ভয়ের বাংলাদেশ তৈরি হয়েছে

ভয়ের বাংলাদেশ তৈরি হয়েছে

আমরা দেখছি, একটা ভয়ের বাংলাদেশ তৈরি হয়েছে। খ্যাতিমান মানুষ থেকে সাধারণ মানুষ, প্রান্তিক মানুষ পর্যন্ত ভয়ে আছে-কখন মামলার মধ্যে পড়বে, গ্রেপ্তার হয়ে যাবে কিংবা কখন প্রশাসনের হয়রানিতে পড়বে। এসব অভিযোগ সংবাদপত্রে বহু এসেছে। ভয়ের এমন জায়গা তৈরি হয়েছে যে সরকারি দলও বলছে, ক্ষমতায় না থাকতে পারলে তারা আক্রান্ত হবে। জনগণের জন্য ভয়ের পরিস্থিতি তৈরি করে তারাও ভয়ে আছে।

আমার দলের সমর্থকদের ওপর হামলা এবং নির্বাচনী প্রচারে বাধা দেওয়া হচ্ছে। নির্বাচনী প্রচারণার তৃতীয় দিনে আমার ওপর হামলা হয়েছে। হুমকি-ধমকি, দাপট চলছে। অথচ সরকার দলের প্রচারে কোনো বাধা হচ্ছে না। প্রতি ওয়ার্ডে একটি করে নির্বাচনী কার্যালয় করার কথা। সরকারদলীয় লোকেরা যে কত কার্যালয় করেছে, তার হিসাব নেই। এদিকে আমার দলের কার্যালয় ভেঙে ফেলা হচ্ছে। এসবে কোনো পর্যবেক্ষণ নেই।

শুধু বাস্তব জগতে নয়, ভার্চ্যুয়াল জগতেও বাধা হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে আমার ফেসবুক, মেইল আইডি এবং গণসংহতি আন্দোলনের ফেসবুক পেজ হ্যাক করা হয়েছে। ফেসবুকে এই যে হ্যাক করা হলো তা আমার দলের ওপর আঘাত, দলীয় প্রচারের ওপর আঘাত। খুবই সংগঠিতভাবে এই সাইবার–সন্ত্রাস করা হয়েছে। কথা বলার ক্ষেত্রে ভয় দেখানো হচ্ছে। ফেসবুকে কিছু লিখলে গ্রেপ্তার হচ্ছে। অথচ আমরা দেখলাম সরকার নিজেই বিভিন্ন গুজব সৃষ্টিকারী ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছিল। অপপ্রচার করছে—এমন অভিযোগে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু অ্যাকাউন্ট বন্ধ করেছে এবং এই অ্যাকাউন্টগুলোর পেছনে সরকারের সমর্থন ও মদদের অভিযোগ রয়েছে। তাদের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কিন্তু বিরোধী মতের মানুষের ক্ষেত্রে প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছে।

সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করেছে গুজব ও ভুয়া সংবাদ রোধ করার দোহাই দিয়ে। অথচ দেখা যাচ্ছে নিজেরাই তাদের পক্ষে যায় এমন গুজব ও ভুয়া সংবাদকে উৎসাহিত করছে। আবার আমার আইডি হ্যাক করা হলো, দুই দিনেও তা উদ্ধার হয়নি। থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছি। প্রয়োজনে মামলাও করব। আমি মনে করি, আইডি উদ্ধার না হলে বুঝতে হবে এই হ্যাকাররা কোথা থেকে উৎসাহ পাচ্ছে। আমি সরকারের সহযোগিতা আশা করছি।

প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সব সময় প্রজাতন্ত্রের স্বার্থটা দেখা উচিত। সরকারের স্বার্থ দেখা তাদের দায়িত্ব নয়। কিন্তু সরকারদলীয়দের স্বার্থে প্রশাসন যেভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তাতে প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাদের সম্মান জনগণের চোখে প্রশ্নবিদ্ধ।

আইন প্রয়োগ হচ্ছে কেবল প্রতিপক্ষের জন্য। এটা পক্ষপাতের প্রধান দিক। পুলিশের আচরণ ও কথা বলার ধরন দেখে প্রায় সময় মনে হয়, তারা সরকার, প্রশাসন কিংবা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতাদের মতো কথা বলছে। এতে বাকি প্রার্থীরা আস্থা রাখতে পারে না। পুলিশ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করুক, যাতে আমরা আস্থা রাখতে পারি। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে বাস্তব কোনো পরিবর্তন নেই।

আমরা সবার জন্য ভয়মুক্ত একটা বাংলাদেশ চাই। সেটার একমাত্র সমাধান হচ্ছে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। মানুষের ভোটাধিকার এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করতে হবে। এটি প্রতিষ্ঠা করতে গেলে বর্তমান স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামোকে পরিবর্তন ও সংবিধানকে গণতান্ত্রিক করতে হবে। ক্ষমতার কাঠামোকে গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিমূলক এবং ভারসাম্যের আওতায় আনা না গেলে কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।

সরকার বলল, নির্বাচন কমিশনও বলল, নির্বাচন সুষ্ঠু করবে। এটা তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ। তবে সবার জন্য সমান সুযোগ—এটা অলীক কল্পনা হয়ে গেছে। দেশের পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে, একটা প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে। নির্বাচনকে আমরা আন্দোলনের অংশ হিসেবে মনে করি এবং জনগণের ঐক্যবদ্ধ একটা শক্তি হিসেবে দেখতে চাই। জনগণের ঐক্যবদ্ধ শক্তি দিয়েই দেশে গণতন্ত্রের প্রক্রিয়ার উত্থান ঘটাতে হবে। ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করে ভোট দখলের সংস্কৃতি রুখে দিতে হবে।

নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে রাষ্ট্রের জন্য তা অশুভ হবে। কেবল সুষ্ঠু নির্বাচন একটা সমাধান আনতে পারবে। এর দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও সরকারের। প্রশাসন যদি সরকারি দলের আজ্ঞাবহ হয়ে ভূমিকা পালন করে, তবে তা হবে জনগণ ও দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া। আমাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছি, ভয়মুক্ত বাংলাদেশ, কার্যকর গণতন্ত্র এবং সবার উন্নয়নের কথা।

বর্তমান সরকার উন্নয়নের কথা বলে। তবে এই উন্নয়ন সবার জন্য, সবাইকে নিয়ে করতে হলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই করতে হবে। তা না হলে উন্নয়ন শুধু ওপরতলার মানুষের হবে। উন্নয়নের নামে বড় ধরনের লুণ্ঠন, বড় আকারের টাকা পাচার ঘটতেই থাকবে, যার কোনো জবাবদিহি থাকবে না। এর আগে উন্নয়নের অগ্রাধিকার, উন্নয়ন ব্যয়ের জবাবদিহি তৈরি করতে হবে।

সবার জন্য উন্নয়নের পূর্বশর্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। বিগত সময়ে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো পরবর্তীকালে বুমেরাং হয়ে সেই সরকারকেই আঘাত করেছে। দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ একটি গুরুত্বপূর্ণ দল। প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করে তারা কোন গৌরব প্রতিষ্ঠা করবে?

বি.দ্র. লেখাটির বক্তব্য লেখকের নিজস্ব

জোনায়েদ সাকি: গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী এবং ঢাকা–১২ আসনে বাম গণতান্ত্রিক জোটের প্রার্থী।