কৃষককে বাঁচাতেই হবে

কৃষককে বাঁচাতেই হবে

মুঈদ রহমান

সারা দেশে এ সময়টাতে কৃষকের হাহাকারই শুনতে পাচ্ছি। ধানের ন্যায্য দাম না পাওয়ায় তারা সারা দেশে বিভিন্নভাবে প্রতিবাদ করে যাচ্ছে। এ প্রতিবাদ এখন আর কেবল গ্রামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত গড়িয়েছে। কৃষকের সন্তানরা মানববন্ধন করে সরকারের কাছে ধানের যথাযথ দাম দাবি করছে।

ক্ষোভে কেউ কেউ ধানক্ষেত পুড়িয়ে দিয়েছে বলেও খবর বেরিয়েছে। অনেককে এমন কথাও বলতে শোনা গেছে, প্রয়োজনে আগামী বছর ধান চাষই করবেন না তারা। বিষয়টি সবারই মাথাব্যথার কারণ হওয়ার কথা। কেননা কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষকের দুর্দশাকে কেবল ‘কৃষকের’ বলেই থেমে থাকা যাবে না। কৃষি খাতের যে কোনো বিপর্যয় মানে তা ১৭ কোটি মানুষের বিপর্যয়। সেক্ষেত্রে সরকারের যে কোনো উদাসীনতা আমাদের ভবিষ্যৎকে অন্ধকারে ঠেলে দিতে পারে।

১৭৫১ থেকে ১৭৭৮ সাল, এ ২৯ বছর ধরে ফ্রান্সে একটি অর্থনৈতিক মতামতের চর্চা হয়েছিল। এ মতের অর্থনীতিবিদদের বলা হয় ‘ফিজিওক্রাট’। এ ফিজিওক্রাটরাই প্রথম বললেন, অর্থনৈতিক খাতগুলোর মধ্যে একমাত্র কৃষি খাতই হল উৎপাদনশীল খাত। বাদবাকি সেবা, ম্যানুফ্যাকচারিংসহ সব খাতই অনুৎপাদনশীল বা নিষ্ফলা। তাদের মতের পক্ষে বলতে গিয়ে বলা হয়েছিল, একমাত্র কৃষি খাতই উদ্বৃত্ত সৃষ্টি করতে পারে, অন্য খাতগুলো তা পারে না। ফিজিক্যাল অর্থে ধরলে তা-ই হয়। এক কেজি ধান বপন করলে তা থেকে এক হাজার কেজি বা এক টন ধান উৎপাদন করা সম্ভব। এ অতিরিক্ত ৯৯৯ কেজি হল উদ্বৃত্ত। কিন্তু এক কেজি ময়দা দিয়ে দুই কেজি পাউরুটি তৈরি করা সম্ভব নয়। অথবা ১০০ টন লোহা ব্যবহার করে ২৫০ টন জাহাজ বানাতে পারবেন না। কিংবা এক কেজি সুতা দিয়ে ৫ কেজি কাপড় উৎপাদন করতে পারবেন না। সে জায়গায় ফিজিওক্রাটদের যুক্তি অকাট্য। এর কিছুদিন বাদেই ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথ বললেন, বাদবাকি খাতগুলোকে অনুৎপাদনশীল বলা যাবে না। একজন ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনও একটি উৎপাদন, কারণ তা মানুষের উপকারে আসে। তেমনিভাবে একজন গায়কের গানও উৎপাদন, কারণ তা মানুষের মনে আনন্দ দেয়। মোদ্দাকথা, মানুষের মনের ও দেহের খোরাক মেটানোর সব জিনিস তৈরিই উৎপাদনের মর্যাদা পাবে। তা পাক, কিন্তু ফিজিওক্রাটদের ওই ‘উদ্বৃত্ত’র বিষয়টি কিন্তু দাঁড়িয়েই রইল। ১৮ শতকের মধ্যভাগে ব্রিটেনে যে শিল্পবিপ্লব হয়েছিল তার মূলে ছিল কৃষি খাতে উদ্বৃত্ত। যে কারণে একটি দেশ শিল্পে যত উন্নতই হোক না কেন, কৃষিকে সে গুরুত্ব দিতে বাধ্য। একথা আমেরিকা, ইংল্যান্ড, জাপান থেকে শুরু করে ইথিওপিয়া পর্যন্ত সত্য। যদি পেটের কথা মনে রাখতে হয় তবে কৃষির কথা মনে রাখতে হবে। আমি আবেগকে বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় না দিয়ে বলতে পারি, আজ আমাদের দেশের কৃষকের যে করুণদশা, তা আমেরিকার কৃষকের হলে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আর তিন মিনিটও গদিতে থাকতে পারতেন না।

