জাতীয় পার্টি কি আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন!

জাতীয় পার্টি কি আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন!

মাহমুদ আজহার

সংসদের প্রধান বিরোধী দল বলে দাবিদার জাতীয় পার্টি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের পুতুলে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা তাদের যেমনি নাচায় তেমনি নাচে। সমালোচকরা বলছেন, জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের একটি অঙ্গ সংগঠনের ভূমিকা পালন করছে। সম্প্রতি গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেবর ভাবির (রওশন এরশাদ ও জিএম কাদের) মান ভাঙাতে ডাকেন গণভবনে। গণমাধ্যমে পাওয়া তথ্যমতে, পদ নিয়ে ঝগড়া বিবাদ না করতে শেখ হাসিনা তাদের নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনিত গৃহপালিত বিরোধী দলে রাখার আশ^াস দেন। এই আশ^াসে দেবর ভাবি খুশি হয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে চা পান করে চলে আসেন।

পাঠকদেন নিশ্চয় খেয়াল আছে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান মরহুম হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। আওয়ামী লীগ কোনোভাবেই তাকে বাগে আনতে পারছিল না। ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং বিশেষ বিমানে ঢাকায় এসে এরশাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী সুজাতা সিং ভোট অংশ নিতে এরশাদকে চাপ দেন। তারপরও এরশাদ নির্বাচনে না যাওয়ার কথা পুনর্ব্যক্ত করে সাংবাদিকদের বলেন, “আমার শেষ কথা হচ্ছে, আমি নির্বাচনে যাচ্ছি না।”এরশাদ বলেন, নির্বাচন না হলে ‘অগণতান্ত্রিক শক্তি কিংবা জামায়াত-শিবিরের’ উত্থান ঘটতে পারে বলে আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন সুজাতা সিং। আমি তাকে বলেছি। জামায়াত-শিবিরের উত্থান হোক, এটা আমিও চাই না। যদি উত্থান ঘটে, তাহলে সে দায় সরকারের, আমার নয়।” সুজাতা সিংকে এরশাদ বলেন, ‘খবর নিয়ে দেখেন- এই সরকারের কোনো জনপ্রিয়তা নেই। মানুষ তাদের আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না।’ এরপর এরশাদকে আর বাসায় পাওয়া যায়নি। জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা বলেন, সরকার প্রধানের নির্দেশে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে জোর করে বাসা থেকে নিয়ে সিএমএইচে ভর্তি করান। সেখানে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে নির্বাচনে যেতে রাজি করান। জেনারেল মঞ্জুর হত্যা মামলার ফাসি হওয়ার ভয় দেখানো হয় । পরিস্থিতি পাল্টে যায়। শেখ হাসিনা যেভাবে বলেন, সেইভাবেই নির্বাচনে যান মরহুম এরশাদ। হাস্যকর হলো আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের অংশীদার হলেও বিরোধী দলের আসনে বসে জাতীয় পার্টি।

২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগ মূহুর্তেও শুরু হয় নতুন নাটক। নির্বাচনের কিছুদিন আগে চিকিৎসার জন্য এরশাদ যখন সিঙ্গাপুর যান, তখন অনেকেই ধারণা করেছিলেন নির্বাচনের আগে হয়তো তিনি ফিরবেন না। জাতীয় পার্টি হয়তো নির্বাচনে অংশ নেবে না। কিন্তু সরকার প্রধানের সঙ্গে সমঝোতা করেই তিনি চিকিৎসা করাতে সিঙ্গাপুরে যান। সিঙ্গাপুরে যাওয়ার আগে এরশাদ ভর্তি হয়েছিলেন সিএমএইচে। নির্বাচন এলেই এরশাদকে সিএমএইচে ভর্তি হতে হয়। কখনো তিনি স্বেচ্ছায় যান, কখনো যেতে বাধ্য করা হয়।
সিএমএইচে থাকা অবস্থায়ই এরশাদ দলের মহাসচিব পদে পরিবর্তন আনেন। রুহুল আমিন হাওলাদারকে সরিয়ে বসান মসিউর রহমানকে। জাতীয় পার্টির মহাসচিব পদে কাউকে সরাতে বা কাউকে নিয়োগ দিতে প্রেসিডিয়াম বা নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের কোনো বৈঠক বা আলোচনার প্রয়োজন হয় না। জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রটি এমনভাবে তৈরি করা যে দলীয় চেয়ারম্যান চাইলে যেকোনো সময় যে কাউকে বাদ দিতে পারেন। যে কাউকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। এভাবে চেয়ারম্যান চাইলে যে কেউ দলের নেতা হতে পারেন। আবার তিনি বাদও দিয়ে থাকেন। ওই নির্বাচনেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৃপায় জাতীয় পার্টি বিরোধী দলের আসনে বসে। এমনকি লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ হন মন্ত্রী পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত।

