ছিঁচকে চুরি, সাগর চুরি আর পিনাটতত্ত্ব

ছিঁচকে চুরি, সাগর চুরি আর পিনাটতত্ত্ব

চোর হয় নানা জাতের। কেউ পুকুর চোর, কেউ সাগর চোর, কেউ সিঁদেল চোর, কেউবা আবার ছিঁচকে চোর।

এর মধ্যে সবচেয়ে তুচ্ছ বোধ করি ছিঁচকে চোর। এরা সুযোগ পেলে এটা সেটা চুরি করে, কোনোক্রমে টিকে থাকার চেষ্টা করে। মূলত বাঁচার জন্যই তাদের এই চৌর্যবৃত্তি। আর কে না জানে- চুরিবিদ্যা মহাবিদ্যা, যদি না পড় ধরা। ধরা পড়লেই যত সমস্যা, না হলে সব ঠিক।

তাই সবাই চায় আনাড়ি চোর থেকে পাকা চোর হতে, নাইব গাইব সবই করব, চুল ভেজাব না। তাদেরই কেউ কেউ তো চুরিকে নিয়ে গেছে শিল্পের পর্যায়ে।

এই যেমন ধরেন, ব্যাংক থেকে ঋণের নামে নাই হয়ে গেছে দেড় লাখ কোটি টাকা, কিংবা বছরে দেশ থেকে পাচার হচ্ছে ৭৫ হাজার কোটি টাকা, শেয়ারবাজার থেকে দফায় দফায় হাওয়া হয়েছে হাজার, লক্ষ কোটি টাকা, ব্যাংক তো ব্যাংক, কেন্দ্রীয় ব্যাংক পর্যন্ত পৌঁছে গেছে চোরেরা।

ধরা তো দূরের কথা, কারও টিকিটির দেখা পর্যন্ত পাওয়া যায় নাই। এরাই মহাবিদ্যা জানা পাকা চোর। সবাই এদের জানে, চেনে কিন্তু রা’টি কাড়ে না। এরা রথী মহারথী, দেশের মাথা দশের মাথা, এদের ধরা তো বহু দূরের কথা, এদের নিয়ে কথা বলবে কে? হাজার হোক ঘাড়ে তো মাথা একটাই।

কিছুদিন আগে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বালিশসহ বেশ কিছু আসবাবপত্র কেনা এবং তা ভবনে উঠানো নিয়ে দুর্নীতির খবর প্রথমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং পরবর্তী সময়ে মূলধারার গণমাধ্যমে ব্যাপক লেখালেখি হয়েছে। এখানে মোট খরচ হয়েছে ২৫ কোটি ৬৯ লাখ ৯২ হাজার ২৯২ টাকা।

এই প্রকল্পে শুধু বালিশই কেনা হয়েছে ৩৩০টি যাতে প্রতিটির মূল্য ধরা হয়েছে ৫৯৫৭ টাকা আর ফ্ল্যাটে উঠাতে খরচ হয়েছে ৯৩১ টাকা। তাতে কেবল বালিশের পেছনে খরচ হয়েছে মোট ২ কোটি ২৭ লাখ ৩ হাজার ৪০ টাকা।

বালিশের পেছনে এই বিপুল ব্যয়ের জন্য ঘটনাটি বালিশকাণ্ড হিসাবেই পরিচিতি পেয়েছে। কিন্তু মজার বিষয় হল, শুধু বালিশ নয় এখানে প্রকল্প পরিচালকের বেতন ধরা হয়েছে ৫ লাখ টাকা আর ড্রাইভারের বেতন ধরা হয়েছে ৭৪ হাজার টাকা আর মালির বেতন ৮০ হাজার টাকা।

এছাড়াও এই প্রকল্পে খাট, বৈদ্যুতিক চুলা, ভ্যাকিউম মেশিন, ইলেক্ট্রিক আয়রন, টিভি, ফ্রিজ, ওয়ারড্রোব, মাইক্রোওয়েবসহ প্রতিটি জিনিস কিনতে এবং উঠাতে অবিশ্বাস্য ব্যয় ধরা হয়েছে।

এই বালিশকাণ্ড আবার চাপা পড়েছে পর্দার নিচে। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউতে রোগীকে আড়াল করার একসেট পর্দার দাম ধরা হয়েছে ৩৭ লাখ টাকা, ব্লাড প্রেসার মাপার একটি ডিজিটাল মেশিনের দাম ১০ লাখ টাকা, স্টেথোস্কোপের দাম ১ লাখ ১২ হাজার টাকা, অক্সিজেন জেনারেটিং প্ল্যান্ট ৫ কোটি ২৭ লাখ টাকাসহ অবিশ্বাস্য সব দামে মেডিকেলের যন্ত্র ও সরঞ্জামাদি কিনেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

খবরে প্রকাশ, হাসপাতালটির ১১ কোটি ৫৩ লাখ ৪৬৫ টাকার জিনিসপত্রের কেনাকাটায় বিল দেখানো হয়েছে ৫২ কোটি ৬৬ লাখ ৭১ হাজার ২০০ টাকা, যা প্রকৃত বিলের ৫ গুণ।

এই পর্দাকাণ্ড নিয়ে হইচইয়ের মধ্যেই পত্রিকায় রিপোর্ট এসেছে রেলওয়ের কারিগরি প্রকল্পে ক্লিনারের বেতন মাসে ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা আর অফিস সহকারীর বেতন ৮৩ হাজার ৯৫০ টাকা। মজার তথ্য হল, এই ক্লিনারের বেতন কোনো কোনো প্রকল্পে একজন বিদেশি পরামর্শকের সমান বা বেশি এবং স্বয়ং রেলমন্ত্রীর বেতনের ৪ গুণ।

এখানেই শেষ না, এই প্রকল্পে বিদেশি পরামর্শকদের বেতন ধরা হয়েছে মাসে ২৫ লাখ টাকা। পরিকল্পনা কমিশনের ভাষ্য মতে, অত্যধিক পরামর্শকও রাখা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য পরামর্শক থাকবে ১৫৩০ জন, যার মধ্যে বিদেশি পরামর্শক ১১৫৩ জন।

এসব ঘটনার ফাঁকেই খবর বেরিয়েছে, সাড়ে ৫ হাজার টাকার একটি বই স্বাস্থ্য অধিদফতর কিনেছে ৮৫ হাজার ৫০০ টাকায়। ১০ কপি বইয়ের মূল্য বাবদ পরিশোধ করেছে ৮ লাখ ৫৫ হাজার টাকা।

অর্থাৎ ৮ লাখ টাকা বেশি খরচ করে এই বই কিনেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। একটি জাতীয় পোর্টাল ৪৭৯টি আইটেমের বইয়ের মধ্যে দৈবচয়নের ভিত্তিতে ৩০টি বইয়ের বাজার দাম যাচাই করে দেখিয়েছে বইগুলো দ্বিগুণ, তিনগুণ এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৫ গুণ বেশি দামে কেনা হয়েছে।

সর্বশেষ আমরা দেখলাম টিন কাহিনী, যেখানে এক লাখ টাকা ব্যয়ে এক পিস করে টিন কেনা হয়েছে। এরই মধ্যে উগান্ডাতে ভ্রমণে গেছেন চট্টগ্রাম ওয়াসা ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ৪১ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী। উগান্ডায় গিয়ে জিনজা শহর হয়ে তারা স্পিডবোটে ঘুরে বেড়ান নীল নদের অন্যতম উৎপত্তিস্থল ভিক্টোরিয়া হ্রদে।

ঘোরেন দুই মেরুর মধ্যবর্তী স্থান ইকোয়েটরেও। এসব দেখে আমাদের মনে হতেই পারত এটা নিছক প্রমোদ ভ্রমণ; কিন্তু সফরকারীরা আমাদের ভুল ভেঙে দিয়ে বলেন সেখান থেকে তারা ‘গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানার্জন করেন’, যেমন- তারা সেখানে সড়কে যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ি দেখেননি। নগর পরিচালনা সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করা হয় বলে তাদের জানানো হয়।

