সিনেমায় হতে না পারলেও রাজনীতিতে এখন নায়ক ‘হিরো আলম’

সিনেমায় হতে না পারলেও রাজনীতিতে এখন নায়ক  ‘হিরো আলম’

মাহমুদ আজহার


বগুড়ার অলিগলির এক ডিস ব্যবসায়ী ঢাকায় এসেছিলেন সিনেমার নায়ক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। এ নিয়ে তিনি বিভিন্নজনের কাছে গিয়ে তার স্বপ্নের কথাও বলেছিলেন। বিনিময়ে মারধরের শিকার হয়েছেন। লাঞ্চিত, অপমানিত হয়েছেন। কিন্তু হাল ছাড়েননি। তার নাম আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম। বাংলাদেশের রাজনীতি এখন তুঙ্গে হিরো আলম। ভারতের শাহরুখ খানের আলোচিত সিনেমা যেমন বিশ^ব্যাপী সমাদৃত হয়েছে ঠিক তেমনই বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন হিরো আলম যুগ চলছে। আমাদের তথাকথিত ভদ্র সমাজেও এখন আলোচনার বিষয় ‘হিরো আলম’।

দেশে যখন ভোটের মাঠে বিরোধী প্রতিপক্ষ থাকে না, ভোটবিহীন নির্বাচনের মহোৎসব চলে, তখন হিরো আলমরাই জনগণের আস্থার ঠিকানা। এটা মূলত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে ‘না’ সূচক প্রতিবাদেরই অংশ। কিন্তু অতি চালাকি সরকারের কি সেই মান-অপমান আছে? বগুড়া-৪ আসনে সরকারি দলের প্রার্থীকে যেভাবে নাস্তানাবোদ করা হলো, তারপরও ওবায়দুল কাদেররা কিভাবে ‘হিরো আলম’কে ‘জিরো আলম’ বলে, বিষয়টি সত্যিই লজ্জার। অবশ্য ক্ষমতার মসদনে বসে তারা সত্যিই বধির, বোবা বা অন্ধ হয়ে গেছে। কালো সানগ্লাস যেদিন চোখ থেকে সরানো হবে, তখন বোঝা যাবে কত ধানে কত চাল।

সম্প্রতি বিএনপির ছেড়ে দেওয়া ৬ আসনের উপ-নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হয়। সেখানে ঘুরেফিরে সরকারি দল ও তাদের মহাজোট বিশেষ করে গৃহপালিত বিরোধী দল জাতীয়পার্টি ও অন্য শরিকরা ভোটে অংশ নেয়। ৬টি আসনের উপ-নির্বাচনের মধ্যে সবার চোখ ছিল বগুড়া-৪ আসনের দিকে। সেখানে সরকারি দল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের প্রার্থী ছিলেন, এ কে এম রেজাউল করিম তানসেন। একতারা প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন হিরো আলম। ভোটের দিন দুপুর গড়াতেই হিরো আলমের বিজয়ের খবর আসছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হিরো আলমকে এমপি হিসেবে অনেকেই আগাম শুভেচ্ছাও জানাচ্ছিলেন অনেকেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঘোষণা এল, বগুড়া-৪ আসনে মহাজোটের প্রার্থী এ কে এম রেজাউল করিম তানসেনের কাছে ৮৩৪ ভোটের ব্যবধানে হেরে যান হিরো আলম। তবে বগুড়ার কয়েকজনের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আলাপকালে তারাও জানান, বিজয়ী হয়েছিলেন হিরো আলমই। কিন্তু সরকারের ইজ্জত পাংচার হয়ে যাবে, এই কারণেই হিরো আলমকে হারানো হয়েছে।

ফলাফল ঘোষণার পর হিরো আলমও অভিযোগ করলেন, ‘বগুড়া-৪ আসনে ভোট সুষ্ঠু হয়েছে। তবে ফলাফলে এসে গন্ডগোল করেছে। নির্বাচন কমিশন আমার বিজয় ছিনতাই করে মশালের প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করেছে।’ ভোটে পরাজিত প্রার্থী নানা অভিযোগ করেন। এটা নতুন নয়। কিন্তু হিরো আলমের যে অভিযোগটি সবকিছু ছাপিয়ে গেছে তা হলো, ‘শিক্ষিত সমাজের কিছু লোক আছেন, যাঁরা আমাকে মেনে নিতে চান না। তাঁরা মনে করেন, আমি পাস করলে বাংলাদেশের সম্মান যাবে, তাঁদের সম্মান যাবে। আমরা এত শিক্ষিত, হিরো আলমের মতো মূর্খকে ‘স্যার’ বলে ডাকতে হবে। এ জন্য তাঁরা আমাকে মানতে চান না।’

এই সময়ে তথাকথিক কিছু ‘এলিট’ বা দলকানা মুষ্ঠিমেয় কিছু আওয়ামী ঘরানার কিছু লোকজন ঘুরিয়ে পেচিয়ে হিরো আলমের বিরুদ্ধ আচরণ করছেন। গত শনিবার এক অনুষ্ঠানে খোদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ্যেই বলে দিলেন, হিরো আলম ‘জিরো’ হয়ে গেছে। সত্যিই কি তাই? হিরো আলম সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছেন, ‘বুকের পাটা থাকলে গণভোট দিয়ে দেখেন। জনগণ সব বাটপারি প্রমাণ করে দেবে।’ কিন্তু ওবায়দুল কাদের সাহেবরা কি সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবে। সেই সৎসাহস বোধহয় তাদের নেই।

