এই বাংলাদেশ আমার নয়

এই বাংলাদেশ আমার নয়

মানুষ মানুষের জন্যে। এটা শুধু গানের কথা নয়। প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে আমরা এর সাক্ষী। মানুষ জানে আগুনে ঝাঁপ দিলে মৃত্যু অনিবার্য। তবুও মানুষকে বাঁচাতে আগুনে ঝাঁপ দেয়। নদীতে ডুব দেয়। নিজে না খেয়ে অন্যকে খাওয়ায়। কেউ মারা গেলে ছেলে-মেয়ে আত্মীয়-স্বজনের কান্নায় বাতাস ভারি হয়ে ওঠে।

পাড়া-পড়শি কান্নায় ভেঙে পড়ে। এটাই আমাদের সমাজ। এটাই আমাদের সংস্কৃতি। কিন্তু করোনা যুগে আমরা দেখছি নিজেরা বাঁচতে গিয়ে মা’কে গভীর জঙ্গলে ফেলে দেয়। বাবার লাশ আনতে হাসপাতালে যায় না সন্তান। জানাজা পড়ার চেষ্টা করে না। অন্যেরা লাশ দাফন করে। লাশ সিঁড়িতে পড়ে থাকার পরও কেউ সৎকার করতে যায় না। অন্য ধর্মের লোকেরা সৎকার করে। হাসপাতাল বানাতে বাধা দেয়। মিছিল করে। ট্রাক থেকে ফেলে দেয় মানব সন্তানকে। বাড়িওয়ালা বাড়ি থেকে মারধর করে বিদায় করে দেয়। মহল্লার লোকেরা চেয়ে চেয়ে দেখে। অতি উৎসাহী লোকেরা লাল পতাকা উড়িয়ে দেয়। হাসপাতালে কোনো ঠাঁই হয় না। সিকিউরিটি গার্ড বলপূর্বক তাড়িয়ে দেয়। পরিবারকে বাঁচাতে ভয়ঙ্কর করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করে। বাড়িতে বসে মৃত্যুর টিকিট কেনে। জানাজানি হলে পরিবার একঘরে হয়ে যাবে। এই ভয়ে সে কাউকে জানায় না। চিকিৎসা নেয় না। স্ত্রী স্বামীকে বাড়িতে ঢুকতে দেয় না। স্ত্রীর সন্দেহের কারণে পুলিশ সদস্য দালান থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে।

এ কোন বাংলাদেশ? যে বাংলাদেশকে আমরা চিনি। এটাতো সেই বাংলাদেশ নয়। যে বাংলাদেশ যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে। হাসতে হাসতে প্রাণ দিয়েছে। কারফিউ ভেঙে স্লোগান দিয়েছে। ট্যাংকের সামনে যেতেও ভয় পায়নি। করোনা কি মানবিকতাও কেড়ে নিলো! মানুষ কি অমানুষ হয়ে গেল! মানুষতো একদিন মারা যাবেই। এক দুনিয়া ছেড়ে অন্য দুনিয়ায় চলে যেতেই হবে। নিজে বাঁচার জন্য জন্মদাতা পিতাকে অস্বীকার করছে। দশমাস দশদিন যে মা সীমাহীন কষ্ট করলো, আঁতুড় ঘর থেকে বের করে এনে লালন-পালন করলো সে মা’কে আমরা জঙ্গলে ফেলে দিচ্ছি। আমরা অবশ্য পশ্চিমা কুসংস্কৃতি ‘ওল্ড হোম’ অনেক আগেই আমদানি করে ফেলেছি। করোনায় সমাজ বদলেছে। জীবনের ষোলআনাই মিছে হয়ে যাচ্ছে। মধ্যবিত্তের জীবনে ঢেউ উঠেছে। আছড়ে পড়ছে মানবিকতা। রাষ্ট্রের কাঠামো তছনছ হয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতাধরকে ক্ষমতাহীন করেছে। পট আর নটের পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। মানুষের কি তাহলে পুনর্জন্ম হবে? সেটা হয়তো নয়। এতসবের মধ্যেও চিকিৎসক ও পুলিশকে স্যালুট জানাই। জান বাজি রেখে তারা সামনের কাতারে।

পুনশ্চ- মানুষ মানবিক নয় তাই বলে কি রাষ্ট্র মানবিক হবে না! চারদিকে হা-হুতাশ। রাষ্ট্র নিশ্চয় শুনতে পায়।

মতিউর রহমান চৌধুরী, প্রধান সম্পাদক, মানবজমিন।