নাটাই কার হাতে!

নাটাই কার হাতে!

মুজতবা খন্দকার

খুশীতে আটখান হবার কিছু নেই। কিন্তু বিস্মৃতিপ্রবণ বিএনপি নেতারা তাই হচ্ছেন। চোখে মুখে তার ইংগিতটা স্পষ্ট। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন গঠণ নিয়ে বিএনপির সাথে আলোচনা করতে সময় দিয়েছেন। এতেই বিএনপি নেতারা খুশীতে বাকবাকুম করছেন। কিন্তু তাদের জানা আছে, কিন্তু স্মৃতি প্রতারণায় তারা ভুলে গেছেন, প্রেসিডেন্টের ডাকে তারা এর আগেও গিয়েছিলেন। সেবারও বিষয় ছিলো নতুন নির্বিাচন কমিশন গঠন।

সেদিন আলোচনার পর, রাষ্ট্রপতি প্রথা ভেঙ্গে একটি সার্চ কমিটি গঠণ করেছিলেন। সেই সার্চ কমিটির আবিস্কার ছিলো আজকের রকিব কমিশন। তার পরের ইতিহাস তো বিএনপি কেন সবারই জানা। সরকারের বশংবদ একটি কমিশন কত ভাবেই না বিএনপিকে মেলাইন করেছিল, এখনো করছে। সুতরাং রাষ্ট্রপতি আলোচনার জন্য ডেকেছেন বলে একটি দেবদূত নির্বাচন কমিশন হবে বলে যারা ভাবছেন, বিএনপির সেইসব নেতাদের বলি “ধীরে রজনী ধীরে...”

বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা এমনি যে এখানে রাষ্ট্রের প্রধান হলেও তার আক্ষরিক অর্থে কিছু করণীয় নেই। আবার এটাও ঠিক করণীয় থাকতো তিনি চাইলে সরকারের লাগাম টেনে ধরতে পারতেন, যদি তিনি নিজ স্বার্থ বিবর্জিত হতে পারতেন...কিন্তু বঙ্গভবনের ওই সাদা বাড়িতে এতদিন যারা বাস করেছেন, তাদের কজন পেরেছেন, সরকারের বিরুদ্ধে তার মেরুদণ্ড ঋজু রাখতে?

হ্যাঁ মনে পড়ে কেবলমাত্র একজন পেরেছিলেন। তিনি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ।তিনি ছিয়ানব্বই থেকে দু’হাজার এক সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। মনে পড়ে ’৯৮ সালে তিনি একটি অর্থবিলে সই না করে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। সে সময়ের আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে চরম টানাপোড়েন হয়েছিলো তার সাথে।

শেখ হাসিনা তখনই বুঝেছিলেন, সাহাবুদ্দীন কি জিনিস! এই পণ্ডিত ব্যক্তি, এখন ইতিহাসের ক্লোজ চ্যাপ্টার। কেউ তাকে স্মরণ করে না। অকৃতজ্ঞ জাতি কাকে বলে, অথচ জাতির ক্রান্তিকালে এরশাদ পতনের পর তিনি দায়িত্ব নিয়েছিলেন অন্তর্বর্তি সরকারের প্রধান হিসেবে। ছিলেন দেশের প্রধান বিচারপতি। একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন করে, আবার ফিরে গিয়েছিলেন তার স্ব দায়িত্বে।

তিনি বাংলাদেশের একমাত্র প্রধান বিচারপতি, যিনি জুডিশিয়ারী কিম্বা আইন পেশায়ও নয় প্রশাসন ক্যাডার থেকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন। এ ধরনের ইস্পাত কঠিন, ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিত্ব, আমাদের জন্য নয়। তিনি ভুল সময়ে ভুল দেশে জন্মেছিলেন বলে আমরা তাকে ভুলেও স্মরণ করি না।
অথচ অন্য দেশ হলে তিনি হতেন, প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি!

মাননীয় রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, রসিক জন। তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান। স্পিকার হিসেবেও ছিলেন অনন্য। তিনি যখন স্পিকার ছিলেন, তখন তার রসবোধের সাথে আমরা কম বেশী পরিচিত ছিলাম। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে নাৃ তার মৌলিক পরিচয় হচ্ছে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে মনোনীত। তার পুত্রকে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিয়ে কিশোরগঞ্জে তার ইটনা মিঠা মইন আসন থেকে এমপি বানিয়েছে।

সুতরাং তিনি ডেকেছেন একটি নির্ভুল, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনে বিএনপির সুপারিশ জানতে! সবাই বিশ্বাস করলেও আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। রবী ঠাকুর বলেছিলেন, মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ ঘর পোড়া গরুর মতন... তাদের বিশ্বাস যেভাবে হরণ করা হয়েছে, তাদের নতুন করে কারো প্রতি বিশ্বাস করানো বড্ড কঠিন।

সরকার চলে একটি রুলস বিজনেসে। সেই রুলস অফ বিজনেস অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতির একা কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার নেই। সব কিছুই তাকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিয়েই করতে হয়।

তাহলে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে কেন আলোচনা করতে চাইছেন? আসলে আলোচনা তো তিনি করতে চাননি। বিএনপি চাতক পাখির মত তার করুণা ভিক্ষা করেছে। সব কিছু জেনেও। সুতরাং, তিনি ভদ্রলোক, তিনি জানেন তার হাত-পা বাধা সংবিধান এবং আইনের ধারা অনুচ্ছেদ দিয়ে, তবু কে না চায়ৃ নিজেকে মহৎ করে জনগণের কাছে প্রতিভাত করতে... আর তিনি তো রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতি গালভরা শব্দ; বস্তুত তার ক্ষমতা কতটুকু, বিদ্যমান বাস্তবতায় সেটা বিএনপিও জানে, জানেন স্বয়ং তিনিও!