মজার ঘটনা হল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে যখন সর্বত্র এমন ঘটনার সমালোচনা চলছে, তখন ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন এগুলো ছিঁচকে কাজ, এর সঙ্গে এমপি-মন্ত্রির সংশ্লিষ্টতা নেই।

এটাকে তিনি স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ছিঁচকে চুরির সঙ্গেও তুলনা করেন। অবশ্য যে দেশে চার হাজার কোটি টাকা ‘পিনাট’, শেয়ারবাজার হল ‘ফটকাবাজার’, অর্থমন্ত্রী খোদ বলেন ‘পুকুর চুরি না সাগর চুরি হয়েছে’ কিন্তু কোনো বিচার হয় না, তথ্যমন্ত্রী দাবি করেন ‘বেশিরভাগ মন্ত্রী, এমপি টিআর, কাবিখার টাকা মেরে দেয়’, শিক্ষামন্ত্রী পরামর্শ দেন ‘সহনীয় মাত্রায়’ ঘুষ খেতে; সে দেশে এগুলো ছিঁচকে চুরি হবে সেটাই স্বাভাবিক। যদিও কৃষিমন্ত্রী এগুলোকে দিনদুপুরে ডাকাতি বলে অভিহিত করে বলেন, এর জন্য চড়া রাজনৈতিক মূল্য দিতে হবে।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বালিশ কেলেঙ্কারির কথা যখন সবার মুখে মুখে, তখন জানিয়ে রাখি- এই কেন্দ্রে প্রতি মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য মূলধন ব্যয় ধরা হয়েছে ৫০ লাখ ডলার। একই সময় ভারতের তামিলনাড়ুর কুদনকুলাম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে একই রিঅ্যাকটরের ক্ষেত্রে মূলধন ব্যয় প্রতি মেগাওয়াটে ৩০ লাখ ডলার।

অর্থাৎ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ২৬৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে মূলধন ব্যয় বেশি হচ্ছে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এটি ছিঁচকে চুরি নাকি সাগর চুরি, তা অবশ্য কর্তারা বলেননি।

সরকারের উন্নয়নের আর এক বয়ান দাঁড়িয়ে আছে সড়ক মহাসড়কের ওপর। আমরা ইতিমধ্যে জানি, ৪ লেনের প্রতি কিলোমিটার মহাসড়কের ব্যয় ভারতে ১০ কোটি টাকা, চীনে ১৩ কোটি টাকা, ইউরোপে ২৮ কোটি টাকা। ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা মহাসড়কের কিলোমিটার প্রতি ব্যয় প্রথমে ধরা হয়েছিল ৯৫ কোটি টাকা, পরবর্তীকালে এটা বেড়ে হয় ১২৪ কোটি টাকা এবং সর্বশেষ এর কিলোমিটার প্রতি ব্যয় এসে দাঁড়িয়েছে ১৮৩ কোটি টাকায়।

এই মহাসড়কের দৈর্ঘ্য ৫৫ কিলোমিটার যা নির্মাণে ভারত/ চীনে ব্যয় হবে ৫৫০ থেকে ৭০০ কোটি টাকা আর ইউরোপে ব্যয় হবে ১৫৪০ কোটি টাকা। এই ৫৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে মোট ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৮৪ কোটি টাকা।

রেললাইন নির্মাণের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। যেখানে প্রতি কিলোমিটার রেললাইন ব্যয় ভারত/চীনে ১২ কোটি টাকা, ইউরোপ/আমেরিকায় ৩০-৩২ কোটি টাকা, সেখানে ঢাকা-পায়রা রেলপথ তৈরির কিলোমিটার প্রতি খরচ ২৫০ কোটি টাকা। ঢাকা-পায়রা রেলপথের দৈর্ঘ্য ২৪০ কিলোমিটার।