১৯৭১ সালে ৭ কোটি মানুষের জন্য চালের উৎপাদন ছিল ১ কোটি টন। গড়ে প্রতি বছর ২ লাখ মানুষ এ জনসংখ্যার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে খাদ্যের চাহিদা। চাহিদার কথা চিন্তা করে এদেশের কৃষক বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করে ধান-চালের উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টা করে যাচ্ছে। বর্তমানে আমাদের জনসংখ্যা ১৭ কোটির মতো। এ বিপুল জনগোষ্ঠীর পেটের দায় মেটাতে ২০১৮ সালে ৩ কোটি টনেরও বেশি চাল উৎপাদন করেছে কৃষক। সে সময়ে আমাদের চাহিদা হিসাব করা হয়েছিল ২ কোটি ৯ লাখ টন। আমেরিকার ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচারের (ইউএসডিএ) এ মাসের সমীক্ষামতে, বাংলাদেশে চালের উৎপাদন বেড়েছে ৭.২ শতাংশ। সে হিসাবমতে, এবারের উৎপাদন দাঁড়াতে পারে প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ টন। যদি তাই হয়, তবে প্রধানতম ধান উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষে থাকবে। কিন্তু হলে কী হবে, কৃষকের সম্বল বলতে তো ওই ঘাড়ের উপর একখানা গামছা। সেই গামছা এখন গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়ায় কিনা সেটাই বিচার্য বিষয়।

১ কোটি ৩০ লাখ খামার পরিবার ধান উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। মোট চাষযোগ্য জমির প্রায় ৭৫ শতাংশই ধান চাষের আওতায়। আর যদি সেচ সুবিধার কথা ধরি, তাহলে তার ৮০ শতাংশই ধান চাষের আওতায়। বাংলাদেশে এখন ১ কোটি হেক্টর জমিতে ধান চাষ হয়। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী বছরগুলোতে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমে যাবে। অথচ আগামী দশককে বিবেচনায় নিলে চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হেক্টর প্রতি উৎপাদন বাড়াতে হবে প্রায় ২ টন। আপনি যদি বিঘা হিসাব করেন তাহলে বিঘাপ্রতি ৭ মণ। সামনের বছরগুলোতে কৃষকের ঘাড়ে কত বড় ধরনের দায় তা ভাবতে পারেন! আজকে আমরা সেই দায়িত্ববান কৃষকের জন্য কী করতে পারছি?

যদি আপনি বইয়ের ভাষায় বলতে চান তাহলে বলতে হবে, ধান বা চালের বাজার হচ্ছে পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার। এ বাজারের একটি প্রধান বৈশিষ্ট হল পণ্য-পার্থক্য নেই। অর্থাৎ আপনি বুঝতেই পারবেন এর উৎপাদক রাম নাকি রহিম। আরেকটি বৈশিষ্ট হল, যে কেউ ইচ্ছা করলে এ বাজারে ঢুকতে পারে, আবার বেরিয়েও যেতে পারে। এখানে জবরদস্তির কোনো ব্যাপার নেই। আপনি চাইলে উৎপাদন করতে পারেন, না চাইলে না। সরকার বা কোনো ব্যক্তি আপনাকে বাধ্য করতে পারবে না। সবচেয়ে লক্ষণীয় দিক হল এর দাম। কৃষক ধান ফলায় বটে; কিন্তু দাম নির্ধারণ করার ক্ষমতা তার নেই। সেজন্য কৃষককে বলা হয় ‘প্রাইস টেকার’, ‘প্রাইস মেকার’ নয়। কিন্তু যদি শিল্পপণ্যের কথা বলেন, সেখানে যে উৎপাদন করে সে-ই দাম নির্ধারণ করে এবং ব্র্যান্ডের দ্বারা উৎপাদককে চেনা যায়। উৎপাদক নিজেই টুথপেস্টের গায়ে দাম লিখে দেয়- ‘সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ২৫ টাকা’। এ ক্ষেত্রে একজন শিল্প মালিক ‘প্রাইস মেকার’। আপনি নির্দিষ্ট দামে কিনলে কেনেন, না কিনলে না। ধান বা চালের বেলায় দামটা নির্ধারণ হয় বাজারে মোট জোগান ও চাহিদার দরকষাকষিতে। ১০ কেজির চাহিদা থাকলে যদি জোগান হয় ৮ কেজি তাহলে দাম বেড়ে যাবে। আবার ১০ কেজি চাহিদার বিপরীতে যদি ১২ কেজি জোগান হয় তাহলে দাম পড়ে যাবে। আমাদের কৃষক এখন শেষের সমস্যাটিতে ভুগছেন। পত্রপত্রিকার দেয়া তথ্য অনুযায়ী বর্তমান বাজারে চালের উদ্বৃত্ত রয়েছে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ লাখ টন। চাহিদার তুলনায় জোগানের এ বাড়তি পরিমাণের কারণে বাজারে দাম পড়ে গেছে। প্রতি কেজি চালের উৎপাদন খরচ ৩৬ টাকা; কিন্তু পাইকারি ক্রেতারা ২৬ টাকার বেশি দিতে নারাজ। এখানে জানার খাতিরেই বলা প্রয়োজন, মোট উৎপাদন খরচ আমাদের কৃষক যা গণনা করেন তা হচ্ছে দৃশ্যমান খরচ (explicit cost), অর্থাৎ নগদ টাকা কত গেল। কিন্তু তার স্ত্রী-সন্তান যে দিন রাত খেটেছে তার খরচ দেবে কে? ওই খরচটাকে বলি অদৃশ্যমান খরচ (implicit cost)। যদি এ খরচটা আমলে নেই তাহলে চালের প্রকৃত খরচ আরও বেশি হবে।

মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সরকার বাজারের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। যা পারে তা হল এই যে, চাহিদার অতিরিক্ত জোগান বাজার থেকে তুলে নেয়া। তাতে দাম পড়ে না গিয়ে স্থির থাকবে। সরকার এ চাল কী করবে? বিদেশে রফতানি করবে? যেমন গেল বছর আমরা শ্রীলংকায় ৫০০০০ টন চাল রফতানি করেছি। আরেকটি কাজ হল, আগামী বছর ফলন যদি খারাপ হয় তাহলে (কারণ কৃষি অনেকটাই প্রকৃতিনির্ভর) বাজারে চাহিদার তুলনায় জোগান কম হবে। তখন চালের দাম বেড়ে যাবে এবং জনদুর্ভোগ বাড়বে। সে সময়ে সরকার তার সংরক্ষিত চাল বাজারে ছেড়ে দেবে। তাতে চালের দাম না বেড়ে বরং স্থিতিশীল থাকবে। তাহলে আর সমস্যা কী, সরকার বাড়তি চালটা কিনে ফেললেই তো হয়। তা হয়, কিন্তু কেনার ভেতরই তো সমস্যা। এখানে স্বল্পকালীন ও দীর্ঘকালীন পরিকল্পনা এবং মানসিকতার বিষয়টি জড়িয়ে আছে। সরকারকে মন থেকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে কৃষককে সে বাঁচাতে আন্তরিক কিনা। যদি আন্তরিক হয়, তাহলে ন্যায্য দাম নির্ধারণ করতে হবে। যদি ন্যায্য দাম নির্ধারণ করা হয়, তারপর দেখতে হবে সে দামটি কৃষক সরাসরি পাচ্ছে নাকি মধ্যস্বত্বভোগী গিলে খাচ্ছে। মধ্যস্বত্বভোগী কিন্তু কেবলই ব্যবসায়ীরা নন, অনেক রাজনৈতিক কর্মীও কৃষকের এ দুর্বলতার সুযোগটি নিয়ে থাকে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের সরকারের ভূমিকা এক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ। কেননা মে মাস থেকে ১৩ লাখ টন ধান কেনার কোনো স্বচ্ছ দৃশ্য আমাদের চোখে পড়েনি। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বলতে মজুদ করার ক্ষমতা বাড়াতে হবে। ২০-২২ বছর ধরে আমাদের গোডাউনগুলোর ধারণক্ষমতা ১৮-২০ লাখ টনেই স্থির হয়ে আছে। এর সম্প্রসারণ প্রয়োজন।

কারও ঘরে আগুন লাগে, আর কেউ সে আগুনে গা তাপায়। এমনিতেই বাজার অতিরিক্ত জোগানে সয়লাব, তার ওপর আবার চলছে চাল আমদানি। ১০ মাসে ২ লাখ টন চাল আমদানি হয়েছে, পাইপলাইনে আছে আরও ৩ লাখ ৮০ হাজার টন। এ ব্যাপারে কৃষিমন্ত্রীর জবাব হল, পাঁচ তারকা হোটেল ও ধনীদের জন্য বিশেষ সরু চাল আমদানি করা হয়েছে। কিন্তু চাল আমদানির ক্ষেত্রে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) অন্য তথ্য দিয়েছে। তারা ২০১৬ সালের প্রতিবেদনে বলছেন, ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে বাংলাদেশে যত চাল আমদানি করা হয়েছিল, তার দাম ধরা হয়েছিল টনপ্রতি ৮০০ থেকে ১০০০ ডলার। অথচ তখন আন্তর্জাতিক বাজারে চালের গড় দাম ছিল মাত্র ৫০০ ডলার। সে হিসাবে টনপ্রতি ৩০০ থেকে ৫০০ ডলার ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়ে যায়। এটি একটি সরকারের হয় ব্যর্থতা, নয়তো সহযোগিতা। একটি গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে দুটির কোনোটিই আমরা প্রত্যাশা করি না।

আমরা চাই, সরকার একটি স্বচ্ছ ও সুন্দর পথে কৃষকের পাশে দাঁড়াক। কেননা আমাদের বাঁচা-মরা অনেকটাই কৃষকের কর্মকাণ্ডের ওপর নির্ভরশীল। আমরা কৃষকের হৃদয়ভাঙা কান্না আর শুনতে চাই না।

মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়