সময় এসেছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতকে সম্পূর্ণরূপে ঢেলে সাজাতে: ড. জিয়া হায়দার

সময় এসেছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতকে সম্পূর্ণরূপে ঢেলে সাজাতে: ড. জিয়া হায়দার

১৯৮২ সালে প্রণীত একটি অধ্যাদেশ বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে। অধ্যাদেশটির নাম ‘The Medical Practice and Private Clinics and Laboratories (Regulation) Ordinance, 1982’।

আজকেই অধ্যাদেশটি পড়ে দেখলাম। অনেক দুর্বলতা থাকলেও ওই সময়ে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ১৯৮২ সালের প্রণীত অধ্যাদেশটি হয়তো সময়োপযোগী ছিল। তখন দেশের সকল ছোট থেকে বড়ো আকারের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান সরকারি ব্যবস্থাপনায় চলতো। তৎকালীন শাহবাগস্থ পিজি হাসপাতালই ছিল দেশের সর্বোচ্চ চিকৎসা প্রতিষ্ঠান। এর পরেই স্থান ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হসপিটালের।

১৯৮০ সালের কথা। ঢাকা কলেজ থেকে এইসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি। হঠাৎ আব্বা ওনার কর্মস্হল থেকে ঢাকায় আসলেন। কিডনির পাথর জনিত জটিলতায় ভুগছিলেন। ইচ্ছা ছিল দেশের সর্বোচ্চ স্বাস্থ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান পিজি হাসপাতালে অপারেশন করাবেন। শেষ পর্যন্ত ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেলেন, আর একটা কেবিনও পেলেন। আমাদের সে কি আনন্দ। যাই হোক- যা বলছিলাম। তখন বেসরকারি স্বাস্থ্য খাত বলতে বোঝাতো ডাক্তারদের প্রাইভেট চেম্বার; খুব বেশি হলে একটা ছোটোখাটো ল্যাবরেটরি। স্বাস্থ্য সেবা খাতে সরকারি ব্যয়ই ছিল মুখ্য। বেসরকরি খাতে ব্যয় ছিল নিতান্তই কম।

তাই সব কিছু বিবেচনায় ১৯৮২ সালে প্রণীত অধ্যাদেশটি হয়তো ওই সময়ের জন্য সময়োপযোগীই ছিল। কিন্তু, জনহিতকর অনেক অধ্যাদেশগুলোর মতো এই অধ্যাদেশটিও বিগত অনেক বছর ধরেই দেশীয় ও বৈশ্বিক আর্থসামাজিক অবস্থার বিবেচনায় সম্পূর্ণরূপে অপ্রচলিত ও অপ্রাসঙ্গিক। নিচের লিংকটি ক্লিক করে একটু পড়লেই আমি কি বলতে চাচ্ছি তা পরিষ্কার বুঝতে পারবেন। আজ স্বাস্থ্য খাতে দেশের মোট ব্যয়ের প্রায় ৭০ শতাংশই আসে জনগণের পকেট থেকে। এই বিশাল অংকের টাকা খরচ হয় ফার্মেসি থেকে ঔষধ কিনতে, ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে, আর বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা ভালো যে প্রেসক্রিপশন বিহীন ঔষধ কেনার তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সবার উপরের দেশগুলোর একটি যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

ধনী জনগোষ্ঠীর কথা নাই বা বললাম। মধ্যবিত্ত থেকে নিম্ন মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর অনেকেই যারা দেশের বাইরে যাওয়ার আর্থিক সঙ্গতি রাখেন না, বা অন্য কোনো কারণে যেতে পারেন না তারা সবাই ভিড় করেন বেসরকারি হাসপাতালে। আশা, বেশি বেশি নগদ টাকার বিনিময়ে কিছুটা ভালো চিকিৎসা সেবা পাওয়া। সরকারি হাসপাতালগুলোর মান নিয়ে মন্তব্য নাইবা করলাম; অবস্থা বাংলাদেশ বিমানের সাথে কিছুটা হলেও তুলনীয়। এরকম অবস্থা চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছর পড়ে সরকারি হাসপাতালে কোনো রোগী খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা আমার সন্দেহ। সুতরাং, অনেক গভীরে না যেয়েই বোঝা যায় ১৯৮২ সালে প্রণীত অধ্যাদেশটি আজকের প্রেক্ষাপটে সম্পূর্ণ অপর্যাপ্ত ও অপ্রাসঙ্গিক।

সঙ্গত কারণেই বেসরকারি হাসপাতালের মালিক পক্ষ অধ্যাদেশটি সংশোধন নিয়ে কথা বলবেন না। সংশোধন হলে রোগী বা ডাক্তারসহ সকল স্বাস্থ্য কর্মীদের সুবিধা হলেও ওনাদের ব্যবসায় একটু হলেও সমস্যা হবে। রোগীদের কাছে জবাবদিহিতা বাড়লে নরমাল ডেলিভেরি না করিয়ে সিজারিয়ান সেকশন করা যাবে না, মৃত্যু পথযাত্রী রোগীদের জিম্মি করে হাসপাতালের বিল দ্বিগুন-তিনগুন করা যাবে না, চাপের মুখে ডাক্তারদের দিয়ে অনৈতিক কাজ করানো যাবে না, স্বাস্থ্য কর্মীদের চাকরি তোপের মুখে ফেলা যাবে না, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু, আমার আজকের প্রশ্ন দলমত নির্বিশেষে সকল জনপ্রতিনিধিদের কাছে। ১৯৯১ সালের পর থেকে তথাকথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে আজপর্যন্ত ওনারা কি করেছেন? যেখানে স্বাস্থ্য দেশের একটি মহামূল্যবান এবং জনহতকর সেক্টর, সেই খাতকে সময় উপযোগী করে গড়ে তোলার ভাবনা কি ওনাদের কারো মাথাতেই আসে নাই? আর আসবেই বা কিভাবে। আমার তো মনে হয় আমাদের অধিকাংশ জনপ্রতিনিধিরা নিজেদেরকে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি ভাবতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন।

যাই হোক- আর দেরি নয়। করোনা আমাদের সবার চোখ-কান খুলে দিতে কিছুটা হলেও সাহায্য করেছে। আজ সময় এসেছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতকে সম্পূর্ণরূপে ঢেলে সাজাতে। আমাদের দেশেই অনেক মেধাবান দক্ষ বিশেষজ্ঞ আছেন যারা অন্য দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আধুনিক করতে অনেক অবদান রেখেছেন। আজ দরকার ওইসব বিশেষজ্ঞদের একমঞ্চে দাঁড় করানো। দলীয় বিবেচনায় নয়- প্রমাণিত যোগ্যতা, দক্ষতা আর মেধাই হতে হবে বিশেষজ্ঞদের খুঁজে বের করা আর দেশের সরকারি আর বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর পরিমাপক। আমার বিশ্বাস সবাই এক সাথে মিলেমিশে দেশে জন্য, দেশের মানুষের স্বার্থে কাজ করলে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও সেবার মান যে কোনো মধ্যম আয়ের দেশের সমপর্যায়ে নেওয়া দু-এক বছরেই সম্ভব। শুধু দরকার সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি আর দুর্নীতির প্রতি প্রকৃত অর্থে জিরো টলারেন্স।

আসুন আমার সবাই মিলে আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বল দিকগুলো বেশিবেশি আলোচনায় না এনে প্রসঙ্গ-নির্দিষ্ট সমাধান কি হতে পারে তাই নিয়ে আলোচনা করি- জনমত গড়ে তুলি।

(ড. জিয়া হায়দারের ফেসবুক থেকে নেয়া)