যার অর্থ দাঁড়ায়, যে সড়ক নির্মাণে ভারত/চীনে ব্যয় হবে ২৮৮০ কোটি টাকা, ইউরোপ/আমেরিকায় ব্যয় হবে ৭৬৮০ কোটি টাকা তা বাংলাদেশে নির্মাণ করতে ব্যয় হচ্ছে ৬০ হাজার কোটি টাকা। অন্যান্য সব প্রকল্পের মতোই এই প্রকল্পের সময় এবং ব্যয় দুটোই বাড়বে তা হলফ করেই বলা যায়। সরকারের আর এক গর্ব ফ্লাইওভারের অবস্থাও তথৈবচ।

বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতের ভয়াবহ দুর্নীতি আর হরিলুটের কথা এখন সর্বজনবিদিত। তারল্য সংকট, মূলধন ঘাটতি, মন্দ ঋণ, ডেসটিনি, হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ কেলেঙ্কারি সবই এখন গা সওয়া।

শেয়ারবাজার লুট বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক লোপাট সবই এখন স্বাভাবিক। মন্ত্রীর ভাষায় ছিঁচকে চুরি বলি কিংবা পুকুর চুরি, দুর্নীতি গ্রাস করেছে সর্বত্র। সেই আমরাই আবার মাঝে মাঝে বালিশকাণ্ড, পর্দাকাণ্ড, কিংবা টিনকাণ্ডে অবাকও হই!

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্ট বলছে, ২০০৯ সালে যখন এই সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে তখন দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশ আর পাকিস্তান ছিল একই জায়গায়- ১৩৯তম অবস্থানে। ২০১৮ সালে আমরা ১৪৩তম আর ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ পাকিস্তান ২৬ ধাপ উপরে- ১১৭তম স্থানে।

দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র আফগানিস্তান ছাড়া আর সব দেশের অবস্থান বাংলাদেশের ওপরে। দুর্নীতির ভয়াবহ প্রভাব এই দেশে যে কতটুকু তা প্রকাশ পেয়েছে সাবেক অর্থমন্ত্রীর কথায়, যিনি স্বীকার করেছেন এই দেশ জিডিপির যে প্রবৃদ্ধি হওয়ার কথা তা ২-৩ শতাংশ কম হচ্ছে (প্রকৃতপক্ষে ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি) দুর্নীতির কারণে।

উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির গল্প আমাদের সামনে আসে। সেগুলোর পরিমাণ নিয়েও যৌক্তিক প্রশ্ন তোলাই যায়; কিন্তু ওইসব ক্ষেত্রে যতটুকু উন্নতিও হয়েছে, এই সর্বগ্রাসী দুর্নীতির কারণেই তার সুফল সমাজের ৯০ ভাগ মানুষের কাছে আদৌ পৌঁছে না।

এই দেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বলে দরিদ্র মানুষের আয় বৃদ্ধি হওয়া দূরে থাকুক, স্থিরও থাকছে না, ক্রমাগত কমে যাচ্ছে। ওই প্রতিষ্ঠানের এই পরিসংখ্যান মতে, আমাদের দেশে দারিদ্র্য কমার হারও প্রতি বছর কমে যাচ্ছে।

অটোমেশন এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক যন্ত্রপাতির প্রভাবের চতুর্থ শিল্প বিপ্লব পৃথিবীতে এসে গেছে। এর কারণে এমনকি পৃথিবীর সুশাসনে থাকা, দুর্নীতিমুক্ত দেশগুলোর সামনেই ভয়ংকর ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে।

সাধারণ মানুষের জীবিকা খুব দ্রুতই অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রভাব এর মধ্যেই আমাদের গার্মেন্ট শিল্পে পড়েছে খুব বড়ভাবে, অন্যান্য ক্ষেত্রেও পড়বে খুব দ্রুতই।

ভয়ংকর রকম দুর্নীতির কারণে এই দেশে চার কোটি ৮২ লাখ মানুষ বেকার, চার কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে। দুর্নীতির ভয়াবহ প্রভাবের সঙ্গে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রভাব যুক্ত করা যাক, এবার ভবিষ্যৎটা দেখে কি আমাদের গায়ে কাঁটা দিচ্ছে না?

ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা : সংসদ সদস্য; আন্তর্জাতিকবিষয়ক সহসম্পাদক, বিএনপি

এমজে/