বেচে আছি-৩

শক ও শোক

শক ও শোক

শফিক রেহমান

বাঙালির বিভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্টের অন্যতম প্রধান দু’টি হলো- আবেগ ও অতিরঞ্জন। কিন্তু আবেগই যে অতিরঞ্জনের কারণ, তা নয়। স্বতঃস্ফূর্ত স্নেহ, ভালোবাসা, উষ্মা, বিদ্রোহ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মৃত্যু প্রভৃতিতে শোক প্রকাশের ক্ষেত্রে বাঙালির প্রচণ্ড আবেগ দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে এই আবেগ স্বল্পক্ষণ স্থায়ী হয়, কোকা-কোলা অথবা সেভেন আপের ফিজির মতো। অন্য দিকে বাঙালির অতিরঞ্জনটা হয়, ভাষা ও বাক্য বিনিময়ে যথার্থ অনুশীলন ও সংযম যে প্রয়োজনীয়, সেটা অজানার কারণে। এই অতিরঞ্জন দেখা যায়, কোনো ঘটনা-দুর্ঘটনার বিবরণ, কোনো ব্যক্তির সম্পর্কে বিশেষণ প্রয়োগে এবং বিশেষত শোক প্রকাশের ক্ষেত্রে। যেমন, কথায় কথায় বলা হয়, ‘লোকটা আমার খুবই সুপরিচিত’। অথচ ওই লোকটা হয়তো তার অতি সম্প্রতি পরিচিত। পরিচিত হলেও বিবেচনা করতে হবে লোকটা সত্যিই সুপরিচিত কিনা। সেক্ষেত্রে পরিচিত অথবা সুপরিচিত বলাই যথেষ্ট এবং এর সাথে ‘খুবই’ শব্দটি একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। ঠিক তেমনি ‘খুবই সুশিক্ষিত’, ‘খুবই সুনিপুণ’এই ধরনের কথা না বলে শুধু ‘শিক্ষিত’, ‘নিপুণ’ প্রভৃতি, কোনো ব্যক্তিবিশেষের বর্ণনায় পরিমিতিবোধ থাকা বাঞ্ছনীয়।

একইভাবে মৃত্যুর সংবাদেও অতিরঞ্জনে বাঙালি পারদর্শী ও অভ্যস্ত। যেমন, ‘সারা দেশে শোকের কালো ছায়া নেমে এসেছে’, ‘শোকে মানুষ মুহ্যমান’, ‘শোকাভিভূত মানুষ’, ইত্যাদি বর্ণনা দেখা যায়, বিশেষত মৃত ব্যক্তিটি যদি হন মোটামুটিভাবে পরিচিত।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (লক্ষ করুন তার নামের আগে আমি কোনো বিশেষণ প্রয়োগ করলাম না, যেমন, বিশ্বকবি, কবিগুরু, ইত্যাদি)-এর জন্ম হয়েছিল মে ১৮৬১-তে এবং মৃত্যু হয়েছিল ৮০ বছর বয়সে ৭ আগস্ট ১৯৪১-এ। তখন আমি রাজশাহীতে লোকনাথ স্কুলে ক্লাস টু-র ছাত্র ছিলাম। আমার বাবা সাইদুর রহমান ছিলেন রাজশাহী কলেজে ফিলসফির লেকচারার।

