অমর অম্লান জিয়াউর রহমান

অমর অম্লান জিয়াউর রহমান

মাহবুবা জেবিন

বাংলাদেশ এবং বাঙালি জাতির প্রতিটি ক্রান্তিকালে আলোর মশাল হাতে সাহসিকতা, প্রজ্ঞা এবং দেশপ্রেমের মাধ্যমে কাণ্ডারির ভূমিকা পালন করেছেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ।

১৯৭১ সালে জাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সংকটময় মুহূর্তে তৎকালীন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতাদের অদূরদর্শিতার ফলে রাজনৈতিক আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণের সুযোগে, হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী রাতের অন্ধকারে দেশের নিরীহ মানুষের উপর অস্ত্রহাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে । ট্যাঙ্ক আর মেশিনগানের গুলির আঘাতে ২৫ শে মার্চ এক রাতের মধ্যেই প্রাণ হারায় লক্ষ লক্ষ শিশু নারী ও পুরুষ । হামলা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ পুলিশ, ইপিআর সদর দপ্তরে । ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমজীবী থেকে ঘুমন্ত শিশু কেউ এই হত্যাযজ্ঞ থেকে রেহাই পায়নি ।

এদিকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ‘সোয়াত’ নামে সেনা ও অস্ত্রভর্তি একটি জাহাজ আসে চট্টগ্রাম বন্দরে । এসময় জিয়াউর রহমানের কর্মস্থল (৮ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট) চট্টগ্রামের কমান্ডিং অফিসার লে কর্নেল জানজুয়া তাঁকে পাঠান সেই অস্ত্র খালাস তদারকি করতে । পথিমধ্যে জিয়াউর রহমানকে অলি আহমদের থেকে প্রাপ্ত সতর্কবার্তা এবং ঢাকার হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে অবগত করেন ক্যাপ্টেন খালেক । জিয়াউর রহমান তাৎক্ষনিক ভাবে ফিরে আসেন হেডকোয়ার্টারে । কোয়ার্টার গার্ডের সামনে কর্তব্যরত একজন বাঙালি সৈনিকের কাছ থেকে স্টেনগান ছিনিয়ে নিয়ে জিয়াউর রহমান বলেন “উই রিভোল্ট” । লে আজম ও সাথে থাকা পাকিস্তানি সেনাদের নিরস্ত্র করে আটক করেন এবং ফিরে আসেন সেনানিবাসে । লে কর্নেল জানজুয়া সহ অন্য পাকিস্তানি অফিসারদের আটক করা হয় । পরবর্তী কালে তাদের হত্যা করা হয় । জিয়াউর রহমান বাঙালি সেনা সদস্যদের নিয়ে চট্টগ্রাম শহরের কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন ।

‘যুদ্ধজয়ের দিনগুলি’ নামক স্মৃতিকথায় বীর মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকা বলেছেন,- “তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে এদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন । তার সেই ঐতিহাসিক ঘোষণার মাধ্যমে নির্দেশনাহীন জাতি একটি সঠিক দিক নির্দেশনা পেল; যার ফলে সেনাবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ, আনসার, ছাত্র জনতা যুদ্ধে যোগদানে অনুপ্রাণিত হন । অন্যদের মতো আমিও সেই ঘোষণায় অনুপ্রাণিত হয়ে যুদ্ধে যোগদানের পথ খুঁজে পেয়েছিলাম । ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রায় পুরো জাতি অংশগ্রহণ করেছিলো । তাই এটা ছিল একটা জাতীয় জনযুদ্ধ” ।

রেহমান সোবহানের মন্তব্যে, “ ২৭ মার্চ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনগন এবং পরে সারা বিশ্বের মানুষ একজন অপরিচিত মেজরের কণ্ঠ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা শুনতে পায়” । (সোবহান, ১৯৯৩:৩৩)

মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ তাঁর ‘ Bangladesh, At War’ বইয়ের ৪৪ নাম্বার পৃষ্ঠায় লিখেছেন-“ 17 wings of the east Pakistan rifles from Captain on their way to join Rafiq in the city was intercepted by Zia at 8.00 Hours on March 26. They were then in Co-operated within force. All the troops then took an oath of allegiance to Bangladesh. The oath was administrated by Zia at 16.00 Hours on March 26. There after he distributed 350 solders of East Bengal Regiment and about 200 troops of East Pakistan Rifles to various task forces under command of an officer each. This task forces were mend for the city. The whole city of Chittagong was divided into various sectors and each sector was given to a task force.

After having made this arrangement, Zia made his first announcement on the Radio on March 26. In this announcement apart from saying that they were fighting against Pakistan army he also declared himself as the Head of the State.”

ডঃ কর্নেল অলি আহমদ লিখেছেন,- জিয়া উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত ছিলেন । আসল খসড়ার বিষয়বস্তু ছিল: “ আমি মেজর জিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি এবং নিজকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করছি” । এই ঘোষণায় জিয়া সকল বাঙালি সেনা অফিসার, সৈনিক, প্যারামিলিটারি, পুলিশ, আনসার এবং বেসামরিক ব্যাক্তিদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবার আহবান জানান । তিনি আরও বলেন যে, ৮ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ২৫/২৬ মার্চ রাতে পাকিস্তানি জান্তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে । তিনি এ ব্যাটেলিয়নের অফিসারদের নামও ঘোষণা করেন । আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পূর্ণসমর্থন ও বাংলাদেশেকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের আহবান জানান ।(রাষ্ট্রবিপ্লব, সামরিক বাহিনীর সদস্যবৃন্দ এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধঃ ডঃ কর্নেল অলি আহমদ বীর বিক্রম(অব), পৃষ্ঠা-১৪২)

