বেচে আছি-৫

নির্দেশ পালন : ভাষা আন্দোলনে ও ট্রাম্প প্রশাসনে

নির্দেশ পালন : ভাষা আন্দোলনে ও ট্রাম্প প্রশাসনে

শফিক রেহমান
১৯৫২’র ফেব্রুয়ারিতে আমার পিতা সাইদুর রহমান ছিলেন ঢাকা কলেজের ছাত্রপ্রিয় শিক্ষক। যুগপৎ তিনি ছিলেন ঢাকা কলেজ হস্টেলের সুপারিনটেনডেন্ট। তিনি ফিলসফিতে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে বিএ অনার্স ও এমএতে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিলেন। প্রথমে রাজশাহী কলেজ, তারপর কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজ (১৯৪৭-এ পরিবর্তিত নাম ক্যালকাটা সেন্ট্রাল কলেজ এবং ১৯৬০-এ পুনঃপরিবর্তিত ও বর্তমান নাম মাওলানা আজাদ কলেজ) এবং ইনডিয়া বিভক্তির পর পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকা কলেজে ফিলসফিতে শিক্ষকতা করছিলেন।

বস্তুত ফিলসফি বা দর্শনে শুধু ডিগৃ নেয়া এবং ছাত্র পড়ানোতেই তিনি সীমাবদ্ধ থাকেন নি- এ বিষয় নিয়ে তিনি আজীবন চর্চা করে গিয়েছিলেন এবং আধুনিক ফিলসফি বিষয়ে জ্ঞান রাখতেন। ইসলামিক ফিলসফি বিষয়ে একটি দীর্ঘ ইংরেজি বই তিনি লিখেছিলেন যেটা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পাঠ্য বই ছিল। বলা যায়, ফিলসফি তার জীবন জড়িয়ে ছিল। আর তাই তিনি অন্যায়, অবিচার ও দুঃখ দেখলে তার কারণ ও প্রতিকারের পথ খুজতেন। নির্যাতিত- অসহায়দের সর্বতোভাবে সাহায্য করতেন।

অন্যায়-অসাম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন। কারণ, তিনি তার বিবেক দ্বারা চালিত হতেন এবং যখন তিনি সঙ্গত বোধ করতেন, তখন তিনি ওপরের নির্দেশ না মেনে বিবেকের নির্দেশ মানতেন। ফলে শিক্ষকতাতে (যেটা ছিল সরকারি চাকরি) তাকে বহুবার সংকট ও বিপদে পড়তে হয়েছিল।

কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে শিক্ষকতার সময়ে (১৯৪২-১৯৪৭) তিনি যুগপৎ বেকার হস্টেলের সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন, যেখানে শেখ মুজিবুর রহমান তার ছাত্র ও রেসিডেন্ট ছিলেন। এই সময়েই শেখ মুজিবের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে, বিশেষত রাজনৈতিক কারণে। তারা দুজনই ইনডিয়া বিভক্ত করে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মলাভের পক্ষে ছিলেন। সেটাই ছিল সেই সময়ের সাধারণ মুসলমানদের দাবি। তারা ধর্মীয়ভাবে মুসলিম হওয়ায় শ্রেণিগতভাবে ছিল শোষিত সমাজ। যুগ যুগব্যাপী সমাজে সসম্মান ও অস্তিত্বহীন অবস্থায় থাকার পরে তারা চাইছিল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তান যেখানে তারা মনে করেছিল মুসলমানরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি পাবে। স্বাধীন চেতনা এবং মুক্তবুদ্ধির ধারক ও সক্রিয় কর্মী, কিন্তু সরকারি চাকুরে, সাইদুর রহমান এই কারণে প্রথমে বৃটিশবিরোধী এবং পরে পাকিস্তানের মুসলিম লীগ শাসনবিরোধী হয়েছিলেন। মুসলিম সম্প্রদায়ের সসম্মানে বেচে থাকার দাবি সাম্প্রদায়িকতা ছিল না- এটা ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের মতোই নিজ সম্প্রদায়ের আত্ম নিয়ন্ত্রণের দাবি ও স্বাধীনতার দাবি।