সেদিন ২২ শ্রাবণের সকালে ক্লাসে আমাকে রবিঠাকুরের ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এল বান’ কবিতাটি আবৃত্তি করতে হয়েছিল। তারপর দুপুরে স্কুলে সবার ছুটি হয়ে গেল। আমরা সবাই মহাখুশি হলাম। শ্রাবণ মাস হলেও সেদিন রাজশাহীতে ছিল প্রখর রোদ। আকাশে এক খন্ড কালো মেঘ ছিল না। পরদিন আমি আশ্চর্য হয়েছিলাম পত্র-পত্রিকার শিরোনামে ‘সারা দেশে শোকের কালো ছায়া নেমে এসেছে’, ‘মানুষ শোকাভিভূত’ ইত্যাদি বর্ণনা পড়ে। বস্তুত, আমার তিরাশি বছর জীবনে বিদেশে জন কেনেডি (২২ নভেম্বর ১৯৬৩), উইনস্টন চার্চিল (২৪ জানুয়ারি ১৯৬৫), জন লেনন (৮ ডিসেম্বর ১৯৮০), পৃন্সেস ডায়ানা (৩১ আগস্ট ১৯৯৭) ও মাইকেল জ্যাকসন (২৫ জুন ২০০৯)-এর মৃত্যুতে সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া দেখেছি। এই পাচজনের মধ্যে চার্চিল বাদে সবারই অপ্রত্যাশিত অকালমৃত্যু ঘটেছিল দুর্ঘটনায়। বলা যায়, এদের ক্ষেত্রে শোকের চাইতে বেশি ছিল শক। চার্চিল মারা গিয়েছিলেন ৯০ বছর বয়সে।

বিদেশে, বিশেষত উত্তর ইওরোপে, আরেকটি বিষয় আমি লক্ষ করেছি, সেটা হলো- শোক খুবই ব্যক্তিগত বিষয়রূপে গণ্য করা হয়। এর মানে এটা নয় যে, মৃত ব্যক্তির প্রিয়জন, যেমন, স্বামী, স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, এরা শোকে প্রচণ্ড আঘাত পায় না। তারা সেই আঘাত সহ্য করে জনসম্মুখে অনুভূতি যথাসম্ভব অপ্রকাশিত রাখে। তারা বাড়িতে একা কাদে। বাংলাদেশে এর বিপরীতে দেখা যায়, উচু স্বরে কান্না ও হাহাকারের প্রতিযোগিতা।
তবে শোক প্রকাশের ধরন দেশে বিদেশে ভিন্ন হলেও এটা ঠিক যে, যার প্রিয়জন মারা গেছে, সে ঠিকই বোঝে তার বেদনা, কিন্তু সে প্রকাশ করে তার নিজস্বভাবে, নিজের সময়ে।

শোকের পাচ ধাপ
জীবনের সর্বক্ষেত্রের মানুষকে শোক ও দুঃখের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাময় ব্যক্তি ও দেশের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি থেকে শুরু করে শহরের নীল পলিথিন বস্তিবাসী ও গ্রামের কুড়েঘরবাসীদের কেউই এর ব্যতিক্রম হতে পারেন না। এই শোক হতে পারে কোনো নিকট আত্মীয় অথবা প্রিয় মানুষের, অথবা কোনো প্রিয় প্রাণীর, যেমন, কুকুর, বিড়াল, গরু, পাখি প্রভৃতির মৃত্যুর কারণে। মানুষের এই মৃত্যু হতে পারে বার্ধক্যের কারণে (যা এড়ানো সম্ভব নয়) অথবা অন্য কোনো কারণে (যা কিছু ক্ষেত্রে এড়ানো অথবা বিলম্বিত করা সম্ভব) যেমন, দুরারোগ্য রোগ, আকস্মিক হার্ট এটাক ও স্ট্রোক, সাধারণ রোগ, বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনা, যেমন, লঞ্চ, কোচ, ট্রেন, প্লেন থেকে শুরু করে অপ্রত্যাশিত ও আকস্মিক সব দুর্ঘটনা, খুনখারাবি, গুমের কারণে এবং বাংলাদেশে হরতাল-অবরোধ প্রভৃতি রাজনৈতিক কারণে।

মৃত্যু বিষয়ে সুইস-আমেরিকান সাইকিয়াটৃস্ট এলিসাবেথ কুবলার-রস (Elisabeth Kubler-Ross) তার বিখ্যাত বই অন ডেথ অ্যান্ড ডাইয়িং (On Death and Dying, ১৯৬৯)-এ প্রথম চিহ্নিত করেন সাধারণ শোকের পাচটি ধাপ।