“রাষ্ট্রনায়ক জিয়া” নামক বইতে ডঃ আবদুল লতিফ মাসুম লিখেন-“১৯৭১- এ মুক্তিযুদ্ধের সেই সংকট-সন্ধিক্ষণে রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন পরবর্তী করনীয় বা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কোন রকম নির্দেশনা দিতে ব্যরথ হয়, তখন জিয়াউর রহমানের ঘোষণা যথার্থ ভাবেই জাতিকে সঠিক নির্দেশনা দিয়েছে; মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা দিয়েছে” ।

জিয়াউর রহমান শুধু মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দিয়েও ক্ষান্ত থাকেননি । স্বাধীনতার ঘোষণাকে বাস্তবে রূপ দিতে বাঙালি সৈনিক এবং স্বাধীনতাকামী সাধারণ জনতাকে সংগঠিত করে বিক্ষিপ্ত লড়াই ও প্রতিরোধকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে উন্নীত করেন । অতুলনীয় দেশপ্রেম, অপরিসীম সাহস, অনন্য দূরদর্শিতা আর বীরত্বপূর্ণ অবদানের মাধ্যমে ছিনিয়ে আনেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ।

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান রয়েছেন বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের হৃদয়ের মণিকোঠায় । শুধু ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধেই নয়, ১৯৭৫ সালের বিয়োগান্ত পট পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক-সামাজিক, -অর্থনৈতিক অস্থির পরিস্থিতিতে জাতিকে চরম বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে আবারো কাণ্ডারির ভূমিকা পালন করেন জিয়াউর রহমান ।

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জিল্লুর রহমান খানের ভাষায়, “১৯৭৫ সালে আগস্ট অভ্যূথান পরবর্তীকালে জাতি যখন নেতৃত্বের সঙ্কটে ভুগছিল, তখন জিয়াউর রহমানের নেতৃত্ব কুশলতা আমাদের গোটা জাতিকে আশীর্বাদ ধন্য করেছে এবং শান্তি, স্বস্তি ও স্থিতিশীলতা দিয়েছে”।

প্রফেসর এমাজউদ্দিন আহমদ সঙ্গত ভাবেই মন্তব্য করেন যে, “ Zia saved Bangladesh army from an impending doom” .

‘রাষ্ট্রনায়ক জিয়া’ বইতে ডঃ আবদুল লতিফ মাসুম বলেন, “ মুক্তিযুদ্ধকালীন জিয়ার ক্যারিশমা এবং সাধারন সৈনিকদের কাছে প্রশ্নহীন গ্রহণযোগ্যতা তাঁকে সময়ান্তরে ৭ নভেম্বরে সিপাহী জনতার বিপ্লবের কেন্দ্রবিন্দুতে প্রতিস্থাপন করে । এরপরের সময়টি ছিল আরও সুকঠিন । অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা, জাসদের সশস্ত্র গণবাহিনীর প্রতিবিপ্লব প্রচেষ্টা, সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার অপতৎপরতা, নেতৃত্বশূন্যতা, অফিসারদের ভীতিপ্রবনতা, সর্বপরি সেনাবাহিনীর রাজনীতিকিকরনের বিষবৃক্ষ সকলের অজান্তে ফুল ও ফলে গোটা প্রতিষ্ঠানকে ধবংসের প্রান্তসীমায় নিয়ে গিয়েছিল । জিয়াউর রহমানের অক্লান্ত পরিশ্রম, কোমল ও কঠিনের সমন্বয় কৌশল, অসীম সাহস, দৃঢ়তা এবং প্রশাসনিক দক্ষতা সেনাবাহিনীকে শৃঙ্খলাপূর্ণ অবস্থানে ফিরিয়ে দেয়” ।

ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সঞ্জীব রেড্ডী ১৯৭৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর দিল্লীতে অনুষ্ঠিত এক রাষ্ট্রীয় ভোজসভায় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উচ্ছসিত প্রশংসা করে জিয়াউর রহমানের উদ্দেশ্যে বলেন- “Your position is already assured in the annals of the history of your country as a brave freedom fighter who was the first to declare the independence of Bangladesh”
“ প্রথম বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে তিনি যেভাবে একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে ভূমিকা পালন করেছেন, তাতে বাংলাদেশের ইতিহাসে তাঁর নাম চিরদিনের জন্য সংরক্ষিত থাকবে” ।

বাংলাদেশের প্রতিটি কঠিন সময়ে ত্রাতার ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছেন জিয়াউর রহমান । তৎকালীন রাজনৈতিক নেতারা যেখানে ব্যরথ ঠিক সেখানেই জিয়াউর রহমান হয়েছেন সবচেয়ে সফল । ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর থেকে ১৯৮১ সালের ৩০ মে, রাষ্ট্রপতি হয়ে মাত্র সাড়ে চার বছরে, গণমুখী পরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলাদেশকে নির্মাণ করেছিলেন উদার ও আধুনিক ধারায় । প্রবর্তন করেছেন বহুদলীয় গণতন্ত্রের । বিচক্ষণতা এবং দূরদর্শিতার ফলে অল্প দিনের মধ্যেই বাংলাদেশকে পরিচিতি এনে দিয়েছিলেন বিশ্বদরবারে । শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বেঁচে থাকবেন তাঁর দেশপ্রেম এবং কীর্তির মাঝে ।

লেখকঃ সাংবাদিক