‘খালেদা জিয়া’ই বাংলাদেশ’, তাকে বাঁচাতে হবে...

‘খালেদা জিয়া’ই বাংলাদেশ’, তাকে বাঁচাতে হবে...

এম মাহাবুবুর রহমান


আমাদের এলাকায় নির্বাচনী প্রচারণায় বিএনপি দলীয় প্রার্থী ও সাবেক এমপি নূরুল ইসলাম মনি সবসময় বলতেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দেশে গণতন্ত্র থাকবে না। ইসলাম ধর্ম চর্চা সংকুচিত হবে। সার্বভৌমত্ব লুন্ঠিত হবে। নির্বাচনী প্রচারণায় এই তিনটি ইস্যুকে তিনি ব্যাপকভাবে সামনে আনতেন।

এরপর যখন বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কর্মকান্ড ও নির্বাচনী প্রচারণা অবলোকনের জ্ঞান হলো আমার, তখন থেকে তাঁর প্রতিটি ভাষণে আমি এই তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দিতে দেখেছি। ২০০৮ সালে বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল উপলক্ষে বেগম খালেদা জিয়ার নির্বাচিত ভাষণের একটি সংকলন প্রকাশ করা হয়েছিল। গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ নির্বাচন করতে গিয়ে তাঁর রাজনীতির শুরু থেকে সবগুলো বক্তৃতা বিভিন্ন সংকলন এবং পুরোনো পত্রিকা থেকে পড়তে হয়েছিল আমাকে। ‘বিএনপির রাজনীতির ৩১ বছর’ শিরোনামে আরেকটি ইতিহাসগ্রন্থ লিখতে গিয়ে বিএনপির রাজনীতির পুরো গতিপথকে বিশ্লেষণ করতে হয়েছিল। এতে আমি এতোটুকু নিশ্চিত হয়েছি যে, ‘গণতন্ত্র’, ‘নিজ নিজ ধর্ম চর্চার অবাধ সুযোগ’ এবং ‘দেশের সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রাখার প্রত্যয়’ এই তিনটিই অন্য রাজনৈতিক দলগুলো থেকে বিএনপির রাজনীতির প্রধান ব্যতিক্রম। বিএনপির রাজনীতির মূল ভিত্তি ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ও এই তিনটি প্রত্যয়ের মধ্যে সুপ্ত রয়েছে। আর এই প্রত্যয়গুলোর মাধ্যমেই আপনি বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে পার্থক্য করতে পারবেন। একটি স্বাধীন সার্বভৌম আধুনিক উন্নত রাষ্ট্রের টিকে থাকার পেছনেও এগুলোই সর্বাগ্রে বিবেচিত। প্রকৃতপক্ষেই জিয়াউর রহমানের বিএনপির সাথে যদি আওয়ামী লীগের ভিন্নতা লক্ষ্য করতে চান, তাহলে এই তিনটিই প্রধান পার্থক্য আপনি খুঁজে পাবেন।

ঠিক আমাদের প্রজন্ম যখন মধ্য বয়স পার করছি, তখন আওয়ামী লীগের দীর্ঘকালীন ক্ষমতাভোগে বিএনপি-আওয়ামী লীগের পার্থক্যটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার মধ্যে ফারাকটা আমরা অনুধাবন করছি। আর বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র উল্লেখিত তিনটি প্রত্যয়ের অনুপস্থিতি কিংবা রুগ্নতা বোধ করছে। নতুন প্রজন্মের সাম্প্রতিক দু’টো ঐতিহাসিক আন্দোলন প্রমাণ করছে, চলমান জীর্ণতায় তারা উদ্বিগ্ন। নিরাপদ সড়ক কিংবা চাকুরিতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের আন্দোলনের মাধ্যমে তারা মূলত: ‘নিরাপদ বাংলাদেশ’ গড়ার বার্তাই দিয়েছেন।