ছয়টি আসনে ভোটের পর কোনো এক বিষয়ে বাংলাদেশে আওয়ামী সমর্থিত এক উচ্চ শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে কথা বলছিলাম। কথা প্রসঙ্গে বগুড়া-৪ আসনের উপ-নির্বাচনে হিরো আলমের তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়টি তাকে আমি বললাম। এই ওই শিক্ষিত ভদ্রলোক একটু রুঢ়কণ্ঠেই বললেন, ‘এ নিয়ে কথা বলো না তো। তাকে নিয়ে কথা বলতেও আমার রুচিতে বাধে। দেশের কি এতটাই অধপতন হয়েছে, যে একজন রাস্তার ছেলে মেম্বার অব পার্লামেন্ট হবে?’ মুখের উপর তার এই প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারিনি। তবে আমার তখন বলতে ইচ্ছে করছিল, রাস্তাঘাট, টিআর কাবিখা, মসজিদ মন্দিরের টাকা মেরে খাওয়ার খাওয়ার খবরের শিরোনাম হয়েছে অনেক এমপি। তাদের প্রায় সবাই উচ্চ শিক্ষিত। টিআইবির রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশ দুর্নীতির শীর্ষে। এই দুর্নীতি কিন্তু হিরো আলমরা করেন না, এই তথাকথিত উচ্চ শিক্ষিত ও এলিটরাই কিন্তু করেন। বিদেশে টাকা পাচার, বেগমপাড়া, লুটপাটের খবরের শিরোনাম কিন্তু তথাকথিত শিক্ষিত রাজনীতিবিদ, আমলা বা পেশাজীবীরাই। যা হোক ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা না বাড়িয়ে ফোন রেখে দিলাম।

‘এমপি প্রার্থী’ হিরো আলমের কথাবার্তায় বেশ পরিপক্কতা এসেছে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। আমার কাছে খুবই ভালো লেগেছে, হিরো আলমকে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, একজন মেম্বার অব পার্লামেন্ট হওয়ার জন্য যে যোগ্যতা থাকা দরকার সেটা আপনার আছে কি না? জবাবে হিরো আলম বলেছিলেন, এই প্রশ্ন কি আপনি কখনও মমতাজকে করেছিলেন কিংবা ক্রিকেটার মাশরাফিকে করেছিলেন? তখন নিশ্চুপ ছিলেন ওই সাংবাদিক। ভোটের আগে ও পরে গণমাধ্যমে তার বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে, তথাকথিত এলিটরাও এধরনের স্পষ্ট কথা সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারবে না। ভোটের আগে আরেক সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেন, তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি কি কি? এরও তিনি সুন্দরভাবে জবাব দিয়েছেন। হিরো আলম বলেন, ‘এমপি হলে হাতে সময় মাত্র সাত মাস। এই অল্প সময়ে লম্বা প্রতিশ্রুতি দেওয়া মানে ধোকা দেওয়া। তবে আমি মানুষের জনগুরুত্বপূর্ণ এমন কিছু কাজ করতে চাই, যা সাত বছরেও কেউ করতে পারবে না।’

হিরো আলমকে নিয়ে সমাজের কিছু ওপরতলার মানুষের হাসি মশকরা ও তুচ্ছ, তাচ্ছিল্যের শেষ নেই। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেন, এই চেহারা নিয়ে সে কীভাবে নায়ক হয়? এই বেসুরে কণ্ঠ নিয়ে কীভাবে গান গায়? তাঁর রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার ডিভিও ভাইরাল হওয়ার পর শহুরে কিছু শিক্ষিত এলিটের মধ্যে নিন্দার ঝড় উঠে। এরপর তাঁকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা কার্যালয়ে পুলিশ ডেকে নিয়ে যান। সেখানে তাঁর চেহারা ও বেশভূষা নিয়ে অপমান করা হয়, রবীন্দ্র-নজরুলসংগীত গাওয়ার জন্য শাসানো হয় এবং আর গান না গাওয়ার ও সিনেমায় পুলিশের পোশাক না পরার মুচলেকা নেওয়া হয়। কার্যত, ঘাটে ঘাটে মান অপমান সহ্য করে নিজেকে ঠিকই লক্ষ্যে পৌছাতে সক্ষম হয়েছেন। এখন হিরো আলম কথা বললেই মূলধারার গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়। শুধু বাংলাদেশী নয়, বিবিসি, আল জাজিরাসহ ভারতীয় সব গণমাধ্যমেই হিরো আলম খবরের শিরোমান হয়েছেন। এটাই বা কম কিসের? অনেকেই এখন বলছেন, হিরো আলম সিনেমার নায়ক হতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু রাজনীতিতে নায়ক ঠিকই হয়েছেন।

হিরো আলমের সরলতা আর সাহসকে কেউ কেউ তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন কিংবা ঔদ্ধত্যও ভাবেন। তিন বছর আগে হিরো আলম তথাকথিত শিক্ষিত বা এলিট শ্রেণীকে দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর আহ্বান জানিয়ে একটি বই লিখেছিলেন। বইয়ে তিনি উল্লেখ করেন, ‘সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত লোক হইল ভীতু। নিজেরা তো কিছু করবেই না, কাউকে করতে দেখলেও গা জ্বলে।’ তিনি আরও লেখেন, ‘আমি সকল বিধবা মা, পরিত্যক্ত নারী ও শিশুদের জন্য সংস্থা করে যেতে চাই, যাতে আমার মায়ের মতো কারও মায়ের যেন মাইর খেয়ে রাস্তায় বাচ্চা নিয়ে রাত কাটানো না লাগে!’ তার এই বক্তব্যের সঙ্গে আমি শতভাগ একমত। তার চিন্তা চেতনাকেও আমি স্যালুট জানাই।

লেখক : সাংবাদিক।

(এখানে প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্ত নিজস্ব, জাস্ট নিউজের সম্পাদকীয় বিভাগের আওতাভুক্ত নয়।)