এন্টি ভাইরাস, প্রো-ভাইরাস

এন্টি ভাইরাস, প্রো-ভাইরাস

রিজভী আহমেদ
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব

বিগত কয়েক মাস ধরে চলছে করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ এর বৈশ্বিক আধিপত্য। তামাম দুনিয়াজুড়ে অপরিচিত ও আকস্মিকভাবে পাওয়া এ ভাইরাসের বেপরোয়া অভিযানে আতঙ্কিত বিশ্ব সম্প্রদায়। মানুষের জীবন-মৃত্যু যেন এ ভাইরাসের পায়ের তলায় খেলা করছে।

স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ হারিয়ে অসহায়ত্ব, ক্ষুব্ধতা, অভিযোগ, আত্মসমর্পণ, অদৃষ্টের কর্তৃত্ব, সামাজিক অধঃপতন, আধ্যাত্মবাদ, বিজ্ঞান চেতনা ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গের অবতারণা করে স্বস্তি খোঁজার প্রচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে মানুষ।

গবেষণা ও স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে না তাকিয়ে এ ভাইরাস ল্যাবরেটরিজাত নাকি ন্যাচারাল অরিজিন, তা নিয়েও চলছে বিতর্ক।

কেউ কেউ বলছেন- ক্ষমতাধর কোনো একটি রাষ্ট্র ল্যাবরেটরিতে জীবাণু অস্ত্র পরীক্ষা করার সময় অসাবধানতাবশত এ ভাইরাস বেরিয়ে পড়ে। আবার কেউ কেউ মনে করেন, এটি প্রকৃতি-জাত। বহুদিন তারা কয়েকটি প্রাণীর মধ্যেই নিজেদের ঠিকানা নির্দিষ্ট রেখেছিল। এখন তারা বিশ্বজয় সম্পন্ন করেছে।

সমাজতাত্ত্বিকদের অভিমত- এ ভাইরাসের অভিঘাতে গড়ে ওঠা দীর্ঘদিনের সামাজিক বন্ধন ছিন্ন হচ্ছে। এই ছোঁয়াচে রোগের বিস্তাররোধে শারীরিক দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ার কারণে অজানা-অপরিচিত এক রাষ্ট্রসমাজ গড়ে উঠতে পারে। করোনাভাইরাস মৃত্যুর দূত হয়ে আসায় প্রিয় ও ঘনিষ্ঠজনরা পরস্পরকে দেখছে আতঙ্কের চোখ দিয়ে।

আবহমানকালের সামাজিক বন্ধনের মোজাইককে এ ভাইরাস যেভাবে আঘাত করেছে, তাতে নিরুপায় মানব সম্প্রদায়ের দিন কাটছে শঙ্কা ও আতঙ্কের মধ্যে। মানব সম্প্রদায় নিজেদের পরিণাম নিয়ে উদ্বিগ্ন। উপায়ান্তরহীন মানুষ প্রতিদিনই হতাশার অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হয়ে এ ভাইরাসকে দৈব অভিশাপ হিসেবে দেখছে।

এখনও প্রতিরোধের সব বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টাকে কঠিনভাবে প্রতিহত করে যাচ্ছে এ দিগ্বিজয়ী কোভিড-১৯ ভাইরাস। প্রতিদিনই মহামারীর বিধ্বংসী তাণ্ডবে সৃষ্ট মৃত্যুর কাফেলা দেখতে হচ্ছে মানুষকে। এ নিয়ে বেঁচে থাকা বিপন্ন ও ক্ষুব্ধ মানুষের করুণ ও বিষাদময় পরিস্থিতি অবলোকন করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। করোনার আঘাত থেকে বাঁচতে এক অচেনা পরিবেশের বাধ্যবাধকতায় মানুষকে থাকতে হচ্ছে ঘরে বসে। আবার ঘরে থাকলে খাবার জুটবে না। এ নিয়ে চলছে মানবজাতির এক মহাক্রান্তিকাল।

ভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে স্বাস্থ্য বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে পরস্পরের প্রতি বৈরী ক্ষমতাবান দেশগুলোও পারস্পরিক অভিযোগে একে অপরকে দায়ী করছে। অথচ একচক্ষু নয় বহুচক্ষুর এ দৈত্যকে বোতলে ভরার কাজটি করতে এখনও পর্যন্ত কেউ সক্ষম হয়নি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চাবিকাঠি উন্নত ও শক্তিধর রাষ্ট্রের হাতে থাকার পরও জলপাইয়ের পাতার মুকুট এখন পর্যন্ত করোনার শিরে।

তাই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা থেকে মহাবিশ্বের দিকে ধাবিত জ্ঞান-বিজ্ঞান মানুষ অর্জন করলেও করোনা মোকাবেলায় এখন পর্যন্ত কৃতকার্য হতে পারেনি। তাই বিজয়রথে আসীন করোনাভাইরাসের প্রতি অসহায় ও তার সঙ্গে পেরে না ওঠার গ্লানিতে মানুষের মন বিদ্বিষ্ট। ‘আমরা করোনার চেয়েও শক্তিশালী’- প্রভাবশালীদের এমন হুংকারেও লাভ হয়নি।