বর্তমান পরিস্থিতিতে নিরাপদ বাংলাদেশ গড়তে দরকার একটি দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব। একটি যোগ্য ও দেশপ্রেমিক নেতৃত্বের হাতে দেশকে তুলে দিতে পারলে নতুন প্রজন্মের এই প্রত্যাশার প্রতিফলন হতে পারে। সত্যিকার অর্থে, বর্তমান সময়ে যোগ্য এবং দেশপ্রেমিক নেতৃত্বের শূণ্যতা রয়েছে প্রিয় বাংলাদেশে। কেননা ফখরুদ্দিন আহমদের মতো শিক্ষিত (বিদেশীদের পুতুল), শেখ হাসিনার মতো দৃঢ় (গণতন্ত্র বিরোধী ও প্রতিবেশী প্রেমিক) কিংবা বিগত বিএনপি জোট সরকারের মতো অগোছালো (সমন্বয়হীন) নেতৃত্বের দ্বারা নতুন প্রজন্মের প্রত্যাশিত ‘নিরাপদ বাংলাদেশ’ গড়া সম্ভব নয়।

তাহলে কী আমরা ‘নিরাপদ বাংলাদেশ’ কখনো পাবো না? নিশ্চয়ই একটি নিরাপদ বাংলাদেশ আমাদের গড়তে হবে। এজন্য চলমান কলুষিত রাজনীতির অবসান হতে হবে। আর এর জন্য আরো অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে আমাদের। এখন আমাদের প্রধান কাজ হতে হবে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখা। যাতে কোনোভাবে অকার্যকর রাষ্ট্রের তকমা আমাদের গায়ে না লাগে কিংবা বাংলাদেশ যাতে সার্বভৌমত্বহীন হয়ে না পড়ে, সেজন্য আমাদের লড়াই করতে হবে। আর এই লড়াইয়ের দীর্ঘকালীন সেনাপতি হলেন বেগম খালেদা জিয়া। তাকে আপনি যে দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখেন, বাস্তবতা হলো বাংলাদেশ রাষ্ট্রে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য গত ৩৫ বছর ধরে তিনি যে লড়াই করেছেন, পৃথিবীতে এমন দৃষ্টান্ত বিরল। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে তিনি সর্বদাই আপসহীন থেকেছেন। ক্ষমতার চেয়ে গণতন্ত্র ও দেশের সার্বভৌমত্ব তাঁর কাছে অগ্রগন্য। ১৯৯৬ সালে একটি নির্বাচন সম্পন্নের পর মাত্র কিছুদিনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার পর ক্ষমতা ছেড়ে দেয়া, কিংবা ২০০৮ সালের আপসের মাধ্যমে ক্ষমতায় না যাওয়ার দৃঢ়তা দেখানো কেবল তাঁর পক্ষেই সম্ভব। ২০১২ সালের ভারত সফরে নিজের দেশের স্বার্থের প্রশ্নে অটল থাকা এবং এর ফলশ্রুতিতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের প্রেক্ষিত আমাদের সবার জানা। এতোকিছুর পরও একজন দেশপ্রেমিক খালেদা জিয়া কোথাও দেশের প্রশ্নে আপস করেননি।
আর এজন্যই চলমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ কিংবা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের রুগ্নতা কাটাতে বেগম খালেদা জিয়াকে দরকার। তাঁর কোনো বিকল্প আমাদের কাছে নেই। তাঁর চেয়ে শিক্ষিত, দক্ষ কিংবা গতিশীল নেতৃত্ব আমাদের সামনে অনেকে আছেন, কিন্তু একইসঙ্গে দেশপ্রেমিক, বিপুল জনপ্রিয় এবং গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্বের পাহারাদার কেবল বেগম খালেদা জিয়া-ই।