তার মতে, শোকের এই পাচটি ধাপের প্রতিটি ধাপে শোকার্ত মানুষ যে সময়ের মধ্য দিয়ে যায়, সেই সময়ের স্থায়িত্ব প্রতিজনের ক্ষেত্রে হয় ভিন্ন। প্রতিটি ধাপে মানুষ যে গভীর দুঃখ অনুভব করে তার প্রকাশও হয় ভিন্নভাবে। শোকাহত মানুষ এক ধাপ থেকে আরেক ধাপে যেতে থাকে এবং তার শেষ ধাপটি হয়, প্রিয়জনের মৃত্যু যে হয়েছে সেটা শান্তিপূর্ণভাবে মেনে নেওয়াতে। কিন্তু শেষ ধাপে পৌছানোর আগে মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে। অনেকেই তার প্রিয়জনের মৃত্যু কখনোই মেনে নিতে পারেন না।

এই ধাপগুলো অতিক্রমের সময়ে অনেকে নতুন করে হৃদয়ঙ্গম করেন, মানুষ মরণশীল- এই রূঢ় বাস্তবতাটি। তবে, প্রতিটি ধাপে মানুষ আশার আলো পায়। মানুষ বোঝে, যতক্ষণ জীবন আছে ততক্ষণ আশা আছে এবং যতক্ষণ আশা আছে ততক্ষণ জীবন আছে।

কুবলার-রস থিওরির পাচটি ধাপ নিচে বর্ণিত হলো। যে ক্রম অনুযায়ী পাচটি ধাপ বর্ণিত হয়েছে, সেই ক্রম বিভিন্নজনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন হতে পারে। সুতরাং শোকার্তের অনুভূতি বোঝার জন্য প্রতিটি ধাপ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বুঝতে হবে এবং বিবেচনা করতে হবে শোকার্ত ব্যক্তি কখন কোন ধাপে অবস্থান করছেন। সবসময় মনে রাখতে হবে, প্রতিটি মানুষ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে তাদের শোক প্রকাশ করেন। কেউ হয়তো যা তাৎক্ষণিকভাবে কপাল চাপড়ে কান্না শুরু করেন, কেউ বা অপর কাউকে জড়িয়ে ধরে কাদতে থাকেন। আবার কারো ভেতরে কান্নার প্রবল ঢেউ বয়ে গেলেও বাইরে সেটা প্রকাশিত হয় না। তিনি কাদেন না। অথবা তিনি নির্বাক হয়ে যান, যেমনটা হয়েছিলেন আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে তার মা খালেদা জিয়া।

সুতরাং কে কতখানি দুঃখ পেয়েছেন, সেটা তার প্রকাশভঙ্গি থেকে বিবেচনা না করে বুঝতে হবে প্রতিটি শোকের প্রকাশ হয় ভিন্ন। যার দুঃখ, সে-ই শুধু তার অন্তরে বুঝতে পারেন তার দুঃখের গভীরতা দুঃখের বহিঃপ্রকাশে দুঃখের পরিমাপ করা অন্যের পক্ষে সম্ভব নয়। এখন কুবলার-রস থিওরির পাচটি ধাপ:

এক. অস্বীকার ও একাকিত্ব
প্রিয়জনের মৃত্যু সংবাদে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে পরিস্থিতির বাস্তবতাটাকে অস্বীকার করা। সর্বগ্রাসী আবেগকে যুক্তিগ্রাহ্য করে তোলার জন্য এটা স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। এটা একটা ডিফেন্স মেকানিজম বা আত্মরক্ষামূলক প্রতিক্রিয়া, যেটা তাৎক্ষণিক শকের বাফার (Buffer) বা বাধারূপে কাজ করে। তখন মানুষ দুঃসংবাদটি বিশ্বাস করতে চায় না- বাস্তবতা থেকে নিজেকে লুকাতে চায়। এই সাময়িক প্রতিক্রিয়ার সময়ে দুঃখের প্রথম বেদনার ঢেউগুলো মানুষ একাকী পাড়ি দেয়।

