বিএনপি হঠাৎ আন্দোলন-কর্মসূচিতে পিছিয়ে কেন

বিএনপি হঠাৎ আন্দোলন-কর্মসূচিতে পিছিয়ে কেন

মাহমুদ আজহার

অনেকেই বলছেন, বিএনপি আন্দোলন করতে গিয়ে এক পা এগিয়ে চার পা পিছিয়ে পড়ছে। আবার কেউ কেউ মস্করা করে এও বলছেন, ঈদের পর বিএনপির আন্দোলন। কোন ঈদের পর তা স্পষ্ট নয়। বাংলাদেশের ‘সুশীল’ লেখক বুদ্ধিজীবীরাও এখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সুর মিলিয়ে এমন মন্তব্য করছেন। কিন্তু কেন? আমি মনে করি, এটাও রাজনীতিতে একটা কৌশলমাত্র। এমনকি ঐতিহাসিক যুদ্ধক্ষেত্রেও এমন কৌশল নেওয়ার নজির আছে। রাজতৈকি আন্দোলন বা কর্মসূচি সব সময় শতভাগ গতিবেগে চলবে, তাও ঠিক নয়। কখনোও দুই পা এগুতে হয়, আবার কখনো এক পা পেছাতে হয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হয়। সময় মতো দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে হয়। তবেই আন্দোলনে সফলতা আসে।

আসলে যারা রাজনীতি করেন বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশে বিরোধী দলের রাজনীতি করছেন, তারাই বুঝতে পারছেন এমন একটা ‘ফ্যাসিস্ট’, ‘একনায়কতান্ত্রিক’ ‘স্বৈরাচার’ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াটা কতটা কঠিন। বিএনপির মতো দেশের সবচেয়ে এখন জনপ্রিয় দলের প্রধান বেগম খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে প্রায় ৩৭ লাখের মতো মামলার খড়গ ঝুলছে। সর্বশেষ দুই মাসে গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ২৬ হাজার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। ১৬ জন নেতা-কর্মী পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন। কয়েকশ নেতা-কর্মী আহত। কেউ কেউ পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। এর আগেও প্রায় ১০ হাজার নেতা-কর্মী কারাগারে। তাদের পরিবারের পাশে শুধু বিএনপির সতীর্থ স্বজনেরাই। একজন শাহাদাত বরণ করেও তার পরিবার শান্তিতে নেই। বার বার পুলিশের হানা, ধরপাকড় আর আওয়ামী লীগের রক্তচক্ষুর আনাগোনা তো আছেই। নিশ্চয়ই সুশীল লেখক বুদ্ধিজীবীরা তাদের পাশে দাঁড়ান না। আর বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের জন্য এক আইন আর বিরোধী দল মতের জন্য ভিন্ন আইন। এটা নামধারী ‘সুশীল’ লেখকসহ সবারই জানার কথা। তারা হয়তো বেমালুম ভুলে গেছেন, ২০১৪ সালে ভোটের আগে ও পরে কিংবা ২০১৮ সালে ভোটের আগে যে বাংলাদেশে যে ধরনের আন্দোলন হয়েছে, অতীতে তা কখনও হয়নি। তখন সুশীল নামধারী কলামিস্টরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলেছিলেন, বিএনপি একটি সন্ত্রাসী দল। তারা জ¦ালাও পোড়াও রাজনীতি করছে। অর্থ্যাৎ বিএনপি সহিংস আন্দোলন করলেও সমস্যা, না করলেও সমস্যা। আবার গণতান্ত্রিকভাবে সভা সমাবেশ করলেও বলা হয়, এসব ‘গান্ধীজী’ মার্কা কর্মসূচি দিয়ে সরকারকে হটানো যাবে না। তাদের ভাষায়, বিএনপি বসে থাকলেও সমস্যা, দাড়ালেও সমস্যা। সব সমস্যার মূল সমস্যা বিএনপি।