ফেব্রুয়ারি ১৯৫২-তে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলন সূচিত হলে সাইদুর রহমান তার সহজাত কারণে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ও আন্দোলনকারী ছাত্রদের পক্ষে প্রকাশ্য ভূমিকা নেন। সেই সময়ে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছিল ঢাকা মেডিকাল কলেজের ছাত্ররা, যারা থাকত ঢাকা মেডিকাল কলেজ হস্টেলে। তারা অগ্রণী ভূমিকায় ছিল। এখন যেখানে শহীদ মিনার, সেখানে এই হস্টেলগুলি ছিল। কোমর অবধি ইটের দেয়াল তারপর সেখানে থেকে টিনের ছাদ অবধি চাটাইয়ের বেড়ার দেয়ালে ছিল সেসব হস্টেল। চাটাইয়ের বেড়ার মাঝে মধ্যে ছিল পাতলা কাঠের জানালা। ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী সারিতে ছিল ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা, তারপরে ছিল ঢাকা কলেজের ছাত্ররা এবং তারপরেই ছিল দেশের বাদবাকি সব শিক্ষায়তনের ছাত্রছাত্রীরা।

আন্দোলনের তৃতীয় স্তরে ঢাকা কলেজ থাকলেও তারা প্রথম শ্রেণির সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপৃত ছিল। কলেজে এসব আন্দোলনকারীদের অন্যতম ছাত্রনেতা ছিল মেধাবী ছাত্র ইনাম আহমেদ চৌধুরী। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২-তে প্রথমে লাঠিচার্জ, তারপর টিয়ার গ্যাস শেল ছোড়ার পর পুলিশ গুলি চালায়। এসব ঘটছিল মেডিকাল কলেজের উত্তর দিকের গেইটের কাছে এবং ওই কলেজের হস্টেলের চারপাশে। অনেক ছাত্র আত্মরক্ষার জন্য হস্টেলের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু বুলেট থেকে আত্মরক্ষা সম্ভব হয়নি চাটাইয়ের বেড়ার ঘরে। ছাত্ররা হতাহত হয়। নিহতের সংখ্যা নিয়ে মিনিটে মিনিটে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ছিল। ধারণা করা হচ্ছিল মৃতদেহ সরিয়ে নিচ্ছিল পুলিশ কোনো গোপন স্থানে কবর দেয়ার জন্য অথবা পুড়িয়ে ফেলার জন্য।

পরবর্তী দিনগুলিতে পূর্ব পাকিস্তানি তথা পাকিস্তানি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে ঢাকা কলেজ কর্তৃপক্ষের প্রতি নির্দেশ আসে আন্দোলনকারী ছাত্রদের বিরুদ্ধে সমুচিত ব্যবস্থা নিতে। তখন ঢাকা কলেজের ছয়টি হস্টেল ছিল : ৩৭ বেচারাম দেউড়ি, হাসিনবাগ, নূরপূর ভিলা, মোস্তফা হাউজ, আরমানিটোলায় বান্ধব কুটির ও সিদ্দিক বাজারে আগা সাদেক রোডে। এর মধ্যে প্রথম চারটির সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন সাইদুর রহমান। ফলে তার সঙ্গে আগে থেকেই ছাত্রদের ঘনিষ্ঠতা ও সুসম্পর্ক ছিল। ঢাকা কলেজের পৃন্সিপাল ছিলেন শামসুজ্জামান চৌধুরী। তিনি সাইদুর রহমানকে কতিপয় নির্দেশ দেন, যেটা সাইদুর রহমানের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব ছিল না। কারণ, এ ধরনের রাজনৈতিক সংকটে তিনি চলতেন বিবেকের নির্দেশ অনুযায়ী। পৃন্সিপালের অন্যতম নির্দেশ ছিল ইনাম আহমেদ চৌধুরী (বর্তমানে বিএনপি নেতা)সহ আরো কিছু ছাত্রকে কলেজ থেকে এক্সপেল বা বহিষ্কার করতে। এর ফলে ভবিষ্যতে বহু মেধাবী ছাত্র সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত হতো। সাইদুর রহমান এত মেধাবী ছাত্রদের এত নিষ্ঠুর পরিণতি চাননি। এ বিষয়ে তিনি লিখে গিয়েছেন তার আত্মজীবনীমূলক বই ‘শতাব্দির স্মৃতি’-তে (অনলাইনে রকমারিতে rokomari.com-এ খোজ করুন)। কিছু অংশ পড়ুন :

বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের জের পরবর্তী বছরেও দেখে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন সংসদ অধিবেশনে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ঘোষণা করা হলো, পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হবে দুটি- উর্দু ও বাংলা। বাঙালিরা যেমন উর্দু শিখবে, অবাঙালিরা তেমনি বাংলা শিখবে। বলা বাহুল্য, শেষ পর্যন্ত এর কোনোটাই সম্ভব হয়নি।
১৯৫৩ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের মধ্যে একটা উত্তেজনা পরিলক্ষিত হয়। তারা ১৯৫২-এ ফেব্রুয়ারিতে ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে কলেজের মধ্যে একটি শহীদ মিনার নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করে। সে সময় ঢাকা কলেজের পৃন্সিপাল ছিলেন শামসুজ্জামান চৌধুরী। অত্যন্ত রক্ষণশীল এই ব্যক্তি কলেজ প্রাঙ্গণে শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য ছাত্রদেরকে অনুমতি দিতে কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। অন্যদিকে শহীদ মিনারের জন্য ছাত্ররা মরিয়া হয়ে ওঠে। এমনকি তারা ধর্মঘট পর্যন্ত করে বসে।

আমি ছিলাম কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত অধ্যাপক এবং ইনাম আহমদ চৌধুরী ছিল ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য ছাত্রদের নেতৃত্ব দেয়া ছাড়াও কলেজ বার্ষিকীতে অনুষ্ঠিত সভায় বাংলা ভাষার প্রতি সমর্থন জানানো হয় এবং অনেক প্রগতিশীল ও সরকারবিরোধী ব্যক্তিত্বকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। বিষয়টায় কলেজ কর্তৃপক্ষের দারুণ খটকা লেগেছিল। সভার পর তৎকালীন ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার ও কলেজের গভর্নিং বডির প্রেসিডেন্ট পীর আহসানউদ্দীন এই নিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং আলাপ করে এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, ছাত্রদের নেতৃত্ব আমার হাতে। অতএব আমাকে চব্বিশ ঘণ্টার নোটিশে সিলেটে বদলি করা হয়।

অন্যদিকে ইনাম আহমদকে ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে বরখাস্ত এবং কলেজ থেকে বহিষ্কার করার নির্দেশ দেয়া হয়। তবে শেষ পর্যন্ত ইনামকে কলেজ থেকে বহিষ্কারাদেশ কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। যেহেতু তার বাবা গিয়াসউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন একজন উচ্চপদস্থ ও প্রভাবশালী আমলা। ইনাম আহমদ অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিল।

... ১৯৫৩ সালের ৩০ এপৃল সিলেট সরকারি কলেজে গিয়ে যোগদান করি। মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের বড় ছেলে বেকার হস্টেলে থাকার সময় আমার ছাত্র ছিল এবং দ্বিতীয় ছেলে আনোয়ারুল আমিন ছিল ঢাকা কলেজের ছাত্র। দুজনের সঙ্গে আমার ছিল খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। দুজনেই আমাকে খুব মান্য ও শ্রদ্ধা করত। আমার বদলির সংবাদ পেয়ে ওরা আমাকে ঢাকায় রাখার জন্য ওদের বাবার ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু আমার ইচ্ছা ছিল না মুখ্যমন্ত্রীর অনুকম্পায় ঢাকায় থাকার। বদলির হুকুম যাতে নড়চড় করতে না পারে সে জন্য অতি সত্বর সিলেট গিয়ে জয়েন করেছিলাম। কারণ ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের ওপর আমার বিন্দুমাত্র ভক্তি ও আস্থা ছিল না। ওদের প্রতি এক রকম ক্রোধই পোষণ করতাম। আমি জানতাম, মুসলিম লীগের অবস্থা খুবই শোচনীয় এবং কিছু দিনের মধ্যে (১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচন) যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে তাতে ওদের ভরাডুবি অনিবার্য। কাজেই ওই সরকারের তরফ থেকে কোনো রকম করুণার প্রতি ঘৃণাই পোষণ করতাম।...

 

... সিলেট কলেজের অধ্যক্ষ সোলেমান চৌধুরী আমার সঙ্গে কখনো দুর্ব্যবহার না করলেও ভালো চোখে দেখতেন না। তিনি আমার সিআর-এ লিখেছিলেন যে, আমার গতিবিধি নজরে রাখার দরকার যেহেতু আমি বস্তুবাদী চিন্তাধারায় বিশ্বাসী এবং আমার মতামত খোলাখুলিভাবে সকলের সামনে সামনে ব্যক্ত করে থাকি।’ (পৃষ্ঠা-৬৭ ও ৬৮)

