মশাদের প্যারেড চলছে, মেয়রেরা কই?

মশাদের প্যারেড চলছে, মেয়রেরা কই?

মশাদের ঘুম ভেঙেছে। কোটি কোটি মশা ছানাপোনা নিয়ে নেমে পড়েছে। রাজধানীর অলিগলিতে চলছে তাদের সদম্ভ কুচকাওয়াজ। অতি সুশৃঙ্খলভাবে তারা প্যারেড করে চলেছে। কিন্তু এখনো এই শহরের দুই সিটি করপোরেশনের সদ্য নির্বাচিত দুই মেয়রের ‘মশাবিরোধী’ রাগী অভিযানের ছিটেফোঁটাও দেখা যাচ্ছে না। দীর্ঘ নির্বাচনী কর্মকাণ্ড শেষে তাঁরা কি তবে বিশ্রামে গেলেন—এমন প্রশ্নেরও জো নেই। কারণ, আইনি মারপ্যাঁচ আর আবেগীয় বিচারে ঢাকা এখন বাস্তবিকই অভিভাবকহীন।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন এলাকায় মশার উৎপাতে টেকা দায় হয়ে যাচ্ছে। অথচ মৌসুম মোটে শুরু হলো। শীতনিদ্রার পর ঘুম ভাঙল মোটে মশাদের। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ডেরা বিধায়, সেখানকার পরিস্থিতি নিজের অভিজ্ঞতা দিয়েই জানি। খিলগাঁও-মালিবাগ এলাকার বাসিন্দারা সন্ধ্যার পর অনেকটা বাধ্যতামূলকভাবেই অস্থির হয়ে ওঠেন। কারণ, স্থির হওয়ার জো নেই। সুবোধ হয়ে বসলেন তো, শরীরের উন্মুক্ত স্থানগুলোয় সার বেঁধে বসে পড়বে মশারা। বসে যে তারা সুখ-দুঃখের আলাপ করবে এমন নয়, কামড়ে দেবে। আর কামড়কে কে না ভয় পায়। তাই অবধারিতভাবেই অস্থির হয়ে উঠতে হয় মানুষকে। এই অস্থিরতা বয়সের বাঁধ মানে না। শিশু থেকে বৃদ্ধ—সবাই সমান অস্থির। ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন এলাকা থেকেই পরিচিত সূত্রে একই ধরনের পরিস্থিতির খবর পাওয়া যাচ্ছে।

এদিকে নির্মাণযজ্ঞ তো শেষ হয়নি, চলছে সমানতালে। কালকে ঠিক করা রাস্তা আজকেই কেটে ফেলা হচ্ছে। তারপর আবার হয়তো তা ঠিক করা হচ্ছে। কিন্তু নতুন তৈরি হওয়া খানাখন্দগুলো কী এক অভিমানে আগের মতোই থেকে যাচ্ছে। গতকালই হয়েছে বছরের প্রথম বৃষ্টি। এসব খানাখন্দে প্রথম বাদল দিনের কতটা জল জমা হলো, তার খোঁজ কি কেউ রেখেছে? তবে রাখবে নিশ্চয়। মশক বাহিনীর এলিট ফোর্স এডিস মাঠে নামলেই প্রথমে বিবৃতি দিয়ে খানাখন্দগুলো ভরাটের চেষ্টা হবে, তারপর আবার হয়তো চলবে ঝাড়ু অভিযান। ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।

সাধারণ বুদ্ধি বলে, গেলবার যেহেতু মশাদের বাড়বাড়ন্ত ছিল, এবার শঙ্কা বেশি বৈ কম হবে না। কারণ, ডিম। গেলবারের মশারা তাদের বংশরক্ষা করে যায়নি বলে কোনো বোকা ভাববে? আর মশাদের সমাজে তো নিশ্চয় ‘দুটির বেশি নয়, একটি হলে ভালো হয়’ ধরনের পরিকল্পনার চল নেই। বরং উল্টোটাই। মানুষের পৃথিবীতে বংশরক্ষার ধকল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল বলেই তারা হাজারে-বিজারে সন্তান জন্মদানে বিশ্বাসী। হচ্ছেও তা–ই। এই তো কিছুদিন আগে কীটতত্ত্ববিদেরা সতর্ক করেছেন এই বলে যে ঢাকায় মশার ঘনত্ব কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। আর সতর্ক করেছেন এই বলে যে ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশাও এবার গত বছরের এই সময়ের তুলনায় বেশি। সতর্ক করতে ভোলেননি প্রধানমন্ত্রীও। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি নবনির্বাচিত দুই মেয়র ও কাউন্সিলরদের শপথ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘মশা আপনার ভোট খেয়ে না ফেলে। মশা ক্ষুদ্র হলেও এটা অনেক শক্তিশালী।’ মশাকে শক্তিশালী না বলে উপায়ই বা কী। গেল বছরের ডেঙ্গু প্রকোপ দেখলে কোন নগরকর্তার রাতের ঘুম হারাম হবে না? এখন আমাদের নির্বাচিত দুই মেয়র এ ব্যাপারে কী ঠিক করেছেন, তা জানতে ইচ্ছে করে।

