গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত গণবিরোধী

গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত গণবিরোধী

মুজতাহিদ ফারুকী

সর্বস্তরের জনগণের প্রবল আপত্তি উপেক্ষা করেই সব পর্যায়ে গ্যাসের দাম গড়ে ৩২.৮ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। সেই বাড়তি দাম কার্যকরও হয়ে গেছে গত সোমবার থেকে। এখন থেকে আবাসিক গ্রাহকদের এক চুলার জন্য মাসে ৯২৫ টাকা এবং দুই চুলার জন্য ৯৭৫ টাকা দিতে হবে, যা এত দিন ছিল ৭৫০ টাকা ও ৮০০ টাকা। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) রোববার এক গণবিজ্ঞপ্তিতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর এ ঘোষণা দেয়।

গৃহস্থালিতে মিটারে যারা গ্যাসের বিল দেন, তাদের প্রতি ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহারের জন্য ১২ টাকা ৬০ পয়সা করে দিতে হবে। এত দিন প্রতি ঘনমিটারে তাদের বিল হতো ৯ টাকা ১০ পয়সা। অর্থাৎ, রান্নার গ্যাসের জন্য চুলাভিত্তিক গ্রাহকদের প্রতি মাসে ২৩ শতাংশ এবং মিটারভিত্তিক গ্রাহকদের ৩৮ শতাংশ বেশি অর্থ খরচ হবে।

বর্তমানে দেশে গ্যাসের আবাসিক চুলার সংযোগ রয়েছে প্রায় ৩৮ লাখ। নির্দিষ্ট হারে মাসিক বিলের পরিবর্তে গ্যাসের চুলায় প্রিপেইড মিটার বসানোর কাজ চলছে। এরই মধ্যে দুই লাখ গ্রাহককে প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনা হয়েছে। এই দুই লাখ গ্রাহককে এখন ৩৮ শতাংশ বেশি অর্থ ব্যয় করতে হবে গ্যাস খাতে।

যানবাহনে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাসের (সিএনজি) দাম সোমবার থেকে প্রতি ঘনমিটারে ৩৮ টাকা থেকে বেড়ে ৪৩ টাকা করা হয়েছে। এই হিসাবে গাড়ির গ্যাসের জন্য মালিকদের খরচ বাড়বে সাড়ে ৭ শতাংশ। স্বাভাবিকভাবেই গণপরিবহনে এর প্রভাব পড়বে; এর মাশুল দিতে হবে যাত্রীদের। সেই সাথে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সার, শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে ৩৫ থেকে ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত। ফলে শিল্পপণ্য উৎপাদনে খরচ বাড়বে। তাতে অবশ্য শিল্পোদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ীদের খুব একটা সমস্যা হবে না। কারণ, তারা দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দিয়ে ক্রেতাদের কাছ থেকেই তা আদায় করবেন।

ফলত গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণে যা কিছু চাপ এবং ভোগান্তির জ্বালা, তার সবটাই সইতে হবে মূলত এবং একমাত্র এ দেশের সাধারণ মানুষ তথা জনগণকে।

বিইআরসির চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কম থাকায় সেই তেল বিক্রি করে গত কয়েক বছর ধরেই লাভ পাচ্ছে সরকার। ফলে গ্যাস আর বিদ্যুতে ভর্তুকি দিতে হলেও সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে সরকারকে গত অর্থবছরে কোনো ভর্তুকি গুনতে হয়নি। তার পরও আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি জাতীয় গ্রিডে যোগ হওয়ায় যে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে, তা ‘সমন্বয় করতে’ এবার গ্যাসের দাম বাড়ানো হলো। এর মানে দাঁড়াল, সরকার নিজের কোষাগারে জনগণের টাকাই সঞ্চয় করছে এবং বেশি দামে প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করে সেই বেশি দামের খেসারতও জনগণের ওপরই চাপিয়ে দিচ্ছে। এটা নিঃসন্দেহে একটা অনৈতিক অবস্থান। কোনো গণতান্ত্রিক বা গণবান্ধব সরকারের কাছে এমন অবস্থান নেয়া কাম্য হতে পারে না।

এ পরিস্থিতিতে গৃহস্থালিতে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে আগামী ৭ জুলাই সারা দেশে অর্ধদিবস হরতাল ডেকেছে বাম জোট। সোমবার তারা এ ঘোষণা দিয়েছেন।

সিপিবির নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, জনগণের মতামত তোয়াক্কা না করে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করে দেশবাসীর ওপর ব্যয়ের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এর আগে বাজেটে ভ্যাটের নামে দেশের মানুষের ওপর ব্যয়ের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। গ্যাসের দাম বাড়িয়ে গণবিরোধী সরকার আরেকবার জনগণের ওপর ব্যয়ের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। তারা বলেন, ‘দুর্নীতি ও ভুলনীতি পরিত্যাগ করলে গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরিবর্তে কমানো সম্ভব।’ বাম রাজনীতিকদের এই হরতাল গত এক দশকের হরতালমুক্ত রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন একটি ক্ষুদ্র সংযোজন হবে মাত্র। তার বেশি কিছু নয়। কারণ, অতীতে এমনও দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকার পুলিশ দিয়ে বাম জোটের ডাকা হরতাল সফল করার দায়িত্ব নিয়েছে। এই পাতানো খেলা রাজনীতির একটি হাস্যকর উদাহরণই কেবল হতে পারে, কার্যকর রাজনীতি নয়।

এ দিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি গ্যাসের দাম বাড়ানোকে অযৌক্তিক বলে অভিহিত করে এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে দলটি গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা বাদে সারা দেশে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন এবং ঢাকা মহানগরীর থানায় থানায় মিছিল করেছে।

এর আগে ২০১৭ সালের ১ মার্চ থেকে গ্যাসের দাম গড়ে ২২ দশমিক ৭০ শতাংশ বাড়িয়েছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার। এলএনজি আমদানির প্রেক্ষাপটে বিতরণ কোম্পানিগুলো গত বছর আবাসিক ও বাণিজ্যিক সংযোগ বাদে অন্য ক্ষেত্রে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করলেও ভোট হারানোর ভয়ে নির্বাচনের আগে সরকার সেই প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি। এরপর চলতি বছরের শুরুতে গ্যাসের দাম বাড়াতে আবার তোড়জোড় শুরু করা হয়। পেট্রোবাংলা এবং বিতরণ সংস্থাগুলোর প্রস্তাবের ওপর ১১ থেকে ১৪ মার্চ গণশুনানি করে বিইআরসি। ওই শুনানির মধ্যেই ভোক্তা অধিকার সংগঠন, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক দলসহ সমাজের বিভিন্ন অংশ গ্যাসের দাম বৃদ্ধির উদ্যোগের বিরোধিতায় সরব হয়ে ওঠে। কিন্তু সরকার কোনো আপত্তি বা বিরোধিতারই তোয়াক্কা করেনি। কারণ এখন তারা জানেন, রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা বা থাকার জন্য জনগণের ভোটের আদৌ দরকার নেই।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন- ক্যাবের এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট থেকে বলা হয়, পেট্রোবাংলা ও তিতাসের দুর্নীতি ৫০ ভাগ কমালেই এলএনজি আমদানির কারণ দেখিয়ে গ্যাসের দাম বাড়াতে হবে না।

আমরা জানি, গ্যাস খাতে সরকারের কোনো লোকসান নেই; বরং প্রতি বছরই এ খাতে আয় বাড়ছে। এমনকি গত দুই বছরে আয় বেড়েছে দ্বিগুণ। পরিসংখ্যান বলছে, গত দুই বছরে সরকার গ্যাস খাত থেকে ছয় হাজার ৯৬২ কোটি টাকা বেশি আয় করেছে। তবুও এক রকম গায়ের জোরেই গ্যাসের দাম বাড়াল সরকার। গত পাঁচ বছরে গ্যাসের দাম বেড়েছে দুইবার। ২০১৫ সালের পর ২০১৭ সালেও বাড়ানো হয় গ্যাসের দাম। উচ্চমূল্যে গ্যাস বিক্রির ফলে দুই বছরেই এ খাত থেকে সরকারের আয় বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণের বেশি। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে পেট্রোবাংলা ও এর অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের কোষাগারে ছয় হাজার ২০৪ কোটি টাকা জমা দিলেও সর্বশেষ ২০১৭-১৮ অর্থবছর এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা।

পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, এক দশক ধরে গ্যাস খাত থেকে সরকারের আয় বাড়ছে ধারাবাহিকভাবেই। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে এ খাত থেকে সরকারের আয় ছিল দুই হাজার ৮০২ কোটি টাকা। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে এ আয় ছিল তিন হাজার ২৬৩ কোটি এবং ২০০৯-১০ অর্থবছরে তিন হাজার ৯৬০ কোটি টাকা। ২০১০-১১ অর্থবছরে গ্যাস খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আয় ছিল চার হাজার ১৬৮ কোটি টাকা, ২০১১-১২ অর্থবছরে রাজস্ব আসে চার হাজার ৫৩৮ কোটি ৩৩ লাখ, ২০১২-১৩ অর্থবছরে পাঁচ হাজার ৫৮৬ কোটি ৫৮ লাখ এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছরে পাঁচ হাজার ৩৭৭ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এ ছাড়া ২০১৪-১৫ অর্থবছরে আয় হয়েছিল ছয় হাজার ২০৪ কোটি ২৫ লাখ টাকা।

২০১৫ সালে গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে আয়ও বেড়ে হয় সাত হাজার ৫২১ কোটি টাকা। পরের বছর গ্যাস খাত থেকে সরকারের আয় আরো বেড়ে ১৩ হাজার ১৮৯ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। আয় বৃদ্ধির এ ধারা গত অর্থবছরেও অব্যাহত ছিল। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে গ্যাস খাত থেকে সরকারের আয় বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা।

গ্যাস খাত থেকে সরকারের আয়বৃদ্ধির পাশাপাশি পেট্রোবাংলা ও এর অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফাও বেড়েছে। জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পেট্রোবাংলা মুনাফা করে ৯২০ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। সর্বশেষ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সংস্থাটি মুনাফা করেছে ৯৬৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।

অতসব পরিসংখ্যান তুলে ধরার একটাই লক্ষ্য, সেটা হলো এ মুহূর্তে জ্বালানি গ্যাসের দাম বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই, সেটি অনুধাবনে জনগণকে সাহায্য করা। কারণ, এই সরকারকে কিছু বলে আসলে লাভ নেই। আমরা এ কথাগুলো আগেও নানাভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। সরকার যাতে অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত না নিয়ে জনবান্ধব হিসেবে জনগণের পাশে থাকে, সেই আহ্বান জানিয়েছি। তাতে কাজ হয়নি।

এ দিকে সরকার জ্বালানি অনুসন্ধানে তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেনি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কোনো নতুন জ্বালানি ক্ষেত্র আবিষ্কার করতে পারেনি। সমুদ্রসীমা সম্পর্কিত বিরোধের এক ধরনের মীমাংসা হয়ে যাওয়ার পর মিয়ানমার-সংলগ্ন সামুদ্রিক ব্লকে অবিলম্বে অনুসন্ধান ও কূপ খননের কাজ শুরু করা দরকার ছিল, যেটা মিয়ানমার করেছে এবং এরই মধ্যে সেখান থেকে গ্যাস উত্তোলন করছে। আমরা পারিনি, সেই দায় জনগণের নয়, সরকারের। বিশেষজ্ঞরাও বিভিন্ন সময় বলেছেন, দেশের জ্বালানি সঙ্কটের একমাত্র সমাধান হলো নতুন গ্যাসক্ষেত্র খুঁজে বের করা।

জ্বালানি বিশ্লেষক বিডি রহমত উল্লাহর বরাত দিয়ে নয়া দিগন্তের এক রিপোর্টে বলা হয়েছিল, তিনি বলেন, ‘আমাদের সমুদ্রবক্ষে যথেষ্ট গ্যাস আছে। যদি সেগুলো অনুসন্ধান ও উত্তোলন করা হতো, তাহলে এখন যে গ্যাস সঙ্কট রয়েছে তা হতো না। উচ্চমূল্যের জ্বালানি আমদানি করার প্রয়োজন হতো না।’

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানিগুলো লাভে থাকলে বিইআরসি আইন অনুযায়ী গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিতে পারে না। দেশে গ্যাস সঞ্চালন কোম্পানি একটি। আর বিতরণ কোম্পানি তিতাস, বাখরাবাদ, কর্ণফুলীসহ ছয়টি। এর মধ্যে একটি সুন্দরবন ছাড়া বাকি পাঁচটি কোম্পানি লাভে রয়েছে। একমাত্র সঞ্চালন কোম্পানি জিটিসিএলও লাভজনক। তাই এ মুহূর্তে গ্যাসের দাম বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই।