবিষ্যৎ সরকারকে স্বাভাবিক ভাবেই চীন হাতে রাখতে চেয়েছে। চীনের খুব জানা আছে লীগ সরকার তাদের ঋণের টাকা দুষ্কর্মে ব্যয় করেছে। চীনের তাতে খুব আপত্তি নেই, কারন টাকা ফেরত না পেলে তারা বাংলাদেশের একটা অংশ দখলে নিয়ে নেবে, যেমনটা তারা শ্রীলঙ্কায় করেছে। নেপাল- ভুটান-ভারত ট্রাই জংশনে, যাকে বলা হয় “চিকেন নেক”, সেখানে চীন ঘাঁটি গেড়েছে। চীন তো আর ওখানে কেবল চা খেতে আসেনি, এটা তার দীর্ঘ মেয়াদী কৌশলেরই অংশ। যায়গাটা কিন্তু বাংলাদেশ থেকে খুব বেশি দূরে নয়। উত্তর বঙ্গের একটা অংশ হস্তগত করতে পারলে চীন সহজেই ভারতকে দুপাশ থেকে চেপে ধরতে পারবে। এতে ভারতের উত্তর পূর্বাংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। নেপাল ও ভুটানে ভারতের কূটনৈতিক ও কৌশলগত বিপর্যয়ের পর হিমালয় অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবে ভারতের নীতি নির্ধারকরা গভীর ভাবে বিচলিত।

ভারত তাহলে হাসিনা সরকারকে চীনা ঋণ গ্রহণ থেকে নিবৃত্ত করছে না কেন? ভারত যে চেষ্টা করেনি বা করছে না তা নয়। ভারত চায় হাসিনা সরকার ভবিষ্যতে সকল চীনা বিনিয়োগ ভারতের সাথে পরামর্শ করেই করুক। হাসিনা ভাল করেই বোঝেন এর মানে হল চীনা বিনিয়োগ শুকিয়ে যাওয়া, যার সরাসরি ফল হচ্ছে লীগের নেতা-কর্মী-ক্যাডারের হালুয়া রুটি বন্ধ হয়ে যাওয়া। গদি রক্ষার জন্যে হাসিনার তাই ভারতকেও চাই, চীনকেও চাই। হাসিনা হয়তো উভয় শক্তিকে কাছে রাখতে পারতেন যদি দেশে তার কোন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকতো। কিš ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট জোটগত ভাবে নির্বাচন করার সিদ্ধান্তে সব হিসাব পালটে গেছে। চীনের সাথে হাসিনার মাখামাখি ভারত কখনোই ভাল চোখে দেখেনি, কিন্তু আর কোন ভাল বিকল্প না থাকায় এতদিন তা সহ্য করে গেছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এখন ভারতের কাছে একটি সম্ভাব্য বিকল্প হয়ে দেখা দিয়েছে। ফ্রন্টের সামনের সারির বেশ কিছু নেতার সাথে ভারতের দীর্ঘ দিনের সুসম্পর্ক রয়েছে। ড. কামাল হোসেনকে ভারতের নীতি নির্ধারকরা বিশেষ সম্মানের চোখে দেখেন। এমনকি বিএনপির ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি তারেক রাহমানেরও ভারতের সাথে ভাল সম্পর্ক আছে বলে অনেকেই ধারণা করেন। এদিকে, চীন ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ত্বরিত উত্থানকে গভীর আগ্রহের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে তাদেরও শুভানুধ্যায়ী রয়েছেন যাদের সাথে তাদের রয়েছে দীর্ঘ দিনের যোগাযোগ।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রতি ভারত ও চীনের এই বিপুল আগ্রহ আওয়ামী লীগ তথা হাসিনাকে দিয়েছে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি। লীগের নেতারা চীনকে বোঝানোর চেষ্টা করছে যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ওয়াশিংটন -দিল্লীর একটি প্রকল্প এবং ড. কামাল নিজেই কট্টর মার্কিনপন্থী। অন্যদিকে ভারতের কাছে তারা প্রচার করছে যে টুকুর চীন সফর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের চীন প্রীতির প্রমাণ, এবং পাকিস্তানের গোয়েন্দারা এই সফরের আয়োজন করেছে। তাদের এমনটাই বুদ্ধিভ্রংশ হয়েছে যে তারা ভুলে গেছে ফারুক খানের মত আওয়ামী প্রেসিডিয়ামের সদস্য ও প্রাক্তন পূর্ণ মন্ত্রীর নেতৃত্বে তারা দুই ডজন নেতাকে বেইজিং পাঠিয়েছিল সাত দিনের সফরে, আর বিএনপি পাঠিয়েছে টুকুর মতো মধ্য পর্যায়ের এক নেতাকে চার দিনের জন্য, এবং সঙ্গে গেছেন মাত্র তিন জন। জানা গেছে যে এক পর্যায়ে বিএনপি চীনকে জানিয়েছিল যে লেভেলের কারণে যদি চীনের অসুবিধা হয়, তাহলে এই সফর বাতিল করা যেতে পারে। কিন্তু চীন আগ্রহী থাকায় সফরটি হতে পেরেছে। ধারণা করা হচ্ছে বেইজিং-এ বিএনপি টীম আওয়ামী প্রচারের জোরালো জবাব দেবে।

আওয়ামী সরকারের এ যাবত কালের ভারত-চীন ভারসাম্য কূটনীতি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের উত্থানে এখন খাদে পড়ে গেছে-শ্যাম আর কূল বুঝি দুটোই যায়!