কোনো ব্যক্তি যদি ওপরের নির্দেশ না মেনে নিজের বিবেকের নির্দেশ মেনে চলেন, তাহলে তার প্রতিক্রিয়া তার পরিবারের ওপরও এসে পড়ে। সাইদুর রহমানের বেলায়ও তাই হয়েছিল। রাতারাতি তাকে সিলেটে মুরারি চাদ কলেজে বদলি করে দেয়ার ফলে সবচেয়ে বড় পারিবারিক বিপদ হলো ঢাকায় আমাদের বাসস্থান নিয়ে। সাইদুর রহমান হস্টেল সুপারিনটেনডেন্ট পদে থাকার ফলে তার পরিবারের জন্য যে কোয়ার্টার্স পেয়েছিলেন বেগম বাজার ৩৭ বেচারাম দেউড়িতে, সেটা অনতিবিলম্বে ছেড়ে দিলে তার চার সন্তান নিয়ে ঢাকায় আমার মা রওশন আরা রহমান কোথায় থাকবেন? তিনি তখন বাংলাবাজার গার্লস স্কুলে শিক্ষকতা করতেন।
এই বিপদ থেকে উদ্ধার করলেন মুসলিম লীগেরই একজন নেতা সৈয়দ মোহাম্মদ আলী। তিনি আমার মা-র আত্মীয় ছিলেন। তার জমিদারি ছিল এবং তিনি তার পরিবার নিয়ে থাকতেন বাদামতলিতে ৩ আকমল খান রোডে। সেখানে তার কয়েকটি বাড়ি ছিল এবং একটিতে আমাদের থাকতে দিলেন।
পিতা চলে গেলেন সিলেটে। আমরা, গেলাম বেগমবাজার ছেড়ে বাদামতলিতে। কিন্তু নতুন একটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে আমাদের পড়তে হলো। বাদামতলিতে তখন ছিল বারবনিতা বা বারবেগমদের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র। বেগমবাজার থেকে বারবেগমে যাওয়ার পরই আবিষ্কার করলাম, আমাদের বাড়ির পেছন দিকের পথেই তাদের বসবাস ও ব্যবসা। বিকেল থেকেই যৌনকর্মীরা কড়া রং চং মেখে পথে দাড়িয়ে থেকে খদ্দের ধরত।

আমার বয়স তখন সতের। মার্চ ১৯৫২-তে আইএ পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ইকনমিক্সে ভর্তির চেষ্টা করছি। যৌন বিষয়ে অস্পষ্ট ধারণা সবে হচ্ছিল। তবে সেই মেয়েরা যে কামনীয় নয় সেটা স্পষ্ট বুঝেছিলাম। মুশকিল হলো এই যে, কোনো দিন যদি অন্যমনস্ক হয়ে সেই পথে ঢুকে পড়তাম তাহলে বহু ধরনের নিমন্ত্রণ অথবা বাক্যবাণ শুনতে হতো তাদের কাছ থেকে। বাংলাবাজার স্কুল থেকে বাদামতলিতে বাড়ি ফেরার সময়ে মাঝে মধ্যে রিকশাওয়ালা ভুল করে যদি সেদিকে চলে যেত তাহলে আমার মা-কেও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হতো।
একদিন দুপুরের কথা মনে আছে। সেদিন আমার মা-র স্কুল বন্ধ ছিল। তিনি বাড়িতে নিচতলায় রান্নাঘরে ছিলেন। আমি দোতলায় গিটার বাজানোতে আমার গুরু ও বন্ধু ওয়ারেস আলীর সঙ্গে গিটার চর্চা করছিলাম।

হঠাৎ নিচতলা থেকে মা-র আর্ত চিৎকার শুনলাম,
বাচাও, বাচাও।
আমি আর ওয়ারেসভাই ছুটে নিচে গিয়ে দেখলাম লুংগি ও গেঞ্জি পরা এক মধ্যবয়স্ক লোকের হাতে বড় রামদা। লোকটার চোখমুখ লাল ছিল। ঘর্মাক্ত দেহে সে হুংকার দিয়ে বলছিল,
হারামজাদা-কে আজ মেরেই ফেলব। আজই ওকে শেষ করব।
আর আমার মা পাগলের মতো ছোটাছুটি করছিলেন।

ওয়ারেসভাই ছিলেন খুব ধীরস্থির প্রকৃতির মানুষ। সুদর্শন। চালচলনে আভিজাত্য ছিল। তার বাবা ছিলেন খান বাহাদুর মাহমুদ আলী এবং রিটায়ার্ড আইজি পুলিশ। এই ধরনের মানুষ তিনি আগেও দেখেছিলেন। আমাদের বাড়িতে হামলাকারী লোকটিকে শান্ত করে বুঝলেন যে, হারামজাদা মানে আমারই এক ছোট ভাই যে কুনজর দিয়েছিল ওই হামলাকারীর অন্যতম রক্ষিতার ওপর।