পাঠকদের নিশ্চয় আরেকটি ঘটনা মনে আছে, ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক সেনা অভ্যুত্থানে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শাহাদাৎ বরণ করেন। তখন চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর ২৪তম পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার স্টাফ (জিওসি) ছিলেন মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর। জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর আত্মগোপনে যাওয়ার পথে পুলিশ আটক করে তাঁকে। একই বছরের ২ জুন মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে হাটহাজারী থানার পুলিশ হেফাজত থেকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।

এ ঘটনায় ১৯৯৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মঞ্জুরের ভাই আইনজীবী আবুল মনসুর আহমেদ চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেন। তাতে অভিযোগ করা হয়, মঞ্জুরকে পুলিশের কাছ থেকে মেজর কাজী এমদাদুল হক সেনা হেফাজতে নেন। পরে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয় তাঁকে। ১৯৯৫ সালের ২৭ জুন এরশাদসহ পাঁচজনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। অভিযোগপত্রে বলা হয়, এরশাদের নির্দেশে আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে মঞ্জুরকে হত্যা করেন এবং লাশ গোপন করার চেষ্টা করেন।

২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসেই আজকের প্রধানমন্ত্রী এরশাদকে বাগে আনতে ওই মামলা পুনরুজ্জীবিত করেন। ২০১৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই মামলা অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। পিপি আসাদুজ্জামান খান অধিকতর তদন্ত চেয়ে আবেদনটি করেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন, ‘মামলার সাক্ষ্য-প্রমাণ ও অভিযোগপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, তদন্তে ত্রুটি রয়েছে। তা ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এখন গণমাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তদন্তকারী কর্মকর্তার তদন্তে অসম্পূর্ণতা থাকায় ন্যায়বিচারের স্বার্থে ঘটনার অধিকতর তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।’

মামলায় এরশাদসহ পাঁচজনের বিচার চলছিল। এরশাদ ছিলেন অভিযোগপত্রভুক্ত প্রধান আসামি। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যার ঘটনা ভিন্ন খাতে নিতে এরশাদের নির্দেশে কিছু সামরিক কর্মকর্তা মঞ্জুরকে পুলিশ হেফাজত থেকে নিয়ে গুলি করে হত্যা করেছেন। এ বিষয়ে এরশাদের বিরুদ্ধে বিমানবাহিনীর তৎকালীন প্রধানসহ সশস্ত্র বাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তা ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ও ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দেন। এরপর এরশাদকে নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিতে যেতে হয়। তার ভেতর ফাসির ভয়ও চলে আসে। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, যখনই এরশাদ উল্টোপাল্টা অবস্থানে যান তখনই এই মামলার তারিখ সামনে আনা হয়। এক পর্যায়ে এ নিয়ে এরশাদ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে তাকে এই মামলা থেকে রেহাই দিতেও দেন দরবার করেন। কিন্তু শেখ হাসিনা তাকে মুখে আশ^স্ত করলেও মামলার বিচার কার্যক্রম চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত মারা যাওয়ার মাধ্যমে এরশাদ এই মামলা থেকে রেহাই পান।

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, এরশাদ মারা যাওয়ার পর জাতীয় পার্টির প্রধান কে হবেন তা নিয়েও দেবর ভাবির মধ্যে শুরু হয় তুমুল দ্বন্দ্ব। জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মী ও এমপিদের বড় অংশই জিএম কাদেরের পক্ষে অবস্থান নিলে রওশদ এরশাদ গিয়ে ধর্না দেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। পরে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে গৃহপালিত এই বিরোধী দলের বিরোধী দলীয় নেতা করা হয় রওশদ এরশাদকে আর পার্টির চেয়ারম্যান করা হয় জিএম কাদেরকে। এতেও সন্তুষ্ট না হলে জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষকও করা হয় রওশন এরশাদ।