আর এমন অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও ব্যতিক্রমী বলেই আজ এই নেত্রীকে দীর্ঘদিন কারারুদ্ধ রাখা হয়েছে। তাঁর শারীরিক অবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। কারাগারে যে নিদারুন কষ্টে তাকে রাখা হয়েছে, তা অবর্ণনীয়। কারাগারে সাক্ষাত করে আসা এক আইনজীবীর সাথে কথা বলে যা বুঝতে পেরেছি, তাতে উদ্বেগের যথেষ্ট কারন আছে। এই মুহূর্তে বিএনপির নির্বাচন কিংবা ক্ষমতা প্রাপ্তির চেষ্টার চেয়ে বেগম খালেদা জিয়াকে বাঁচাতে তৎপর হওয়া জরুরী। একটি বড় ধরনের আন্দোলনের ডাক না দিলে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এই নেত্রীর বিরুদ্ধে চলমান ষড়যন্ত্র (হত্যাচেষ্টা) বন্ধ হবে না। তাকে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। দীর্ঘদিন দেশ-বিদেশে তাঁর সংবাদ কভার করতে গিয়ে কাছ থেকে তাকে দেখা-জানা ও অনুধাবনের সুযোগ হয়েছে আমাদের অনেকের। আমরা জানি, তিনি ভাঙবেন, কিন্তু মচকাবেন না। তবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখতে বেগম খালেদা জিয়াকে বাঁচানো আমাদের দায়িত্ব। এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, বাংলাদেশের মানুষ এই নেত্রীর পাশে আছে। এখন দরকার তাঁর দলের পক্ষ থেকে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহন। সঠিক দায়িত্ব পালন।

এক্ষেত্রে বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা আরেক নেত্রী শেখ হাসিনারও দায়িত্বশীল হওয়া জরুরী। কেননা আজকে বেগম খালেদা জিয়ার বড় ধরণের কোনো ক্ষতি হলে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, শেখ হাসিনাও খুব কম সময়ের ব্যবধানেই বড় কোনো ক্ষতির মুখোমুখি হবেন। আর পরবর্তী নেতৃত্ব হিসেবে তিনি যেভাবে তাঁর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে প্রতিষ্ঠা করতে চান, সেটাও ঝুঁকির মুখে পড়বে। জয়কে আওয়ামী লীগের রাজনীতি কিংবা বাংলাদেশের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে সহজ ও গণতন্ত্রের পথেই তাকে আসতে হবে। আর সেটার জন্য শেখ হাসিনার-ই দায়িত্ব একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরী করার। এজন্য হলেও বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে চলমান অন্যায় বন্ধ করতে হবে। নইলে শেখ হাসিনা নিজেই স্বল্প সময়ের ব্যবধানে একই অন্যায়ের মুখোমুখি হবেন। নিজের ছেলেকেও তিনি একই আগুনে নিক্ষিপ্ত করে যাবেন। আশা করি, শেখ হাসিনা এমন ভুল অব্যাহতভাবে করবেন না। তিনি সরল পথে ফিরবেন।

পরিশেষে আমার একান্ত নিজস্ব মতামত হলো, এই বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে রক্ষা করতে হলে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি এই দু‘টো দলকেই বাঁচিয়ে রাখতে হবে। যারা আমাদের এই প্রিয় জন্মভুমিকে করাদ রাজ্য বানাতে চায়, তারা দীর্ঘদিন ধরে যে কোনো একটি দলকে ধ্বংস করে দিতে তৎপর। আর এতে আমাদের-ই তারা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। সেটা হোক, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা, এক-এগারো সময়ে তারেক রহমানকে হত্যাচেষ্টা, পিলখানা ট্রাজেডির নামে দু’টো বাহিনী ধ্বংস করা কিংবা বেগম খালেদা জিয়াকে চলমান হত্যাচেষ্টা!!! এসব কাজে আমাদের রাজনীতিকরাই ব্যবহৃত হচ্ছেন। আমাদের রাষ্ট্রীয় বাহিনী এবং আদালতকে ব্যবহার করা হচ্ছে।