এই অভিযোগের প্রধান কারণ ছিল, আমার ভাই নাকি তার জানালা থেকে কয়েকবার পেছনের বাড়িতে একটি রক্ষিতার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করেছিল। এমনটা আর হবে না আশ্বাস পেয়ে সেই হামলাকারী চলে গেল। কিন্তু বাবা সিলেটে থাকায় আমরা নিরাপদ বোধ করছিলাম না। আমরা জেনেছিলাম ওই হামলাকারী ছিল যৌনকর্মীদের ওপরে তদারকির জন্য একজন সর্দার। যাই হোক, সপ্তাহখানেক পরে আমরা শুনলাম, প্রতিদ্বন্দ্বী এক সর্দারের সঙ্গে কোন্দলে সে খুন হয়েছে। আমরা দুর্ভাবনা মুক্ত হয়েছিলাম। এই সময়ে তালেয়া (ডাক নাম) ছিল আমার সহপাঠী (পরে আমার স্ত্রী)। থাকত রোকেয়া হলে। সেখান থেকে সে মাঝে মধ্যে আসত আমার সঙ্গে দেখা করতে বাদামতলিতে। আমি তখন দুশ্চিন্তায় পড়তাম, যদি কোনো রিকশাওয়ালা ভুল করে তাকে সেই বেপাড়ায় নিয়ে যায়?

তারপরেও আমরা কৃতজ্ঞ ছিলাম মোহাম্মদ আলী সাহেবের কাছে। পরবর্তীতে তার ছেলে সৈয়দ আহসান আলী সিডনি বড় অভিনেতা রূপে খ্যাতিমান হয়েছিলেন। যাই হোক, ছুটিতে সাইদুর রহমান ঢাকায় আসতেন। স্ত্রীর রান্নায় অভ্যস্ত হলেও তাকে সিলেটে বুয়া বাবুর্চিদের রান্নায় দিনযাপন করতে হচ্ছিল।

এসব ঘটনা বললাম বোঝানোর জন্য যে বিবেকের নির্দেশ মেনে চললে শুধু ব্যক্তির ওপরই নয়- পরিবারের অন্য সদস্যদের ওপরও বিপদ নেমে আসে। এখানে বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে যে সেই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে জব অপরচুনিটি ছিল খুব কম। শিক্ষিতদের জন্য সরকারি চাকরিই ছিল বড় অবলম্বন।

তখন পিতার এই অভিজ্ঞতার পর আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছিলাম ক্যারিয়ার হিসেবে কিছুতেই সরকারি চাকরি বেছে নেব না। আমি লেখক ও পত্রিকা সম্পাদক হবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। বস্তুত : ১৯৪৯-তে আমি সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলে ‘সচিত্র টেন’ নামে একটি পত্রিকা এবং পুরানা পল্টনে আমাদের পাড়ায় ‘বেয়নেট’ নামে এবং ১৯৫০-এ ঢাকা কলেজের ছাত্র হবার পর ‘চটি’ নামে হাতেলেখা পত্রিকা প্রকাশ করতাম। আমি ছিলাম সম্পাদক ও প্রধান লেখক। যেহেতু বুঝেছিলাম বিবেকের নির্দেশ ছাড়া সৃজনশীল লেখা সম্ভব নয়- তাই সরকারি চাকরির কথা কখনো ভাবিনি। সেজন্য ১৯৫৫-তে আমার সহপাঠীরা যখন পাকিস্তান সরকারের সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিসে (CSS) যোগ দেয়ার পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমাকে এমন একটি পেশায় যেতে হবে যেখানে নিয়োজিত থেকে আমি আমার লেখার স্বাধীনতা বজায় রাখতে পারব। পত্রিকা প্রকাশ করতে পারব। লন্ডনে গিয়ে চার্টার্ড একাউন্টেন্ট হবার এটা ছিল অন্যতম প্রধান কারণ। কিন্তু আমি কখনো সরকারি চাকরি না করলেও সরকারি রোষানলের শিকার হয়েছি বহুবার। তখন সরকারি আজ্ঞাবহদের কাছ থেকে শুনতে হয়েছে বহুবার সেই দুটি অতি পরিচিত শব্দ ‘ওপরের নির্দেশ’। আমার মা-র মতোই আমার স্ত্রী তালেয়া রেহমানকেও বহু সমস্যা ও বিপদে পড়তে হয়েছে।

[আগামী সপ্তাহে সমাপ্য]
৩০ জানুয়ারি ২০১৮