কিছুদিন পর প্রধানমন্ত্রীকে স্বীকার করতে হয়েছে- করোনাই সবচেয়ে শক্তিশালী। মানুষ অপেক্ষা করছে করোনা ধ্বংসে বিজ্ঞানের বিজয়বার্তা শোনার জন্য।

আবার একই সঙ্গে করোনার সঙ্গে সহাবস্থান ও সহমর্মিতার কথাও শোনা যাচ্ছে। রোগ, চিকিৎসা ও ওষুধ সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনার স্থায়িত্ব ও সহাবস্থান নিয়ে কথা বলার পর থেকে বেশ কিছুদিন করোনার সঙ্গে বসবাসের মানসিক প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেছে বিশ্ব জনগোষ্ঠী। কারণ মানুষ ভেবে নিয়েছে, ভ্যাকসিন আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত করোনা সঙ্গী হিসেবেই থাকবে।

এখন পর্যন্ত বেশকিছু উন্নত ও অনুন্নত দেশেও করোনা ঝড়ের গতি স্তিমিত হয়নি কিংবা স্তিমিত হলেও দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাত শুরু হয়েছে। যেমন- করোনার উৎপত্তিস্থল চীনে আবার নতুন করে কয়েকটি শহরে লকডাউন দেয়া হয়েছে। কয়েকদিন আগে ১২শ’ ফ্লাইটের উড্ডয়ন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ায়ও দ্বিতীয় ‘ওয়েভ’ এর ধাক্কা এসে লেগেছে।

অতএব এ মর্মে মানুষের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে- করোনার সঙ্গে লড়াই ছড়া গত্যন্তর নেই। তাই মানুষ ভাবছে করোনার প্রতি আক্ষেপ করে লাভ নেই, এটি অদৃষ্টের লিখন, পরিণতি যা আছে তা অবধারিত।

করোনার ধ্বংসলীলার প্রভাবে অনেক মানুষের মধ্যে আধ্যাত্মিকতা জেগে উঠেছে। আক্রান্ত ও মৃত্যুর পরিসংখ্যানের বিতর্কে নির্লিপ্ত মানুষ কাল-মহাকালের চিন্তায় মগ্ন হচ্ছে। আত্মা ও পরমাত্মার মহামিলনের নানা বাণী, কবিতা এবং গানের চর্চা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে- যার বহিঃপ্রকাশ দেখি সামাজিক গণমাধ্যমে।

অনেকেই মনে করেন- বিশ্ব জনসমাজে মানুষ পথবিচ্যুত, প্রতিকারহীন অপরাধ ও ভয়াবহ নৈতিক স্খলনের ফলেই এ ভাইরাসের বিশ্বব্যাপী আধিপত্য। তাই অনেকেই এটিকে প্রকৃতির প্রতিশোধ হিসেবে মেনে নিয়েছেন অবধারিত ও অবশ্যম্ভাবীরূপে।

একটি অগ্রসর সভ্যতা কোনো কারণে ধ্বংসযজ্ঞের সম্মুখীন হলে পরাজিত ও হত্যোদ্যম নিরুপায় মানুষ মরমি চিন্তার দ্বারা আচ্ছন্ন হয়। মধ্যযুগে বর্বর জাতিগোষ্ঠীর আক্রমণে খ্রিস্টীয় রোমান সাম্রাজ্য ধ্বংসের সময় ইউরোপের খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীর অনেকেই সংসারবিমুখ হয়ে গীর্জা ও মঠের শরণাপন্ন হয় এবং সন্ন্যাস-জীবন শুরু করে। তারা মনে করে, এটিই মুক্তির পথ।

মধ্যযুগের শেষ পর্যায়ে ১৪ শতকে ইউরোপে প্লেগের প্রাদুর্ভাবে সেখানে অর্ধেক মানুষ মারা যায়। প্লেগের এ বিনাশী ভূমিকায় ইউরোপে জীবন-দর্শন, মৃত্যুচিন্তা এমনকি ধর্মশাস্ত্র অনেকখানি প্রভাবিত হয়েছিল। শিল্প ও সাহিত্যে মৃত্যু ঘুরেফিরে এসেছে নানা চেহারা নিয়ে। সেখানেও প্লেগকে দেখা হতো ঈশ্বরের শাস্তি হিসেবে। যুগে যুগে মহামারী মানুষের জীবনকে নানাভাবেই বদলে দিয়েছে।

তবে চলমান করোনা মহামারীর পরিণতি কী হবে, তা কে জানে? মানুষের আশা, বাঁচা, অভিযোগ, আবেগ, অসহায়ত্ব, অস্থিরতার একদিন হয়তো অবসান হবেই, বিজ্ঞানী ও গবেষকদের অক্লান্ত পরিশ্রমে অচিরেই হয়তো একটি সমাধানসূত্র খুঁজে পাওয়া যাবে; যা কিনা এখনও মানবজাতির অগোচরে থাকছে। আর এ মুহূর্তে যিনি জানেন তিনি হয়তো নীরবে হাসছেন।

যেমন : রবীন্দ্রনাথ তার এক কবিতায় বলেছেন- রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহাধুমধাম/ভক্তরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম/রথভাবে আমি দেব, পথ ভাবে আমি/মূর্তি ভাবে আমি দেব, হাসে অন্তর্যামি।