সোহরাব হাসান

সাংবাদিক খামোশের ডিজিটাল কায়দা

সাংবাদিক খামোশের ডিজিটাল কায়দা

বাংলাদেশে পত্রিকা সম্পাদক ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা করা এখন ‘কু-অভ্যাসে’ পরিণত হয়েছে। আগে পত্রিকায় কোনো খবর ছাপা হলে মানহানি ও ক্ষতিপূরণ মামলা হতো। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন জারির পর সেটি দিয়ে হরহামেশা সম্পাদক ও সাংবাদিকদের ঘায়েল করার চেষ্টা চলছে।

সম্প্রতি ‘মানবজমিন’-এর প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছেন সাংসদ সাইফুজ্জামান শিখর। কিন্তু যে খবরের জন্য মামলাটি হয়েছে, তার কোথাও সাইফুজ্জামান শিখরের নাম নেই। তার পরও যদি তিনি মনে করেন, খবরটির বিষয়ে তাঁর বক্তব্য আছে, তিনি সেটি ‘মানবজমিন’-এ পাঠিয়ে দিতে পারতেন। তারা তা ছাপাতে বাধ্য ছিল। কিন্তু তা তিনি পাঠাননি। খবরটি আপত্তিকর মনে হলে সাংসদ প্রেস কাউন্সিলে মামলা করতে পারতেন। প্রেস কাউন্সিলের রায়ে সন্তুষ্ট না হলে ফৌজদারি আদালতের আশ্রয় নিতে পারতেন। সেটাই নিয়ম। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ এসব নিয়মকানুন মানবেন কেন? ডিজিটাল আইনের মোক্ষম অস্ত্রটিই তিনি প্রথম সুযোগে গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে ব্যবহার করলেন।

অথচ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাসের সময় সাংবাদিকসহ বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদ উঠলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলো, এটি সাংবাদিক বা গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে যাঁরা ব্যক্তির মানসম্মান ক্ষুণ্ন করবেন, তাঁদের ধরা হবে। সরকার ‘তাঁদের’ কতটা ধরতে পারছে জানি না, তবে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেই মামলাটি যথেচ্ছ ব্যবহৃত হচ্ছে।

যে খবরটি নিয়ে ‘মানবজমিন’-এর বিরুদ্ধে সাংসদ শিখর মামলা করলেন, সেই খবরে তাঁর বা কোনো সাংসদ, আমলা কিংবা ব্যবসায়ীর নাম নেই। এতে অস্ত্র ও মাদক মামলায় আটক যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়ার বরাতে বলেছে, তদন্তে ৩০ জনের নাম এসেছে, যাঁরা তাঁর ডেরায় যেতেন। পাপিয়ার অপকর্মের সঙ্গে কারা জড়িত ছিলেন, কারা জড়িত ছিলেন না, তা তদন্তে বেরিয়ে আসবে। তবে পাপিয়া ধরা পড়ার পর আওয়ামী লীগের অনেক প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে তাঁর ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসেছে। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, যুব মহিলা লীগের নেতারা ছাড়াও অনেকের সঙ্গে পাপিয়ার ছবি ভাইরাল হয়েছে। সাংসদ শিখর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর নাম উত্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে মামলা না করে কেন ‘মানবজমিন’-এর প্রধান সম্পাদককেই টার্গেট করলেন?

পাপিয়ার ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর আওয়ামী লীগের নেতাদের অন্তত লজ্জিত হওয়ার কথা ছিল। দলের সহযোগী একটি সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে এ রকম অপকর্মের ঘটনা এই প্রথম নয়। এর আগে যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও কৃষক লীগের নেতাদের নানা কেলেঙ্কারির ঘটনাও দেশবাসী গণমাধ্যমের কল্যাণে জেনেছে। আওয়ামী লীগের নেতারা তখন সবকিছু অনুপ্রবেশকারীদের কাজ বলে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করেছেন। এখন কী বলবেন? সম্রাট বা পাপিয়ারা একা একা তৈরি হন না। তাঁদের পেছনে আরও অনেক দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান ‘ছায়া’ থাকে। ‘মানবজমিন’ সেই ছায়ার কথা বলেছে বলে সাংসদ মামলা ঠুকে দিলেন।

‘মানবজমিন’ লিখেছে, পাপিয়া-কাণ্ডের ছায়া তদন্তের দায়িত্বে থাকা র‌্যাব-১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল শাফী উল্লাহ বুলবুল ‘মানবজমিন’কে জানান, পাপিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তা নিয়ে তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সাংসদের নিশ্চয়ই জানার কথা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর পত্রিকার খবর এক নয়। পত্রিকায় খবর প্রকাশের পর কে কী প্রতিক্রিয়া দিলেন, সেটি দেখার দায়িত্ব পত্রিকার সম্পাদক বা রিপোর্টারের নয়। পত্রিকায় যেটুকু প্রকাশিত হয়েছে, সেটুকুর দায়িত্বই তাঁরা নেবেন। সাংসদ যে বলেছেন, ‘মানবজমিন’-এ খবরটি ছাপা হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর ও আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতার নাম নিয়ে অনেকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। অথচ ‘মানবজমিন’-এ খবর প্রকাশের আগেই এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড় চলছিল। সাংসদ সাইফুজ্জামান শিখরের যুক্তটি অদ্ভুত। ‘মানবজমিন’-এ পাপিয়া-সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হওয়ার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নাকি তাঁর (সাইফুজ্জামান শিখর) নাম নিয়ে নানান প্রচারণা হয়। এ কারণে যদি ‘মানবজমিন’-এর প্রধান সম্পাদক ও রিপোর্টারকে মামলার আসামি হতে হয়, তাহলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশকেও আসামি করতে হয়। কেননা, তারা পাপিয়াকে গ্রেপ্তার করেছে বলেই পত্রিকায় খবর হয়েছে এবং পুলিশের সূত্র ধরেই বিভিন্ন নামের তালিকা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসছে।

উল্লেখ্য, যুব মহিলা লীগের নরসিংদী জেলার সাধারণ সম্পাদক শামীমা নূর পাপিয়াকে গত ২২ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে আস্তানা তৈরি করে নারী, মাদক, অস্ত্র ব্যবসাসহ নানা অনৈতিক কাজ চালিয়ে আসছিলেন তিনি।

সাংসদ যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কথা বললেন, তখন আরও একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। ‘মানবজমিন’-এ খবর প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘মানবজমিন’-এর প্রধান সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে জড়িয়েও উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা হয়েছে। এসব অপপ্রচার তাঁরাই চালাচ্ছেন, যাঁরা চান না পাপিয়ার ঘটনা নিয়ে থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়ুক।

সাধারণত মামলা করা হয় আইনি প্রতিকার পেতে। কিন্তু আমাদের এখানে ক্ষমতাসীনেরা গণমাধ্যমের সম্পাদক ও সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করেন, তাদের ‘খামোশ’ করতে, মুখ বন্ধ করতে। নিকট অতীতে এর ভূরি ভূরি প্রমাণ আছে।

আমাদের যে রাজনীতিকেরা বিরোধী দলে থাকতে গণমাধ্যমকে পরম সুহৃদ ভাবেন, ক্ষমতায় গিয়ে তাঁরাই গণমাধ্যমের সঙ্গে শত্রুতা করেন। সাংসদ শিখরের মামলাটি অনেক উদাহরণের একটি মাত্র।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক।