বিএনপির ১০ ডিসেম্বরের ঢাকার গণসমাবেশ নিয়ে সরকারের ভেতর জুজুর ভয় কেন?

বিএনপির ১০ ডিসেম্বরের ঢাকার গণসমাবেশ নিয়ে সরকারের ভেতর জুজুর ভয় কেন?

মাহমুদ আজহার

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি একটি মধ্যমপন্থি, উদারপন্থি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সব মতের মানুষকে নিয়েই এ দলটি তৈরি করেন। এখানে ডান, বাম, উদারপন্থি, কট্টরপন্থি সবার উপস্থিতিই কম বেশি আছে। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত। জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর দলটির হাল ধরেন বেগম খালেদা জিয়া। দলের ভেতরে বাইরে তিনি বাংলাদেশে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। বিগত সময়ে নির্বাচনে সেটি প্রমাণিত হয়। এখনও তাই। বর্তমানে তিনি ‘কারাবন্দি’ হিসেবে সরকারের নির্বাহী আদেশে নিজ বাসভবনে অবস্থান করছেন। 

বিগত ১৫ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে বিভাগীয় শহরগুলোতে গত দুই মাস ধরে সমাবেশ করে আসছে। পুলিশ ও ক্ষমতাসীনদের নানামূখী বাধার পরেও সেগুলো সফল হয়েছে। এরই ধারাবাহিকায় ১০ ডিসেম্বর রাজধানীতে সমাবেশের ডাক দেয় বিএনপি। দলের নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এই সমাবেশ করার পরিকল্পনা নিয়ে আগায় বিএনপি। রাজশাহী বিভাগীয় সমাবেশ শেষে এরই মধ্যে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা ঢাকার উদ্দেশ্যে আসতে শুরু করে। প্রতিদিনই নেতা-কর্মীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়। 

বিএনপির সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে যতটুকু জানতে পেরেছি, এই সমাবেশ থেকে সরকারের কাছে বেশকিছু দাবি দাওয়া তুলে ধরবে বিএনপি। এটাই হবে প্রথম পর্যায়ের শেষ সমাবেশ। এরপর ধাপে ধাপে আরও কিছু কর্মসূচি দেবে বিএনপি। সমাবেশ থেকে নির্ব্চানকালীন সরকারের রূপরেখাও তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নেয় দলটি। তাদের দাবি বাস্তবায়নে সরকারকে একটি আল্টিমেটামও দেওয়ার চিন্তা ছিল বিএনপির। কিন্তু সরকার এতটাই ভয় পেয়ে যায় যে, তাদের কাছে কিছু ঊড়ো খবর যায়, খালেদা জিয়া সমাবেশে যোগ দেবেন। সমাবেশে নেতা-কর্মীরা বসে পড়বেন। সরকার পতন না হ্ওয়া পর্যন্ত রাজধানীতেই অবস্থান করবেন। এ কারণে গত এক সপ্তাহ ধরে খালেদা জিয়ার গুলশানের বাসভবনের সামনে তল্লাশি চৌকি বসায় পুলিশ। বাইরে থেকে কেউ যেন খালেদা জিয়ার বাসায় যেতে না পারেন কিংবা খালেদা জিয়া যেন বাসা থেকে বেরুতে না পারেন সেটাই মূল লক্ষ্য। মূলত বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোই সরকারের কাছে এসব উদ্ভট তথ্য দিয়ে তা ছড়িয়ে দেয়। বিএনপির সমাবেশকে বানচাল করতেই এই পরিকল্পনা নেওয়া হয়। 

এ কারণে ভিত হয়ে সরকার পুলিশ দিয়ে সমাবেশের তিন দিন আগেই কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলা ভাংচুর করে রিজভী আহমেদ, আমান উল্লাহ আমান, আবদুস সালাম, শিমুল বিশ্বাস, খায়রুল কবীর খোকন, ফজলুল হক মিলন, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, আবদুল কাদের ভুইয়া জুয়েল, আবদুল খালেক, মুনির হোসেন, সেলিমুজ্জামান সেলিম, আবদুল বারী ড্যানিসহ তিন শতাধিক নেতা-কর্মীকে আটক করে নিয়ে যায়। পার্টি অফিসের সব রুম ভাংচুর করে দপ্তর শাখা থেকে গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু ডকুমেন্ট নিয়ে যায়। মকবুল হোসেন নামে এক দলীয় কর্মী মারা যান পুলিশের গুলিতে। শতাধিক আহতও হয়। গুলিবিদ্ধ কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। 

তাহলে ঢাকার সমাবেশ নিয়ে সরকারের এত জুজুর ভয় কেন? আগেভাগেই কেন বিএনপির উপর তান্ডব চালানো হলো। তিন শতাধিক নেতা-কর্মীকে কেন গ্রেফতার করা হলো। বিএনপি তো গত তিন মাস ধরে নয়াপল্টনে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করে আসছে। সভা সমাবেশ করছে। কোনো সমস্যা তো হয়নি। প্রথম আলোর তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর-এই তিন মাসে নয়াপল্টনে নিজেদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের সড়কে হাজারো নেতা-কর্মীর উপস্থিতিতে বিএনপি সমাবেশ করেছে ১১টি। কোনোটির আয়োজক ছিল ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপি। আবার কোনোটি করেছে যুবদল, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মহিলা দল বা কৃষক দলের ব্যানারে। গত সেপ্টেম্বর মাসে দুটি (১৮ ও ২৯ সেপ্টেম্বর), অক্টোবর মাসে দুটি (২০ ও ২৭ অক্টোবর) এবং গত নভেম্বর মাসে শুধু নয়াপল্টনে মোট সাতটি সমাবেশ (২, ৭, ৮, ১০, ১৭, ১৮ ও ৩০ নভেম্বর) করেছে বিএনপি। এর মধ্যে গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপি নয়াপল্টনে যে সমাবেশ করেছে, নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে তা জনসভায় রূপ নেই। নেতাকর্মী সমর্থকদের ভিড় নয়াপল্টন ছাড়িয়ে আশপাশের এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। স্বাভাবিক কারণেই সেদিন নয়াপল্টন এলাকায় যান চলাচল বাধাগ্রস্ত হওয়ায় ব্যাপক জনদুর্ভোগ হয়েছে। রাজধানীর অন্য এলাকার মানুষকেও যানজটের যন্ত্রণা সইতে হয়েছে। ফলে নয়াপল্টনের ১০ ডিসেম্বরের গণসমাবেশের পেছনে জনদুর্ভোগের বিষয়টিই একমাত্র কারণ হলে পুলিশ কেন তখন নীরব ছিল, সে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়। সম্প্রতি কয়েকটি ইসলামী ব্যাংক থেকে ১৪ হাজার কোটি টাকা পাচারের তথ্য যখন গণমাধ্যমে আসে তখন সরকার বিষয়টি ধামাচাপা দ্ওেয়ার জন্য বিএনপির সমাবেশের স্থান নিয়ে নতুন নাটক তৈরি করে। বিএনপিকে প্রথমে নরম ভাষায় বলে দ্ওেয়া হয়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কিংবা টঙ্গীর তুরাগ নদীর পাড়ে সমাবেশ করলে পুলিশ পুরো নিরাপত্তা দেবে। পুলিশ আরও একধাপ এগিয়ে বিএনপিকে ২৬ শর্তে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দিয়ে নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আদবের সঙ্গে চিঠি নিয়ে যায়। কিন্তু বিএনপির পক্ষ থেকে সমাবেশের জন্য সোহর্ওায়ার্দী উদ্যান কিংবা টঙ্গীর জন্য আবেদনই করা হয়নি। তাহলে কেন খুশিতে ঠেলায় পুলিশ নিজের মতো করে ২৬টি শর্ত সাজিয়ে সোহর্ওায়ার্দী উদ্যানের অনুমতিপত্র নিয়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হাজির হলো। শর্তগুলোও ছিল বেশ মজার। হাসির খোরাকের স্বার্থের পাঠকদের কাছে শর্তগুলো তুলে ধরছি। 

১. এই অনুমতিপত্র স্থান ব্যবহারের অনুমতি নয়, স্থান ব্যবহারের জন্য অবশ্যই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হবে।
২. স্থান ব্যবহারের অনুমতিপত্রে উল্লেখিত শর্তাবলি যথাযথভাবে পালন করতে হবে।
৩. সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অভ্যন্তরে সমাবেশের যাবতীয় কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
৪. নিরাপত্তার জন্য নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পর্যাপ্তসংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক (দৃশ্যমান আইডি কার্ডসহ) নিয়োগ করতে হবে।
৫. স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের নির্দেশনা অনুযায়ী নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সমাবেশস্থলের অভ্যন্তরে ও বাইরে উন্নত রেজ্যুলেশনযুক্ত সিসি ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে।
৬. নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় প্রতিটি প্রবেশগেটে আর্চওয়ে স্থাপন করতে হবে এবং সমাবেশস্থলে আগতদের হ্যান্ড মেটাল ডিটেক্টরের মাধ্যমে (ভদ্রোচিতভাবে) চেকিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
৭. নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় Vehicle Scanner/Search Mirror এর মাধ্যমে সমাবেশস্থলে আসা সব যানবাহন তল্লাশির ব্যবস্থা করতে হবে।
৮. নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সমাবেশস্থলে অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা রাখতে হবে।
৯. সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বাইরে বা সড়কের পাশে মাইক/সাউন্ডবক্স ব্যবহার করা যাবে না।
১০. সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বাইরে বা সড়কের পাশে প্রজেক্টর স্থাপন করা যাবে না।
১১. সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বাইরে, রাস্তায় বা ফুটপাতে কোথাও লোক সমাবেত হওয়া যাবে না।
১২. আযান, নামাজ ও অন্যান্য ধর্মীয় সংবেদনশীল সময়ে মাইক/শব্দযন্ত্র ব্যবহার করা যাবে না।
১৩. ধর্মীয় অনুভূতির ওপর আঘাত আসতে পারে, এমন কোনো বিষয়ে ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন, বক্তব্য প্রদান বাপ্র্রচার করা যাবে না।
১৪. অনুমোদিত সময়ের মধ্যে সমাবেশের সার্বিক কার্যক্রম শেষ করতে হবে।
১৫. সমাবেশ শুরুর ২ (দুই) ঘণ্টা আগে লোকজন সমবেত হওয়ার জন্য আসতে পারবে।
১৬. সমাবেশস্থলের আশপাশসহ রাস্তায় কোনো অবস্থাতেই সমবেত হওয়াসহ যান ও জন চলাচলে কোনো প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না।
১৭. পতাকা, ব্যানার, ফেস্টুন বহনের আড়ালে কোনো ধরনের লাঠিসোঁটা, রড ব্যবহার করা যাবে না।
১৮. আইনশৃঙ্খলা পরিপন্থী ও জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়, এমন কার্যকলাপ করা যাবে না।
১৯. রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কার্যকলাপ ও বক্তব্য প্রদান করা যাবে না।
২০. উসকানিমূলক কোনো বক্তব্য প্রদান বা প্রচারপত্র বিলি করা যাবে না।
২১. মিছিলসহকারে সমাবেশস্থলে আসা যাবে না। পরিস্থিতি অবনতি হলে আয়োজনকারী কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে।
২৪. স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে অনুসরণ করে সমাবেশ পরিচালনা করতে হবে।
২৫. উল্লিখিত শর্তাবলি যথাযথভাবে পালন না করলে তাৎক্ষণিকভাবে এই অনুমতির আদেশ বাতিল বলে গণ্য হবে।
২৬. জনস্বার্থে কর্তৃপক্ষ কোনো কারণ দর্শানো ব্যতিরেকে এই অনুমতি আদেশ বাতিল করার ক্ষমতা সংরক্ষণ করে।

এতেই বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে সন্দেহের দানা আরও বাড়তে শুরু করলো। সরকার সমাবেশ নিয়ে বড় ধরনের কোনো ষড়যন্ত্র করতে পারে সেই শঙ্কাও ছিল বিএনপিতে। তাই দলের স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দলীয় কার্যালয়ের সামনেই সমাবেশ করতে পরিকল্পনা করে বিএনপি। তবে বিকল্প হিসেবে আরামবাগ মাঠও ছিল বিএনপির দ্বিতীয় পছন্দের। 

সমাবেশে কি ঘোষণা আসতে পারে তা জার্মানভিত্তিক বাংলা সংবাদ সংস্থা ডয়েচে ভেলেতে খালেদ মহিউদ্দিনের এক সাক্ষাৎকারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমরা মূলত প্রাথমিক পর্যায়ের শেষ ধাপের সমাবেশ করবো ঢাকায়। এখানে আমরা সরকারকে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু দাবিদাওয়া তুলে ধরবো। সেইসঙ্গে পরবর্তীতে আবারও কিছু কর্মসূচি ঘোষণা করবো।’

অনেকেই বলছেন, সরকার ও প্রশাসনের প্রভাবশালী আরও কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে ১০ ডিসেম্বর স্যাংশন আসতে পারে। সরকারও বিষয়টি আচ করতে পেরেছে। সরকারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীও সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, দ্বিতীয়দফা স্যাংশন ন্যায্য হবে না। এ দিকে বিএনপি অফিসে পুলিশের তান্ডবের একদিন আগে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইইউ এবং পশ্চিমা ১৪টি দেশের রাষ্ট্রদূত বা হাই কমিশনাররা একযোগে বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, বিরোধী দলকে শান্তিপূর্ণভাবে সভা-সমাবেশ করতে দিতে হবে। সবার অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভক্তিমূলক নির্বাচনও তারা প্রত্যাশা করেন। দেশের অর্থনৈতিক দৈন্যদশার মধ্যেই রাজনৈতিক অস্থিরতা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিদ্যুৎ-গ্যাস সঙ্কট, যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশন ভীতি, পশ্চিমা কূটনীতিকদের একযুগে বিবৃতি, ভারত-চীনের কূটনীতিতে ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে উভয়সঙ্কটে পড়ে সরকার মনে হয় ক্ষমতা হারানোর চরম দুশ্চিন্তায় আছে। তাই হয়তো অনেকটা ভয়ে ভীত হয়ে শেষ রক্ষা করতে গিয়ে বিএনপির উপর এমন মরণকামড় দিয়ে সরকার নিজেদের জানান দিতে চায়, তারা ভীত নন। আগামীতেও তারা ক্ষমতায় আসছেন। সব রাজনৈতিক বিশ্লেষণ বলছে, সরকার ক্ষমতা হারানোর ভয়ে চরম ভীত। তাদের অবস্থান এখন তলানিতে। যে কোনো সময় গদি উল্টে যেতে পারে। 
লেখক : সাংবাদিক 

(এখানে প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্ত নিজস্ব, জাস্ট নিউজ বিডি ডটকম’র সম্পাদকীয় বিভাগের আওতাভুক্ত নয়)