ধরুন, ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলার ঘটনা বিএনপি নেতৃত্ব আগে থেকে না জানলেও এ ঘটনায় জড়িত সেনা কর্মকর্তাদের যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেয়ার সুযোগ তারাই করে দিয়েছিলেন। যাদের পরিকল্পনায়-ই হোক, তারেক রহমানকে হত্যা চেষ্টা করেছিল সেনা বাহিনীরই কিছু তরুন কর্মকর্তা। পিলখানা হত্যাকান্ড যে পরিকল্পনায়ই সংঘটিত হোক, তবে এতে জড়িত আমাদেরই দু‘টো বাহিনীর লোকজন। ফলাফলে দু‘টো বাহিনী-ই আজ দুর্বল। (এজন্যই এখন বিজিবি-বিএসএফ বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে থাকে বিজিবি’র সন্তানদের ভারতে পড়াশুনা ও স্ত্রীদের ভ্রমনের সুযোগদান প্রসঙ্গ)। আর বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে চলমান ষড়যন্ত্র (মামলা-সাজা) এবং হত্যাচেষ্টার পেছনে হোমওয়ার্ক যারাই করুক, কিন্তু আমাদেরই রাজনীতিক, আমলা ও আদালত এসব বাস্তবায়নের দায়িত্বে আছেন। কেউ ভাবছি না- আমরা যেসব অন্যায় করছি, এর ফলাফল কি? আমি এমন অন্যায়ের মুখোমুখি হলে কেমন লাগবে? আমার অন্যায়ের জন্য কি কোনো হিসাব আমাকে দিতে হবে না? সে হোক বিচারপতি, দুদক কর্মকর্তা, আইনজীবী, সরকার প্রধান কিংবা সংশ্লিষ্ট কেউ-ই নিজের কাজের পরিণতি নিয়ে ভাবছি না।

আসুন, আমরা এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজি। আর যারা বেগম খালেদা জিয়ার দলে নানাবিধ পদ অলংকৃত করে আছেন, তাদের দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন না তোলাই ভালো। সবারই সীমাবদ্ধতা আছে। থাকতেই পারে। তবে কেন কারান্তরীণ হওয়ার সাত মাসেও বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে উল্লেখ করার মতো রাজনৈতিক কর্মসূচি দেয়া হলো না? - এ প্রশ্ন দলটির তৃনমূলের কর্মীদের মনেই জাগ্রত হচ্ছে। কেন দীর্ঘ দিনে দলটিকে আন্দোলনের উপযোগী করতে উদ্যোগ নেয়া যায়নি? কেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নতুন কমিটি করা সম্ভব হয়নি? কেন দীর্ঘ সময় কেটে গেলেও যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় কমিটি এখনও করা হলো না? এসব করতে কি সরকারের অনুমতি লাগে? কেন কোনো একটিও সাংগঠনিক জেলায় দলকে সংগঠিত ও দলের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি? এই প্রশ্নগুলোর জবাব কে দেবে? যারা নানান পরিচয়ে ধান্ধায় ব্যস্ত, তাদের কাজ তারা করবেই - তাই বলে কি এতো বড় রাজনৈতিক দলকে ধীরে ধীরে এভাবে সংকুচিত করার বিষয়টি সমীচীন? এছাড়াও লক্ষ্যণীয় যে, তৃনমূল থেকে শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে জনগণের নেতা হয়ে ওঠার ভাবটা কেমন যেন কেটে যাচ্ছে। কারো কারো আচরণে মনে হয় যেন, আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণই ক্ষমতা-প্রাপ্তির একমাত্র পথ। এসব ভাবনা বন্ধ করতে হবে। যারা ক্ষমতার পেছনে ছুটছেন, তারা ধিকৃত হবেন। এর গ্যারান্টি আছে। বেগম খালেদা জিয়াকে বাঁচাতে উদ্যোগী হোন। বেগম খালেদা জিয়া শুধু বিএনপি নয়, তিনি বাংলাদেশের মানুষের নেত্রী। গণতন্ত্রের প্রধান সিপাহসালার। অনুধাবন করতে শিখুন, বেগম খালেদা জিয়া-ই বাংলাদেশ।

লেখক : লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক ও গবেষক।