নতুন রাজনীতির শুরু? উত্তর খালেদা জিয়ার কাছে

নতুন রাজনীতির শুরু? উত্তর খালেদা জিয়ার কাছে

আগস্টের ৮ তারিখে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হর্ষবর্ধন শ্রিংলা দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতি দিয়েছেন। প্রথমত, তিনি জানিয়েছেন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ পরামর্শক কমিশনের বৈঠকে অংশ নিতে বাংলাদেশ সফর করবেন।

দ্বিতীয়ত, তিনি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধারণের ব্যাপারে ভারতের আগ্রহের কথা বলেছেন। বাংলাদেশের গণমাধ্যমে তাঁকে উদ্ধৃত করা হয়েছে, আমরা সবাই গণতান্ত্রিক দেশ, আমরা সবাই অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে বিশ্বাস করি।

তিনি এমন এক সময় এই মন্তব্য করলেন, যখন বাংলাদেশে এই সন্দেহ দানা বেঁধে উঠছে যে শেখ হাসিনা বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনে টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছেন। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের স্থিতিশীল সম্পর্ক তৈরি হয়। এর জন্য শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ দিতে হয়, কারণ তিনি বাংলাদেশের রাজনীতি সহযোগিতামূলক প্রবৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করেছেন। এটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে শান্তি বজায় রাখা এবং তার প্রবৃদ্ধির দিকে নজর দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের সহায়ক হয়েছে। অনেকের ধারণা, ২০১৪ সালে তিনি ভারতের সহায়তা নিয়ে ক্ষমতায় আসেন।

অভিযোগগুলো অতিরঞ্জিত। ২০১৪ সালে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচন বর্জনের সেই পুরোনো ও পরীক্ষিত পথে ফিরে যায়। এর মধ্যে হাসিনা নতুন আইন করেন, যার বলে সংসদ ভেঙে না দিয়েই সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারবে। কম করে বললেও বলতে হয়, ব্যাপারটা বিতর্কিত। বিএনপি এর বিরোধিতা করে ঠিক কাজটি করেছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তারা জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আছে, যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে সহিংস আন্দোলন শুরু করেছিল।

ট্রাইব্যুনাল যখন জামায়াত ও বিএনপির মন্ত্রী, সাংসদসহ বিভিন্নজনের বিরুদ্ধে রায় দেন, তখন ২০১৩ সালে বছরজুড়ে সহিংসতায় বাংলাদেশ কেঁপে ওঠে। এতে প্রায় ২০০ মানুষ প্রাণ হারায়। সরকারের সমর্থক সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হয়। বিএনপি ভেবেছিল, আওয়ামী লীগের নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টা বানচাল করতে এটুকুই যথেষ্ট। কিন্তু এই কৌশলের উল্টো ফল হয়।

হাসিনা কয়েকটি সাইনবোর্ড-সর্বস্ব দল ও উদারপন্থীদের সমর্থন নিয়ে নির্বাচন করেন। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪০টি দলের মধ্যে ১২টি দল এই নির্বাচনে অংশ নেয়। আওয়ামী লীগ ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়। ভারত সন্ত্রাস ও আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার যুক্তিগ্রাহ্য বিকল্প হিসেবে আওয়ামী লীগের বিজয়কে স্বীকৃতি দেয়। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তি ভারতের পদাঙ্ক অনুসরণ করে।

ভারত বাংলাদেশকে ৮০০ কোটি ডলারের লাইন অব ক্রেডিট দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে এবং বিনিময়ে ঢাকা যোগাযোগ উন্নতকরণ, ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি ও বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা করেছে—এতে সম্পর্কের উন্নয়ন হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের মাঠ বাস্তবতায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। ২০১০ সালে ভারতই প্রথম দেশ হিসেবে পদ্মা সেতুর প্রস্তুতি কাজের জন্য ১০০ কোটি ডলার সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাব দেয়, যার মধ্যে ২০ কোটি ডলার ছিল অনুদান (এইড)। ওই সময় বহুজাতিক সংস্থাগুলো স্বচ্ছতার অভাবের অভিযোগ তুলে এই প্রকল্প থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিচ্ছিল। চীন যে ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের প্রস্তাব দিয়েছে, তার কাছে ভারতের ১০০ কোটি ডলার তো নস্যি।