দুই. রাগ
অস্বীকার এবং একাকিত্বের প্রতিক্রিয়া ধীরে ধীরে কমতে শুরু হলে বাস্তবতা এবং তার ব্যথা পুনরায় আবির্ভূত হয়। তখন মানুষ অপ্রস্তুত থাকে। তার অন্তস্তলের গভীর দুঃখ তখন নতুন রূপ ধারণ করে শোক রূপান্তরিত হয় ক্রোধে, রাগে। তার চরম রাগের লক্ষ হতে পারে তার পরিবারের সদস্যরা, বন্ধুরা, সম্পূর্ণ অপরিচিত ব্যক্তিরা- অথবা নিষ্প্রাণ বস্তু, যেমন কাচের শোপিস-প্লেট-পেয়ালা অথবা ফার্নিচার প্রভৃতি। এসব তিনি ভাঙচুর করতে পারেন। মৃত অথবা মরণাপন্ন ব্যক্তিও তার ক্রোধের টার্গেট হতে পারেন। এমন আচরণের জন্য শোকার্তকে দোষী করা উচিত হবে না। তবে তার আচরণে কেউ শারীরিক অথবা মানসিকভাবে আহত হতে পারেন। তখন শোকার্ত ব্যক্তি নিজের আচরণে নিজেই আরো ক্রুদ্ধ হতে পারেন এব অন্যদের আরো ক্ষুব্ধ করতে পারেন।

যদি কোনো প্রিয়জনের মৃত্যু হয়ে থাকে রোগের কারণে, তাহলে এই সময়ে তার ডাক্তার স্পেশাল টার্গেট হতে পারেন। শোকার্ত ব্যক্তি মৃত্যুর জন্য ডাক্তারের অবহেলা (সেটা হতে পারে কল্পিত) ও চিকিৎসায় ত্রুটির জন্য ক্রোধ প্রকাশ করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে শোকার্ত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনের উচিত হবে- ডাক্তার অথবা হসপিটাল-ক্লিনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিভৃতে আলোচনা করে সঠিক অবস্থা নির্ণয় করা।

তিন. মানসিক দ্বন্দ্ব
এই অসহায়ত্বের আরেকটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় শোকার্ত ব্যক্তি তার মানসিক নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করতে চান। তিনি ভাবেন, আরো আগে যদি চিকিৎসা শুরু হতো- তাহলে হয়তো সে বেচে যেত। অথবা, আরেক ডাক্তারের সেকেন্ড ওপিনিয়ন যদি নেওয়া যেত। অথবা, ব্যক্তিটির জীবিত থাকা অবস্থায় যদি তার প্রতি আরো যত্নশীল হওয়া যেত ইত্যাদি। কোকোর মৃত্যুর পরে খালেদা জিয়া ভেবে থাকতে পারেন, যদি সে ঢাকায় থাকত, তাহলে অসুস্থ অবস্থায় মা-সুলভ সেবা-শুশ্রুষা তিনি করতে পারতেন অথবা হার্ট এটাকের পরপরই তার (খালেদার) আস্থাভাজন ডাক্তারের উপদেশ-নির্দেশে কোকোর চিকিৎসাব্যবস্থা যদি করা যেত।
কিন্তু এ ধরনের চিন্তা দুর্বল, কারণ, এই যদিটা অস্বীকার করে বাস্তবকে। বাস্তব সত্য যে, মানুষ মরণশীল।

চার. ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতা
শোকার্ত মানুষ দুই রকমের ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতায় ভুগতে পারেন, বিয়োগান্তক ঘটনাটির পূর্ণ তাৎপর্য বুঝে ওঠার পাশাপাশি প্রথম ধরনের ডিপ্রেশন শোকার্তকে গ্রাস করতে পারে। তিনি বুঝতে পারেন, তার অন্যান্য দৈনন্দিন কাজ থেমে গেছে অথবা ধীর লয়ে চলছে, যার ফলে তার ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সবাই যদি শোকার্ত ব্যক্তিকে আশ্বস্ত করেন, সবই ঠিকমতো চলছে অথবা চলবে, তাহলে তিনি সান্তনা পেতে পারেন। দ্বিতীয় ধরনের ডিপ্রেশন আসে, যখন শোকার্ত ব্যক্তির নীরবে তার মনে মনে প্রস্তুতি নেন প্রিয় ব্যক্তিটিকে চিরবিদায় দেওয়ার, তখন তিনি ভাবতে থাকেন তাকে ছাড়া নিজের বাদবাকি জীবনটা কিভাবে কাটবে। এ ক্ষেত্রে শোকার্তকে একটু আদর করা ছাড়া আর করণীয় কিছু থাকে না।