এরপর দুইভাগে বিভক্ত হয়ে কোনমতে চলছিল জাতীয় পার্টি। এরমধ্যে অসুস্থ হয়ে রওশন এরশাদ যান ব্যাংককে চিকিৎসার জন্য। এই সময় জাতীয় পার্টির অধিকাংশ এমপি এক হয়ে জিএম কাদেরকে বিরোধী দলীয় নেতা করার প্রস্তাব দিয়ে স্পিকারকে চিঠি দেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সায় না পাওয়ায় বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। এরমধ্যে মশিউর রহমান রাঙাকেও জাতীয় পার্টির মহাসচিবের দায়িত্ব থেকে বহিস্কার করা হয়। এই সময় জিএম কাদেরসহ সংসদের বিরোধী দলের এমপিরা সরকারের বিষোদগার করে বক্তৃতা বিবৃতি দিতে থাকে। বিষয়টি পছন্দ হয়নি শেখ হাসিনার। জিএম কাদেরের ওপর প্রচন্ড ক্ষুব্ধহন প্রধানমন্ত্রী। জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীদের মধ্যে আলোচনা ছিল, এই সময় প্রধানমন্ত্রীর ইশারায় জাপার বহিষ্কৃত নেতা জিয়াউল হক ৩০ অক্টোবর করা এক মামলায় আদালত জাপার চেয়ারম্যান ও সংসদে বিরোধী দলের উপনেতা জি এম কাদেরের ওপর দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। হাইকোর্টও গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে জি এম কাদেরের নিষেধাজ্ঞার আদেশ আগামী ৩ জানুয়ারি ২০২৩ পর্যন্ত স্থগিত করে। জাতীয় পার্টিতে শুরু হয় নতুন নাটক। চরম বেকায়দা পড়েন জিএম কাদের। অবস্থা বেগতিক দেখে রওশদ এরশাদের সঙ্গে আবারও সমঝোতায় আসেন জিএম কাদের।

গত ২৭ নভেম্বর ব্যাংকক থেকে দেশে ফেরেন রওশন এরশাদ। ওই দিন বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের রওশন এরশাদ বলেন, জি এম কাদেরসহ দলের সবার সঙ্গে আলোচনা করে ভুল-বোঝাবুঝির অবসান ঘটানো হবে। ২৯ নভেম্বর রওশন এরশাদের সঙ্গে দেখা করেন জি এম কাদের। দুজন এক টেবিলে বসে নাশতাও করেন। এরমধ্যে উচ্চ আদালতের রায়ে জাপার চেয়ারম্যানের পদও ফিরে পান জিএম কাদের। এরপর গত ১৩ ডিসেম্বব মঙ্গলবার দুইজনে মিলে দেখা করতে যান জাতীয় পার্টির প্রধান উপদেষ্টা শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে। হাসিমুখে তারা গণভবন থেকে বেরিয়েও আসেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং জানায়, প্রধানমন্ত্রী সংসদীয় গণতন্ত্রে গঠনমূলক ও ইতিবাচক ভূমিকা পালনের জন্য জাতীয় পার্টিকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীদের মধ্যে আলোচনা আছে, শেখ হাসিনা শুধু আওয়ামী লীগই নন, জাতীয় পার্টিও চালান।

সর্বশেষ রওশন এরশাদের এক ঘনিষ্ঠ এক বিবৃতি দিয়ে জানায়, রওশন এরশাদ জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। বিকালে এই বিবৃতি দিয়ে অবশ্য রাতেই তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। এরশাদের মৃত্যুর পর ‘গৃহপালিত’ এই বিরোধী দলটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে হাসির খোড়াকে পরিণত হয়েছে।

লেখক : সাংবাদিক।

(এখানে প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্ত নিজস্ব, জাস্ট নিউজ বিডি ডটকম’র সম্পাদকীয় বিভাগের আওতাভুক্ত নয়)