তবে রাজনৈতিক পরিসরের পরিবর্তন অতটা আশাব্যঞ্জক নয়। জামায়াতের পিঠ ভেঙে গেছে। দলটির অনেক নেতার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে, অনেকে পলাতক। দলটির সম্পদও সরকারের হাতে চলে যাচ্ছে, ফলে দলটি আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের মধ্য দিয়ে নতুন ইসলামি শক্তির আবির্ভাব ঘটেছে। এরা প্রায় ১৪ হাজার অনিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসা পরিচালনা করে, সম্ভবত তারা জামায়াতে ইসলামীর চেয়েও বেশি রক্ষণশীল। তারা মুক্তবাকের স্বাধীনতা থেকে নারীর ক্ষমতায়ন পর্যন্ত বাংলাদেশের সমাজের সব উদারনৈতিক উপাদান মুছে ফেলতে চায়।

দেখা গেল, ধর্মনিরপেক্ষ ও উদার রাজনীতির প্রতিনিধি আওয়ামী লীগ তাদের সঙ্গে আপস করেছে। ২০১৬ সালের শেষ নাগাদ পাঠ্যপুস্তকে কট্টর ইসলামপন্থীদের রুচি অনুযায়ী পরিবর্তন আনার মধ্য দিয়ে ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো। এ বছরের শুরুর দিকে সরকার কওমি মাদ্রাসাকে স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশের উদারপন্থীরা মনে করেন, এতে সরকারি চাকরি ও উচ্চতর শিক্ষায় তাদের প্রবেশের বাধা কমে যাবে।

জনপ্রিয়তা হ্রাসের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীন দল মনে করে, এর মধ্য দিয়ে মৌলবাদীদের ভোটব্যাংক বিভক্ত করে তারা বিজয় নিশ্চিত করবে। কিন্তু দেশের আমজনতা মনে করে, এতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যকার পার্থক্য কমে গেছে। আওয়ামী লীগের ভেতরের লোকজন মনে করেন, দ্বিদলীয় নির্বাচন হলে তার পক্ষে জেতা কঠিন হবে। যদিও বিএনপি এখন এলোমেলো, বেগম খালেদা জিয়াসহ তার শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা আছে, তবু দলটির সমর্থক গোষ্ঠী আছে। নির্বাচনে তারা ভালো ফল করতে পারে।

এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক কুশীলবদের জন্য নানা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। চিরসুবিধাবাদী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ দেশের ইসলামি ভোট বিভক্ত করার চেষ্টা করছেন। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, তিনি শেখ হাসিনার প্রক্সি বিরোধী দল হওয়ার চেষ্টা করছেন, যেটা ২০১৪ সালে তিনি করেছিলেন। সাবেক সেনাপ্রধান এরশাদ এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দূত, যেখানে তাঁর স্ত্রী রওশন এরশাদ জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে বিরোধীদলীয় নেতা। এরশাদ গত মাসে ভারতে গিয়েছিলেন।

জানা যায়, তিনি হেফাজতের সঙ্গে জোট গড়ে তোলার জন্য আলোচনা করছেন। আশা করা হচ্ছে, হেফাজত ২০১৮ সালে নির্বাচনী রাজনীতিতে নামবে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। তবে এরশাদের সঙ্গে তারা জোট করবে কি না, তা স্পষ্ট ন্য়। আর এরশাদের রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা নেই বললেই চলে।

এখন বড় প্রশ্ন হচ্ছে খালেদা জিয়া কী করবেন? তাঁর জনপ্রিয়তা আছে এবং আগামী নির্বাচনে তিনি অংশ নিতে চান। কিন্তু নির্বাচনের আগে তাঁকে জেলে পোরা হলে বা গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি দেশ ছাড়লে কী হবে? যেমন তাঁর ছেলে করেছেন। বেগম খালেদা জিয়া থাকলে বিএনপি কেমন করবে আর না থাকলে কেমন করবে?

বাংলাদেশে এখন নানা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে খালেদা জিয়া মৌলবাদের রক্ষক হিসেবে পরিচিত, এটাই বড় উদ্বেগের কারণ। তারা কি ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ে তাঁকে সমর্থন দেওয়ার ঝুঁকি নেবে, নাকি খালেদা রাজনৈতিক গতিধারা বদলাবেন?

তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হলো ২০১৪ সালের পর থেকে বিএনপি প্রথাগত ভারতবিরোধিতা আর করছে না। তারা কি শুধু রাডারের নজর এড়াতে নিচ দিয়ে বিমান চালাচ্ছে, নাকি এটা বাংলাদেশে রাজনীতির নতুন শুরু? এই উত্তর হয়তো খালেদা জিয়ার কাছে আছে, যিনি এখন লন্ডন সফর করছেন।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
প্রতিম রঞ্জন বসু: ভারতীয় সাংবাদিক।

সৌজন্যে : প্রথম আলো ও দ্য হিন্দু বিজনেস লাইন