ডান্ডাবেড়ি পায়ে আবার মায়ের জানাজায়: অমানবিকতার পুনরাবৃত্তি কেন

ডান্ডাবেড়ি পায়ে আবার মায়ের জানাজায়: অমানবিকতার পুনরাবৃত্তি কেন

মনজুরুল ইসলাম

গত ২০ ডিসেম্বর প্যারোলে মুক্তি পাওয়া গাজীপুরের কালিয়াকৈরে বিএনপি নেতা আলী আজমকে ডান্ডাবেড়ি পরানো অবস্থায় তাঁর মায়ের জানাজা পড়তে বাধ্য করা হয়েছিল। এ ঘটনার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশের পর ব্যাপক সমালোচনা হয়। ঘটনাটির নিন্দা জানিয়েছিল জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, একাধিক মানবাধিকার সংগঠন ও বিশিষ্ট আইনজীবীরা। কিন্তু এক মাস না পেরোতেই শরীয়তপুরে একই রকম ঘটনা ঘটেছে। এবার ভুক্তভোগী ছাত্রদলের এক কেন্দ্রীয় নেতা।

শরীয়তপুরে সদর উপজেলার আনোয়ার হোসেন মুন্সির ছেলে সেলিম রেজা ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসাধারণ সম্পাদক। গত ৭ ডিসেম্বর বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে পুলিশ তাঁকে আটক করে। এরপর ১০ ডিসেম্বর পল্টন থানার নাশকতার একটি মামলায় সেলিম রেজাকে কারাগারে পাঠানো হয়। তিনি গাজীপুরের কাশিমপুরে কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন। রোববার সকালে সেলিম রেজার মা নাছিমা বেগম গ্রামের বাড়িতে মারা যান। এরপর আইনজীবীর মাধ্যমে সেলিম রেজার প্যারোলে মুক্তির জন্য ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আবেদন করা হয়। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সেলিম রেজাকে বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে ১০ ঘণ্টার জন্য প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়।

রোববার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে মসজিদ মাঠে জানাজায় অংশ নেন তিনি। জানাজা ও দাফনের পুরো সময়ে সেলিম রেজাকে হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে রাখে পুলিশ। এ বিষয়ে শরীয়তপুর সদরের পালং মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আক্তার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার পর কারা কর্তৃপক্ষের থেকে পুলিশের জিম্মায় আসামিকে আনতে হয়েছে। নিরাপত্তার স্বার্থে আসামিকে হাতকড়া পরানো হয়েছিল। গাজীপুর জেলা পুলিশ তাদের জিম্মায় আসামি নিয়ে শরীয়তপুরে আসে। পালং মডেল থানা–পুলিশ তাদের সহায়তা দিয়েছে মাত্র। সেলিম রেজার ভাই শামীম মুন্সি বলেন, ‘একজন সন্তান হিসেবে সে স্বাভাবিকভাবে মায়ের জানাজায় ও দাফনে অংশ নিতে পারেনি। তাঁর হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি খুলে দেওয়ার অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু পুলিশ তা শোনেনি।’ (প্রথম আলো, ১৭ জানুয়ারি ২০২৩)

এর আগে আলী আজমকে যখন ডান্ডাবেড়ি পরানো অবস্থায় জানাজা পড়তে বাধ্য করা হয়েছিল, তখন জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ঘটনাটিকে ‘অমানবিক’ বলে বিবৃতি দিয়েছিল। একাধিক মানবাধিকার সংগঠন ও বিশিষ্ট আইনজীবীরা একে সংবিধান, আইন ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরিপন্থী বলেছিলেন। তাঁদের মতে, আসামি বা অভিযুক্ত, এমনকি দণ্ডপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তির সঙ্গেও এমন আচরণ করার কোনো সুযোগ নেই। এ ঘটনাকে তাঁরা মানবাধিকারেরও চরম লঙ্ঘন বলে চিহ্নিত করেছিলেন। এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি না হলে এমন ঘটনার পুনরুবৃত্তি হতে পারে বলে তখন আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল। সেই আশঙ্কা সত্যি হয়েছে।

শরীয়তপুরের এ ঘটনার পর বেশ কিছু প্রশ্ন সামনে এসেছে। এত নিন্দা–সমালোচনার পরেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেন এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাল? তারা কি সংবিধান, আইন ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনাকে ‘পাত্তা’ দিতে চায় না? লক্ষণীয় হলো, দুটি ঘটনার ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা হলেন বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে যুক্ত। এর মধ্যে প্রথমজন আলী আজম গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বোয়ালী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি। দ্বিতীয়জন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসাধারণ সম্পাদক। এ রকম অমানবিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি করে বিরোধী দলের নেতা–কর্মীদের কি কোনো বার্তা দেওয়া হচ্ছে?

নিরাপত্তাশঙ্কার অজুহাতে আসামি বা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ডান্ডাবেড়ি পরানোর বিষয়টি শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে। মানুষকে নিয়ন্ত্রণ, দমন-পীড়নই ছিল তখনকার শাসকদের উদ্দেশ্য। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সঙ্গে এগুলো কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাই ডান্ডাবেড়ি পরানো অবস্থায় মায়ের জানাজা পড়তে বাধ্য করার ঘটনাটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত এ রকম অমানবিক কর্মকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি না ঘটানো এবং সরকারের উচিত বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করা।

মনজুরুল ইসলাম, প্রথম আলোর জেষ্ঠ্য সহসম্পাদক

এখানে প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্ত নিজস্ব, জাস্ট নিউজের সম্পাদকীয় বিভাগের আওতাভুক্ত নয়।