স্মরণ: প্রফেসর শামসুল হুদা

স্মরণ: প্রফেসর শামসুল হুদা

প্রফেসর মোহাম্মদ আবদুল হালিম

আমার দীর্ঘদিনের সিলেটি সহকর্মী প্রফেসর শামসুল হুদা গত ৩০ জানুয়ারি ইন্তিকাল করেছেন ( যিনি প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান (রাষ্ট্র বিজ্ঞান), এম.সি. কলেজ, সিলেট, অধ্যক্ষ সিলেট এম.সি. ইন্টারমিডিয়েট কলেজ, অধ্যক্ষ, মৌলভি বাজার কলেজ এবং অবসরোত্তর সাবেক কোষাধ্যক্ষ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, সিলেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন)। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। কবে, কিভাবে, কোনদিন তাঁর সাথে পরিচয় ঘটেছিল তা আর স্মরণে নেই। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তাঁর সাথে আমার ছিল নিরবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ।

পরিবার থেকে শুরু করে জীবনের সব স্তরেই তাঁর সাথে ছিল গভীর সম্পৃক্ততা। কর্মজীবন শেষে অবসরকালীন সময়েও আমাদের বন্ধুত্বের নিবিড় বন্ধন কখনও ছিন্ন হয়নি, যদিও দূরত্বের ব্যবধান ছিল ঢাকা-সিলেট।

নাতিদীর্ঘ লম্বা-চওড়া, ধবধবে ফর্সা ও ভাল চেহারা বিশিষ্ট হুদা ও আমার মধ্যে স্বভাব ও আচরণগত বৈপরীত্য ছিল। তিনি ছিলেন উষ্ণ মেজাজী আর আমি কোমল। এ সত্ত্বেও আমাদের মধ্যে কোনো দ্বন্ধ-সংঘাত, মান-অভিমান বা এ জাতীয় কিছু ঘটেছে বলে মনে পড়ে না। বয়স ও চাকরীর সময় দুটোতেই তিনি আমার জ্যেষ্ঠ। এ ফারাক আমাদের মধ্যে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি। দুজনের জীবনের এমন কোনো দিক নেই যা সম্পর্কে একে অপরে জ্ঞাত নই।

প্রথম দিকে কলোনীতে ছিলাম উপর-নীচ, পরে হোস্টেলে পাশাপাশি থাকতাম। একে অপরকে ঘনিষ্ঠ ও সম্যকভাবে জানার সুযোগ হয়। শুধু তাই নয় আমাদের পারিবারিক বন্ধনও ছিল সুদৃঢ়। একবার উনার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লে শিশুকন্যা ‘এ্যানি’-কে মাতৃস্নেহে পরিচর্যা করতে দেখেছি। ৩০ বৎসর পূর্বে অর্থাৎ ১৯৮৭ সালে এস.এস.সি পরীক্ষা উত্তীর্ণ একমাত্র কন্যা সন্তানকে রেখে আমার স্ত্রী মৃত্যুবরণ করলে তাঁর পরিবারই হয়ে উঠেছিল আপনজন, বাপ-বেটির শোক লাঘবের আশ্রয়-স্থল।

প্রফেসর হুদা ছিলেন ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন আদর্শবান ও ন্যায়পরায়ণ শিক্ষক। প্রশাসন পরিচালনায় ছিলেন দক্ষ-অভিজ্ঞ ও কূটকৌশলী। আর তাতে প্রতীয়মান হয় কূটনীতিবিদ বা রাষ্ট্রদূত হিসাবে দায়িত্ব পালন করলে তিনি অধিকতর সফলতা অর্জন করতে পারতেন। ছাত্র-শিক্ষকগণ যেমন তাঁকে শ্রদ্ধা-সমীহ করতো, তেমনি ভয়ও পেতো প্রচুর।

একবার জনৈক ছাত্র হোস্টেলে থেকে পরীক্ষা দেয়ার অনুমতি চায়। সিট খালি থাকায় তাকে অনুমতি দেয়া হয়। হোস্টেলে স্থায়ীভাবে বসবাসরত ছাত্ররা তাতে প্রবল আপত্তি জানায়। এটা বিপদজনক হবে বলে হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়। অনুসন্ধানে জানতে পারি ঘটনা সত্য। তাৎক্ষণিকভাবে ছাত্রটির সিট বাতিল করে দেয়া হয়। অতঃপর সে ক্ষিপ্ত হয়ে সব ছাত্র নেতাকে জড়ো করে এর প্রতিবাদ জানায় এবং আমাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। “কোন .....পুত আমাকে এখান থেকে সরাবে তা দেখে নেব”-এরকম হুঁশিয়ারিও সে করেছিলো বলে শুনেছিলাম।