যদিও উত্তরের মেয়র অবশ্য বলেছেন, তিনি কথার চেয়ে কাজে বেশি বিশ্বাসী। নগরবাসীর অনেকের চোখ নিশ্চয় সে সময় আবেগে সিক্ত হয়েছিল। কিন্তু সে জল শুকাতে সময় লাগেনি যখন কিছুদিন আগে তিনি বলেন, ‘এডিস মশকনিধনে জোর প্রচার চালাবেন।’ মানুষের মাথায় তখন স্বাভাবিক প্রশ্ন জাগে, ‘প্রচারে কি মশা মরে?’

ঢাকার নতুন দুই মেয়রই অবশ্য জানিয়েছেন যে মশকনিধনে তাঁদের পরিকল্পনা আগেই করা আছে। এখন শুধু বাস্তবায়নের পালা। কিন্তু মশার কামড় খেতে খেতে এই নগরের বাসিন্দাদের মুখ এসব খবরে খুব ভেতর থেকে তিতা হয়ে যাচ্ছে। কারণ, এবার তো বালাইয়ের বাড়বাড়ন্ত। করোনাভাইরাস শ্বাস ফেলছে ঘাড়ের ওপর। আর অদূরে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছে ডেঙ্গু। আর কিছু আছে কি না অজ্ঞাতে, কে জানে।

নবনির্বাচিত দুই মেয়র হয়তো বলবেন, এখনো তাঁরা দায়িত্ব বুঝে পাননি। স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন ২০০৯ অনুযায়ী, সিটি করপোরেশন গঠনের পর এর প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার পরবর্তী পাঁচ বছর পর্যন্ত মেয়াদ থাকবে। এ হিসাবে উত্তরে আতিকুল ইসলামকে ১৪ মে এবং দক্ষিণে ফজলে নূর তাপসকে ১৭ মে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, এই মধ্যবর্তী সময়ে নগরকে দেখবেন কে? উত্তরে আতিকুল ইসলাম প্রার্থী হতে গিয়ে কাউকে দায়িত্ব না দিয়েই পদত্যাগ করেছেন। আর দক্ষিণের বর্তমান মেয়র সাঈদ খোকনের কাছ থেকে গেল দুর্যোগকালে অদ্ভুত দাওয়াই ছাড়া কিছুই জোটেনি। তিনি এমনকি মশকরোধী ড্রেস কোডও দিয়েছিলেন। এবার বিদায়ী হওয়ার অভিমানেই হয়তো তিনি একেবারে চুপ।

কথা হলো, মশা তো স্থানীয় সরকার আইনের মারপ্যাঁচ বা নির্বাচন কমিশনের কাণ্ডজ্ঞানহীনতাপ্রসূত শূন্যতা বোঝে না। তারা বোঝে মাঠ খালি। খালি বলেই তারা প্যারেড করে বেড়াচ্ছে, আর সুযোগ পেলেই কামড়ে দিচ্ছে। পথেঘাটে, অলিগলিতে সর্বত্র তারা। কয়েল তো ছার, ধূপ-ধুনোতেও কাজ হচ্ছে না। মশারির নিচেও নিস্তার নেই; ‘মশার গানে ঘুম আসে না, একলা জেগে রই’ দশা। এ অবস্থায় নতুন দুই মেয়র সক্রিয় হওয়ার আগেই না মশারা তাদের দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করে ফেলে।

এবারে শঙ্কার সঙ্গে রয়েছে প্রশ্নও। গেলবার মশকনিধন ওষুধ কেলেঙ্কারি তো ভোলার কথা নয়। এবারের কী অবস্থা? বলা হয়েছিল, এত দিন ব্যবহৃত ওষুধ এখানকার মশকনিধনে আর কাজ করছে না। কাজ করবে এমন ওষুধ সম্পর্কে কি নিশ্চিত হওয়া গেছে? ডোবা, নর্দমা ইত্যাদি পরিচ্ছন্নতার কাজ কবে কে করবে? নাকি এবারও দলে দলে মানুষ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালমুখী হলে সব মাধ্যমের তারকারা ঝাড়ু হাতে ফটোসেশন করবেন? প্রচারের এই যুগে তেমন উপলক্ষকে আরেকটু জমিয়ে তোলার জন্যই কি অপেক্ষা তবে? আরও প্রশ্ন রয়েছে, রয়েছে শঙ্কা। কিন্তু উত্তর কে দেবে? মেয়রেরা কই?

এমজে/