পাচ. বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া
শোকের এই পর্যায়ে পৌছানোর সুযাগ সবার হয় না। কারো মৃত্যু মেনে নেওয়া এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে মেনে নেওয়া সম্ভব না-ও হতে পারে। ফলে শোকার্ত ব্যক্তি নিজের মৃত্যু পর্যন্ত ওই বিশেষ শোকের ভার বহন করে চলেন।

প্রিয়জনের মৃত্যুতে শোকার্তের যে ক্ষতি হয়, সেটার সটিক পরিমাপ শুধু তারই পক্ষে করা সম্ভব হতে পারে না-ও হতে পারে। যা-ই হোক না কেন, শোকার্তকে একটি লম্বা সময় জুড়ে দুঃখসমুদ্র পাড়ি দিতে হতে পারে। এ ক্ষেত্রে তার দুঃখে সমদুঃখী হওয়া ও সমবেদনা প্রকাশ করা যেতে পারে। শোকার্তকে উপদেশ দিতে থাকলে তার ক্ষত সারতে দেরি হতে পারে।

মৃত্যু সংবাদে প্রতিক্রিয়া
জর্জ বোনানো-র থিওরি
শোক বিষয়ে এখন কুবলার-রস থিওরি সর্বাধিক স্বীকৃত। এই প্রসঙ্গে আমেরিকার কলাম্বিয়া ইউনির্ভাসিটির ক্লিনিকাল সাইকোলজির প্রফেসর জর্জ বোনানো (George Bonanno)-র থিওরিও বহুল আলোচিত।
মৃত্যু সংবাদ প্রাপ্তির পর মানুষের যেসব প্রতিক্রিয়া হতে পারে সে বিষয়ে বোনানো লিখেছেন, উচু স্বরে কান্নাকাটি এবং বুক অথবা কপাল চাপড়ানো বিলাপ করাটা শোকের স্বাভাবিক প্রকাশ। তবে এটা অবিরামভাবে বেশিক্ষণ হলে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। মৃত্যু সংবাদ শুনে কেউ কেউ দুঃখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়তে পারেন এবং এটাও স্বাভাবিক।

বোনানো আরো লিখেছেন, কেউ যদি কাদতে না পারেন তাহলে সেটাও স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হবে। তার মতে, মৃত্যু সংবাদ প্রাপ্তির পর নির্বাক হয়ে যাওয়াটা, শোকার্তের আত্মরক্ষার একটা মেকানিজম এবং এতে বোঝা যায় শোকার্ত ব্যক্তি তখনো মানসিকভাবে রেসিলিয়েন্ট (Resilient) বা তৎপর আছেন, দৃঢ়চেতা আছেন।

শোকার্ত ব্যক্তি তখন নিজের অবস্থাকে পরিস্থিতির কাছে সমর্পণ না করে, পরিস্থিতিকেই নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে চান। তিনি তখন নিজের ওপর পূর্ণ কনট্রোল স্থাপিত করতে চান এবং নির্বাক থাকেন। এটা ঘটে যায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে। অটোমেটিকালি তার বডি ও মেন্টাল সিসটেম তাকে তখন রক্ষা করে।

বাংলায় এই প্রতিক্রিয়াকে বলা হয় শোকে পাথর হয়ে যাওয়া, শোকে মুহ্যমান হয়ে যাওয়া, ইত্যাদি।

শনিবার ২৪ জানুয়ারি দুপুরে কোকোর মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর থেকে মঙ্গলবার ২৭ জানুয়ারি ২০১৫-এর দুপুরে গুলশান অফিসে কোকোর মরদেহ দেখার সময়ে এবং তারপর মরদেহ বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স যখন জানাজার জন্য বায়তুল মোকাররমের দিকে যাত্রা শুরু করে তখন অফিসের গেইটে এসে সন্তানকে চিরবিদায় দেওয়ার সময় পর্যন্ত খালেদা জিয়ার নির্বাক থাকার এটাই তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা।

