পোশাক শ্রমিকদের বিপদের মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে কি না সেটা কে দেখবে?

পোশাক শ্রমিকদের বিপদের মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে কি না সেটা কে দেখবে?

সরকারের অনুমোদন নিয়ে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ কর্তৃক কিছু পোশাক কারখানা খুলে দেয়ার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে এখন দেশের অনেক গার্মেন্টস কারখানা খুলেছে। যদিও ‘আপাতত দূর-দূরান্ত থেকে শ্রমিক না আনতে সদস্য কারখানাকে পরামর্শ দিয়েছে’ পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠনগুলো এবং বলা হয়েছে ‘আশপাশে বসবাসরত শ্রমিকদের দিয়ে সীমিতভাবে উৎপাদনকাজ চালাতে’। কিন্ত শনিবার সারা দেশ থেকেই শ্রমিকরা এসেছেন – যে যেভাবে পেরেছেন এসেছেন। তাঁদের এই যাত্রা কেমন হয়েছে সেটা জানা – পুলিশের বাধা, গণপরিবহণ না থাকা, পুলিশের বাধা এড়াতে রাতের অন্ধকারে চলাচল, গাড়িতে গাদাগাদি করে আসার ঘটনাগুলো বিভিন্ন মাধ্যমেই জানা যাচ্ছে। শ্রমিকরা ভয়ে এসেছেন, যেভাবে পেরেছেন এসেছেন। কেননা তাঁদের ভয় হচ্ছে রোববার সকালে কাজে যোগ না দিলে তাঁদের চাকুরি থাকবেনা। তাঁদের এই আশংকার একটি কারন হচ্ছে ‘আশপাশে বসবাসরত’ কথার কোনও অর্থ কেউ ব্যাখ্যা করেনি। যে শ্রমিকরা ২৬ মার্চের পরে ঢাকার বাইরে গ্রামে চলে গেছেন তার আসলে সারা বছর কারখানার আশেপাশেই থাকেন।

কারখানার কাগজে তাদের ঠিকানা তো আশেপাশেই। ‘আশেপাশে থাকা’ স্বত্বেও যদি তারা কাজে যোগ না দেন তাদের চাকুরি থাকবে এমন নিশ্চয়তা কেউ তো দেননি। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে ইতিমধ্যেই শ্রমিক লেঅফ- চাকুরিচ্যুতির ঘটনা ঘটছে। শ্রমিকরা সেই অবস্থায় মালিকদের হাতে আর অজুহাত তুলে দিতে চাননি। এই বিপদের সময়ে চাকুরি গেলে চাকুরি পাওয়া যাবেনা সেটা বোঝার জন্যে অর্থনীতিবিদ হতে হয়না, শ্রমিক হওয়াই যথেষ্ট। তারা যা করছেন সেটাই স্বাভাবিক। মালিকদের সংগঠনগুলো বলছে যে তারা কারখানা খোলার গাইডলাইন দিয়েছেন মালিকদের। মালিকদের কেউ তা মানছেন কিনা সেটা কারা দেখবেন সেটা জানা যায়নি। মালিকরা নিয়ম ভাঙ্গছেন কিনা মালিকদের সংগঠন সেটা দেখবে? এই সব গাইডলাইনে আছে কিভাবে কারখানার ভেতরে ব্যবস্থা নিতে হবে। বলা হচ্ছে “এলাকাভেদে সীমিত পরিসরে ধাপে ধাপে কারখানা চালু করতে উদ্যোগ নিয়েছে বিজিএমইএ”। সরকার সারা দেশকেই ঝুঁকিপূর্ণ বলে ঘোষণা করেছে; শনিবার পর্যন্ত দেশের ৬০টি জেলায় আক্রান্ত চিহ্নিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে একটি এলাকার সঙ্গে আরেকটি এলাকার পার্থক্য কিভাবে নির্ধারিত হবে? এই যে ধাপে ধাপে খোলা হবে তার সুচকগুলো কী? দেশে ভাইরাস পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে থাকলে কতটুকু খোলা হবে? এই সূচকগুলো কি তৈরি করা হয়েছে?