সন্ধ্যা নাগাদ তল্পি-তল্পাসহ ছাত্রটির আসার কথা। একা বিষয়টি মোকাবেলা করা সমীচীন হবে না ভেবে হুদা সাহেবকে সাথে নেই। ছাত্র নেতারা আমাদের দেখে বলে উঠেন: “হালিম স্যারের সাথে হুদা স্যার রয়েছেন- এখানে কিছু করা যাবে না” এই বলে সব সিটকে পড়ে। সাথে সাথে অন্য একজনকে সিট বরাদ্দ দিয়ে দেই। এই ছিলেন হুদা সাহেব যাঁর উপস্থিতিতে সংকটটুকু সহজেই নিরসন হয়েছিল। কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে তিনিও আমাকে সাথে নিয়ে যেতেন এবং বলতেন “বেশী রেগে গেলে নিয়ন্ত্রণ করবেন।” এই ছিল আমাদের অলিখিত বুঝাপড়া।

প্রফেসর হুদা যখন এম.সি. ইন্টারমেডিয়েট কলেজে অধ্যক্ষ হয়ে চলে যান তখন পাশা পাশি হওয়ায় আমি প্রায়ই সেখানে যেতাম। পরবর্তী পর্যায়ে পদোন্নতি পেয়ে প্রফেসর হলে তিনি মৌলভিবাজারে ডিগ্রী কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেবার পরিকল্পনা করেন। বিষয়টিতে বড় বাধা ছিল সেখানকার সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ প্রফেসরের এই শূন্য পদটিকে দখল করে রেখেছেন।

হুদা সাহেব তাঁর প্রবল ব্যক্তিত্বের কারণে এ বাধা অতিক্রম করতে সক্ষম হন এবং কলেজটিতে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পান। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে তিনি ভয়ংকর প্রতিবন্ধকতা ও অসহযোগিতার শিকার হয়েছিলেন। সিলেট এলে প্রায়ই আমার এখানে আসতেন এবং বেশীর ভাগ সময় কাটাতেন। এ সময় তাঁর মধ্যে অস্থিরতা ও অস্বস্তির ভাব লক্ষ্য করেছি। এক পর্যায়ে তিনি আমাকে এম.সি. কলেজে প্রফেসরের শূন্য পদে ফিরে আসতে চান বলে জানান। তাতে মৃদু আপত্তি জানালে তিনি পুঞ্জীভূত মানসিক যন্ত্রণাগুলো এমনভাবে ব্যক্ত করেন যে আমি তাঁর জীবনের নিরাপত্তার বিষয়ে শংকিত হয়ে পড়ি। যাক, সেসব কথা।

একদিন সময় করে উভয়ে ঢাকায় আসি। ডিজি অফিসের সর্বকর্মের হোতা উবধষরহম অংংঃ.আমার পরিচিত। উনার সাথে আলাপ করতেই তিনি ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে বলে উঠেন, “নাইচ্চা নাইচ্চা গেছিলেন কেন?” বললাম- নাচের সময় নাচ দিয়েছি- এখন কি করবেন, করেন। এই বলে আবেদন পত্রটি তার নিকট রেখে চলে আসি। কিছুদিন পর হুদা সাহেব নিয়োগপত্র পেয়ে এম.সি. কলেজে প্রফেসর পদে যোগদান করেন। আবার আমরা একত্রিত হই। আমার অবসর গ্রহণের তিন/চার বৎসর পূর্বে তিনি অবসরে যান। যতদূর মনে পড়ে সে দিনটি তিনি সারাদিন আমার বিপত্মীকের বাসায় গল্প-গুজব করে কাটিয়ে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেন। হুদা সাহেবের সাথে আমার অনেক স্মৃতি বিজড়িত। বয়সের ভারে ন্যুজ্ব হওয়ায় সব কিছু লেখা সম্ভব হলো না।

হুদা সা’বের সাথে কিছু বিক্ষিপ্ত স্মৃতিঃ

আমরা তখন হোস্টেলে পাশাপাশি থাকি। একদিন তিনি কোথাও যাওয়ার অভিপ্রায়ে ব্যাগসহ হন্তদন্ত হয়ে আমার বাসায় আসেন। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বলতে থাকেন- হালিম সা’ব, মা গুরুতর অসুস্থ, বাড়ী যাচ্ছি, বাসার দিকে খেয়াল রাখবেন। তিনি চলে গেলেন।

ফিরে আসলেন মা-সহ । ছোট বেলায় পিতৃহারা জ্যেষ্ঠ সন্তান হিসেবে এই মা-এর অপত্যস্নেহ ও আদরে তিনি আজ এ অবস্থানে এসেছেন, তারই বিশদ বিবরণ আমাকে শোনালেন। মাতৃভক্তি সবারই আছে- তবে তাঁর মাতৃপ্রীতি ও বন্ধন গভীরে প্রোথিত ছিলো।

হুদা সা’বের বাসার পিছনে আমার সহপাঠী বন্ধু ও বিভাগীয় প্রধান বিমল বাবুর বাসা। আমরা তিনজন এক জোট। আমি ও হুদা সাহেবসহ বিমল বাবু তাঁর হোস্টেলের হিন্দু ছাত্রদের নিয়ে শ্রীমঙ্গলের ‘লাউয়াছড়া’য় পিকনিক-এ যাই একবার। আসর বেশ জমজমাট। দুপুরে খাবার পরিবেশন করা হলে হুদা সাহেব ফিসফিস করে বললেন: ‘বলি’ করা মাংস তো খাওয়া যাবে না, মাছ দিয়ে খেয়ে নেব। বিমল বাবু শুনে রেগে গেলেন। ধমক দিয়ে বললেন, লেখাপড়া শিখে উচ্চ শিক্ষিত হয়ে একি মনোভাব! তাঁর উত্তেজিত ধমকে আমরা নিশ্চুপ। হুদা সাহেব আমার দিকে তাকালেন। বললাম, বিসমিল্লাহ বলে খেয়ে ফেলেন। আমাদের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন ছিল সুদৃঢ়।

রাজশাহী বোর্ডের চেয়ারম্যান শ্রদ্ধেয় আযীয সাহেব। তিনি প্রফেসর মাওলানা আব্দুল মান্নান (রাষ্ট্র বিজ্ঞান), প্রফেসর হুদা (রাষ্ট্র বিজ্ঞান) ও আমাকে (দর্শন) গড়ফবৎধঃরড়হ-এর জন্য নিয়োগ দেন। মান্নান সাহেব ও হুদা সাহেবের বিষয় এক হওয়ায় তাদের তারিখ ছিল অভিন্ন- আমার ভিন্ন। বিষয়টি জেনে হুদা সাহেব চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে যোগাযোগ করেন। পরবর্তীতে সংশোধনী এলে অভিন্ন তারিখ করা হয়। হুদা সাহেবের তৎপরতায় চেয়ারম্যান সাহেবের সৌজন্যতা ও আপ্যায়নে সেদিন যে আনন্দ উপভোগ করেছিলাম তা আজও আমার স্মৃতিতে অম্লান। বিমল বাবু, মান্নান সাহেব ও হুদা সাহেব কেউ আজ বেঁচে নেই- বেঁচে আছি আমি শোক স্মৃতি বহন করে।

অবসরোত্তর হুদা সাহেব তখন সিলেট-এ শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ। আমি ঢাকায়। উনার ছোট ছেলের বিয়ে। আমন্ত্রণ জানানো হয় আমাকে। শরীর অসুস্থ-দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও সাহস করে চলে এলাম। যখন পৌঁছলাম তখন ১ম পর্বের ভোজন প্রায় শেষ। আমার আকস্মিক আবির্ভাবে সবাই বিস্মিত হয় উঠে এবং বলতে থাকে-এবার হুদা সাহেবের ষোলকলা পূর্ণ হলো। আমাদের অন্তরঙ্গতার কথা সবারই জানা- এ মুহুর্তে এরই বাস্তব প্রতিফলন ঘটলো পুনরায়।

লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ এম.সি কলেজ সিলেট।