খালেদা জিয়ার শোকে পাথর হয়ে যাওয়ার বিপরীতে বিবেচনা করুন আমেরিকান ঔপন্যাসিক এরিক সিগাল-এর লাভ স্টোরি উপন্যাসে (যেটা ১৯৭০-এ হিট মুভিতে রূপান্তরিত হয়) যেখানে তরুণ নায়ক রায়ান ওনিল বলছেন, ‘পচিশ বছরের এই যে মেয়েটি এখনি মারা গেল, তার সম্পর্কে আপনি কি বলবেন? আপনি কি বলবেন, সে ছিল সুন্দরী? এবং বৃলিয়ান্ট? সে ভালোবাসতো মোৎসার্ট আর বাখ-এর সুর? বিটলসের গান? আর আমাকে?’

শোকের বিভিন্ন প্রকাশের অন্যতম কারণ হয়তো মৃত্যু বিষয়ে কারোই পূর্ণ ধারণা হয় না নিজের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত। এ বিষয়ে রাশিয়ান-আমেরিকান নোবেল বিজয়ী ঔপন্যাসিক ভ্লাডিমির নবোকভ বলেছিলেন, ‘জীবনটা সারপ্রাইজে ভর্তি। মৃত্যুটা যে আরো বড় সারপ্রাইজ হবে না, তার কোনো কারণ আমি দেখি না’ (Life is a great surprise. I do not see why death should not be an even greater one)। বিখ্যাত ‘ললিটা’ উপন্যাসের লেখক নবোকভ মারা গিয়েছিলেন ২ জুলাই ১৯৭৭ সুইজারল্যান্ডে ৭৮ বছর বয়সে।

তবে সেই সারপ্রাইজটা সাধারণত কেউই পেতে চান না। এ বিষয়ে আমেরিকান প্রবাদপুরুষ হেভিওয়েট বক্সার জো লুই বলেছিলেন, ‘সবাই স্বর্গে যেতে চায়, কিন্তু কেউ মরতে চায় না’ (Everybody wants to go to heaven, but nobody wants to die)। জো লুই মারা গিয়েছিলেন ১২ এপৃল ১৯৮১-তে।

খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে জো লুইসহ মাত্র কয়েকজনের কথা লিখলাম। এরা সবাই অসাধারণ ও বিখ্যাত ব্যক্তি। কিন্তু আমি ভাবি বিশেষত, বাংলাদেশে প্রতিদিনই যেসব অবিখ্যাত শতশত সাধারণ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, তাদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবের মধ্যে কি প্রতিক্রিয়া হয়? তারা কি বাংলার আকাশে শোকের কালো ছায়া দেখতে পান? অথবা শোকে অভিভূত হয়ে থাকেন? বিশেষত, অপহরণ, গুম, ধর্ষণ ও খুনের ফলে নিরুদ্দিষ্ট হয়েছেন অথবা পরপারে চলে গিয়েছেন?

এ ক্ষেত্রে অপ্রত্যাশিত শকের সঙ্গে যুক্ত হয় শোক। তাদের কথা কিভাবে আমরা জানব? তাদের কথা আমরা কি বলব?

আমি বেচে আছি। আমি কি তাহলে স্বার্থপর?

না। আমি জানি আমি স্বার্থপর নই। আমরা যারা সমাজ সচেতন এবং এখনো বেচে আছি তাদের, বিশেষত অপমৃত্যুর জন্য যারা দায়ী, তাদের সবারই মনে রাখা উচিত, ইংরেজ কবি জন ডন (John Donne, 1572-1631, ১৫৭২-১৬৩১)-এর কবিতা :

‘‘যে কোনো মানুষের মৃত্যুই আমাকে ছোট করে দেয়,
কারণ আমি মানবজাতির সাথে সম্পৃক্ত;
আর তাই কখনো জানতে চেও না
কার জন্য মৃত্যুঘণ্টা বাজছে,
কারণ এই মৃত্যুঘণ্টা বাজছে তোমার জন্যই।”

Any man's death diminishes me
Because, I am involved in mankind;
And therefore never send to know
For whom the bell tolls; it tolls for thee.