পাঠকরা নিশ্চয়ই জানেন, বাংলাদেশে একটি মামলায় পড়লে কত ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়। আর সেটি যদি হয় রাজনৈতিক, তাহলে তো আর কথাই নেই। বিএনপি আন্দোলন করবে কখন, ঘুম থেকে উঠেই মামলার হাজিরা, সকালে নিন্ম আদালত, দুপুরে হাইকোর্ট-বিকালে সুপ্রীম কোর্ট। আদালতের বারান্দায় ঘুরতে ঘুরতে দিন কাটে বিএনপি নেতা-কর্মীদের। আর একেকটি মামলায় মামলায় জামিন পেতে হাজারও বাধার দেয়ার দিয়ে রাখে সরকার। তাছাড়া বাংলাদেশের নিন্ম আদালতে যাওয়া আসা মানে জাহান্নামের প্রতিচ্ছবি। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের যে সেখানে কত ধরনের ভোগান্তিতে পড়তে হয়, সেটা সুশীল লেখক বুদ্ধিজীবীরা বুঝতে পারবে না।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কথাই ধরা যাক। গত ৭ ডিসেম্বর রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দলটির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে দলটির একজন কর্মী নিহত, বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী আহত হন। পুলিশ কেন্দ্রীয় কার্যালয় ভাংচুর করে নজীরবিহীন তান্ডব চালিয়ে রিজভী আহমেদসহ সাড়ে ৪শ নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। এরপর ৮ ডিসেম্বর দিবাগত রাত সোয়া তিনটায় পুলিশ বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে বাসা থেকে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আসে। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, সমাবেশের স্থান নিয়ে আলোচনা করতেই তাকে এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু সেখানে আসলেই কি আলোচনা হয়েছে, তা সর্ব সাধারণের অজানা। পরের দিন বিকেলে তাঁকে গ্রেফতারের কথা জানায় ডিবি পুলিশ। আদালতে হাজির করলে তাঁর জামিন নামঞ্জুর করে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। নিন্ম আদালতে দফায় দফায় তার জামিন নাকচ করে দেওয়া হয়।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের রাজনৈতিক আদর্শকে সমর্থন না করেও এটি স্বীকার করেন যে, মির্জ্যা আলমগীর একজন সজ্জন ব্যক্তি। ক্লিন ইমেজের রাজনীতিবিদ হিসেবেই সর্বমহলে পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত দুর্নীতি বা ওই ধরনের কোনো অভিযোগ ওঠেনি। তিনি কখনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন, এ রকম কিছুর প্রমাণও মেলেনি। এরপরও মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে গত কয়েক বছরে একের পর এক মামলা হয়েছে। গত ১০ বছরে তাঁর বিরুদ্ধে অন্তত ৯২টি মামলা হয়েছে এবং ৩৫০ দিনের মতো জেল খেটেছেন তিনি। এর মধ্যে ‘গায়েবি’ মামলা অর্থাৎ অস্তিত্বহীন ঘটনাতেও মামলা হয়েছে। মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে মামলা, তাঁকে মন চাইলেই যখন তখন গ্রেফতার এবং বারবার জামিন নামঞ্জুর হওয়ার বিষয়টিকে সরলভাবে দেখার সুযোগ আছে?

শুধু মির্জা ফখরুলই নন, বিএনপির বেশির ভাগ নেতা-কর্মীরই একই অবস্থা। রিজভী আহমেদের মতো ব্যক্তি মাসের পর মাস ধরে জেলে। তার অপরাধ, সরকারের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়া। তার বিরুদ্ধেও শতাধিক মামলার খড়গ ঝুলছে। শুধু কি তাই? বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, স্থায়ী কমিটির সদস্য থেকে তৃণমূলের কর্মী পর্যন্ত এখন বিভিন্ন রাজনৈতিক মামলার আসামী। যেখানে কারও বিরুদ্ধে একটি মামলা হলে টেনশনে ঘুম হারাম হয়ে যায়, সেখানে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে শত শত মামলার খড়গ। এটা সরকারের এক ধরনের অপকৌশল। বিএনপি নেতা-কর্মীরা আন্দোলন করবে কখন? দিন যায় আদালতের বারান্দায় দৌড়াতে দৌড়াতে। তারপরও যদি ন্যায় বিচার পাওয়া যেত? সেখানেও সরকার নগ্নভাবে হস্তক্ষেপ করে।

নইলে বেগম খালেদা জিয়ার মতো সাবেক তিন বারের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা, ৭৬ ঊর্ধ্ব বয়স্ক একজন নারীÑবাংলাদেশের গণতন্ত্রের লড়াইয়ে যার ভূমিকা শীর্ষে তাকে মাত্র ২ কোটি টাকার এক মামলায় বছরের পর বছর ধরে কারাভোগ করতে হচ্ছে। অথচ গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, এক ছাত্রলীগ নেতা অবৈধভাবে দুই হাজার কোটি টাকার সম্পদ বানিয়েছেন। তাদের কোনো সাজা নেই। ব্যাংকগুলো ফোকলা করে ফেলছে সরকার সমর্থক ব্যবসায়ীরা। বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করছে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। কানাডা, আমেরিকা, লন্ডন, দুবাইসহ বিশ্বের বড় বড় শহরে সরকার সমর্থক আমলা, রাজনীতিবিদ বা পেশাজীবীরা বেগম পাড়া বানিয়েছেন। তাদের ধরার কোনো উদ্যোগ নেই। তারা দিব্বি ঘুরে বেড়াচ্ছেন সরকারের ছায়ায়।

এমন একটি অবস্থায় বিএনপিকে আন্দোলন কর্মসূচি দিতে হয় নানা দিক বিবেচনায়। আমি মনে করি, সঠিক পথেই আছে বিএনপি। দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকেই বিএনপিকে সামনে পথ চলতে হবে। সরকার বা কারো হঠকারি উস্কানিতে বিএনপির পা ফেলা ঠিক হবে না। নেতা-কর্মী ও দেশের জনগণই হোক বিএনপির ভরসার ঠিকানা। তাদের সিদ্ধান্তেই নির্ধারিত হোক পরবর্তী কর্মসূচি।

লেখক: সাংবাদিক।

এখানে প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্ত নিজস্ব, জাস্ট নিউজের সম্পাদকীয় বিভাগের আওতাভুক্ত নয়।