এই প্রশ্নগুলো কেবল গার্মেন্টসের জন্যেই প্রযুক্ত তা নয় অন্যদের ক্ষেত্রেও তা সমভাবে প্রযোজ্য। সামজিক দূরত্ব বা ঘরে থাকার ব্যাপারে সম্পূর্ন ব্যর্থতার প্রেক্ষিতে অনেকেই বলছেন যে এই অবস্থায় দোকানপাট-শিল্প কারখানা খুলে দেয়াই ভালো। কেউ কেউ অর্থনীতির সম্ভাব্য পতনের আশঙ্কার অজুহাতে বলছেন। কেউ কেউ বলছেন এই যুক্তিতে যে বাংলাদেশ যদি এখন সরবরাহ চেইন থেকে ছিটকে পড়ে তবে অন্য দেশ সেই জায়গা নিয়ে নেবে। যে যুক্তিতেই বলা হোক না কেন সেগুলো এখন পর্যন্ত জনস্বাস্থ্যের বিবেচনায় সঠিক নয়। তারা বিস্মৃত হচ্ছেন সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশ হচ্ছে একমাত্র দেশ যেখানে সুস্থ্য হবার চেয়ে মৃতের সংখ্যা বেশি – ৪৯৮৮ জন আক্রান্ত, সুস্থ্য হয়েছেন ১১৩ জন, মারা গেছেন ১৪০ জন। এই হিসেব সরকারী; বেসরকারি হিসেবে ‘উপসর্গে’ মারা গেছেন তাদের অন্তর্ভুক্ত করলে কী দাঁড়ায়? যে সমস্ত লোকের আক্রান্ত হবার বা মৃত্যুর খবর জানাই যাচ্ছেনা তা্দের বিবেচনায় নিলে আশঙ্কা যে বাড়ে তা বলাই বাহুল্য।

বাংলাদেশে এই পর্যন্ত মোট ৪৩ হাজার ১১৩ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। কত পরিমান পরীক্ষা করা হলে বোঝা যাবে যে পরিস্থিতি আসলে কারখানা খোলার উপযোগী সেটা নির্ধারন না করে ‘ধাপে ধাপে’ খোলার কথা বলা আসলে এক ধরণের বায়বীয় আলাপ। আক্রান্ত এবং মৃত্যুর হারের কোন অনুপাত হলে অর্থনীতির চাকা সচল করা যাবে সেই সিদ্ধান্ত মালিকদের নেয়ার বিষয় নয়, সেটা জনস্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের কাজ। বিভিন্ন ধরণের প্রজেকশনেই দেখা যাচ্ছে এই মাসের শেষ দিকে থেকে মে মাসে অবস্থার আরো অবনতি হতে পারে। সেই অবস্থায় কোন রকম সূচকের অপেক্ষা না করে, সেগুলো বিবেচনায় না নিয়ে কারখানা চালুর সিদ্ধান্ত কতটা বিবেচকের কাজ?

বাংলাদেশে পরীক্ষার সংখ্যা এখনো অপ্রতুল। গণস্বাস্থ্যের তৈরি পরীক্ষা কিটের ক্লিনিকাল ট্রায়ালের চেয়ে মিডিয়া ট্রায়ালের দিকেই বেশি উৎসাহী দেশের এক শ্রেনীর মানুষ। তার সঙ্গে সরকারের আমলারা গলা মিলিয়ে পদ্ধতির বয়ান গাইতে শুরু করেছেন। কিন্ত প্রতিদিন যে সংখ্যায় ডাক্তার আক্রান্ত হচ্ছেন তার ফলে প্রায় ভেঙ্গে পড়া চিকিৎসা ব্যবস্থা আগামী কয়েক দিন পরে কি অবস্থায় দাড়াবে কেউ জানেন না। একদিকে বলা হচ্ছে আরো ডাক্তার ও নার্স নিয়োগ দেয়া হবে, অন্যদিকে খবর পাওয়া যাচ্ছে যে শত শত সরকারী চিকিৎসক এমনকি তিন মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না। অর্থনীতির চাকা সচল করতে যে উৎসাহ দেখা যায় তার চেয়েও অনেক কম উৎসাহ হচ্ছে এই সব বিষয়ে মনোযোগ দেবার। আরো কম উৎসাহ মানুষকে বাচানোর জন্যে তাঁদের কাছে খাবার পৌঁছানোর কাজে। সরকারী হিসেবে পৌনে তিন কোটি মানুষেরর কাছে চাল পৌঁছানোর খবর জানা যাচ্ছে ; কিন্ত এই সংকটে এই সাহায্য কাদের হাতে পৌঁছেছে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। ত্রানের চাল চুরির মহোৎসবের খবরের প্রেক্ষিতে সচিবদের দায়িত্ব দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। কিন্ত অতি দরিদ্র, নতুন দরিদ্রদের জন্যে এই সব ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়। সারাদেশের যে সব মানুষ এখন কাজের অভাবে ভয়াবহ অবস্থায় আছেন তাদের জন্যে কি কেবল কয়েক বেলার চাল দেয়াই সরকারের কাজ? পোশাক শিল্পের অনেক শ্রমিক বেতন পাননি এই অভিযোগের কি সুরাহা হয়েছে? মালিকদের স্বার্থ এবং বিদেশী বাজারের বিবেচনায় পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের বিপদের মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে কিনা সেটা কে দেখবে?

(লেখক: অধ্যাপক, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র। লেখাটি তার ফেসবুক টাইমলাইন থেকে নেয়া)