তাই বলি, আহলাদে গদগদ হবার কিছু নেই। প্রধানমন্ত্রী কদিন আগে গণভবনের সংবাদ সম্মেলন থেকে স্বাভাবিক কারণেই, বেশ দৃঢ়তার সাথেই তাই বলতে পেরেছেন, রাষ্ট্রপতি যা করবেন, সেটা আওয়ামী লীগ মেনে নেবে। কারণ প্রধানমন্ত্রী জানেন, সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি নামক ঘুড়িটির নাটাই কিন্তু তার হাতেই!

তবুও বিএনপিকে ধন্যবাদ। তারা রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে রাষ্ট্রপতিকে মেনে নিয়েছে। অকপটে, কোনপ্রকার দ্বিধা ছাড়াই। এক্ষেত্রে আমরা স্মরণ করতে পারি প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দীনকে। ২০০২ সালে প্রফেসর ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে অভিশংসন করার পর বিএনপি যখন তাকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনীত করে, তখন আওয়ামীলীগ শুরু থেকেই তার বিরোধীতায় নেমেছিলো। তাকে কখনো মাননীয় তো দূরে থাক সঠিকভাবে তার নামটাই উচ্চারণ করেনি আওয়ামী, লীগ তাকে শ্লেষ ভরে বলতো ইয়েসউদ্দীন।

তার কিছু অতিরঞ্জণ ছিলোৃ সেটা প্রথম দিকে নয়ৃ কিন্তু প্রথম থেকেই রাষ্ট্রের এক নম্বর ব্যক্তিকে নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের যে তাচ্ছিল্য আমরা দেখেছি... তাতে মনে হয়েছিলো আদপে দলটি নিজেদের কৌলিন্যটাকেই ঐতিহ্যগতভাবে সত্য মনে করে। তারা ভুলে যায়ৃ তাদের গায়ে গণতন্ত্রহরণকারী হিসেবেও একটি অমোচনীয় সিল লেপ্টে আছে। তারাও ভুলে যায়ৃ আওয়ামী লীগ দলটি এক সময় গণতন্ত্র বিলুপ্ত করে দিয়ে, বাকশাল নামের একটি ফ্যাসিষ্ট মতবাদ বাংলার গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছিলেন।

০২.
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল সংক্ষেপে ডিআই সম্প্রতি একটি জরিপ রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। ডি আই তাদের জরিপে দেখিয়েছে এখুনি নির্বাচন হলে ক্ষমতাসিন দল পাবে শতকরা ৩৮ ভাগ ভোট, আর মাঠের বিরোধী দল বিএনপি পাবে মাত্র পাঁচ শতাংশ ভোট!

ডি আই এর একটি সুনাম আছে বিশ্বব্যাপী। তারা সুশাসন, অংশগ্রহণমূলক নির্বিাচন এবং গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের পক্ষে কাজ করে। মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার এর সাথে সম্পৃক্ত। কিন্তু এবার তাদের এই জরিপ বেশ কৌতুলোদ্দীপক সন্দেহ নয়!

ডি আই এর জরিপ রিপোর্ট লিমিটেড গণতন্ত্রের সরকারকে বেশ স্বস্তি দিয়েছে বলে শুনেছি। তারা বলছে দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে নিতে পারায় জনগণ তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ সেটাই নাকি জরিপের ফলাফলে বেরিয়ে এসেছে! বেশ তাহলে একটি ফেয়ার ইলেকশন তো সরকারের এক্ষুণি দেয়া জরুরী। কি দরকার আছে, অনির্বাচিত সরকারের বদনাম বয়ে পাঁচ বছর পার করার?

০৩.
মাজদার হোসেন মামলার রায় সরকার আশি শতাংশ বাস্তবায়ন করেছে বলে সেদিন অ্যাটর্নী জেনারেলকে সাংবাদিকদের কাছে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে দেখলাম টেলিভিশনের পর্দায়। কিন্তু বিচারবিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করার জন্য সবচেযে বড় যে কাজটা সেটাই করতে কেন জানি সরকার অপারগ।

আইনমন্ত্রণালয়ের দুই সচিবকে কাঠগড়ায় তোলার সমন জারি করলেও যেন, তাতে কুচপরোয়া নেই ভাবটা এমন! অথচ অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়োগ বদলি, পদায়ন, বরখাস্তের এখতিয়ার যতদিন সুপ্রিম কোর্টের হাতে না যাচ্ছে ততদিন বিচারবিভাগ স্বাধীন সেটা বলাটা কতখানি সংগত!

আমরা মনে করতে পারি, চাঁদাবাজির একটি মামলায় বেকসুর খালাস দেয়ায় বিচারক মোতাহার হোসেনের পরিণতির কথা। আজ বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মী মামলা কিম্বা হাজতে পচে মরছে সেটা সরকারের হাতে অধস্তন আদালতের নাটাই রয়েছে বলে... সুতরাং অগণতান্ত্রিক, অনির্বাচিত সরকারের ক্ষমতায় থাকার একমাত্র জিয়নকাঠি তো ওটা... আর সেটা যদি কোনক্রমে ফসকে যায়ৃ তবে... এই তবের কারণে.. সরকার নিম্ন আদালত নিয়ে কাইজা করে চলছে সুপ্রিম কোর্টের সাথেৃ কিন্তু আখেরে সরকারের শেষ রক্ষা হবে কি?

সময় বলে দেবে, আমরা বরং সময়ের অপেক্ষায় থাকি!

মুজতবা খন্দকার : সাংবাদিক, কলামিস্ট।