২১ আগস্ট গ্রেনেড হত্যা মামলা

শঙ্কাই বাস্তব: ‘ফরমায়েসি রায়’

শঙ্কাই বাস্তব: ‘ফরমায়েসি রায়’

ঢাকা, ১০ অক্টোবর (জাস্ট নিউজ) : ২১ আগস্ট গ্রেনেড হত্যা মামলার রায়ের আগে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন সেই শঙ্কার রায়ই আজ আদালতে প্রকাশ হয়েছে। গত কয়েকদিন আগে থেকেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ দলটির সিনিয়র নেতাদের বক্তব্যে আজকের রায়ের অগ্রিম আলামত প্রকাশ হয়েছিলো। আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্যে থেকে দেশের আপামর জনগণ ধারণা করে নিয়েছিলেন যে, এই রায় হবে হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে।

শুধু তাই নয়, রায় উপলক্ষে গত কয়েকদিন ধরে সারাদেশে পুলিশ বিএনপি নেতা-কর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি, আটক ও হয়রানি করেছে। যার কারণে রায় সম্পর্কে সারাদেশের মানুষ আগেই একটি ধারণা পেয়েছে। জনগণের বুঝতে বাকি নেই এই রায় পুরোটাই প্রতিহিংসামূলক।

সাধারণ মানুষ বলছে- জাতীয়তাবাদী শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করতেই এই রায় দেয়া দেয়া হয়েছে। সরকার চায় যে কোন মূল্যে নির্বাচন থেকে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে দূরে রাখতে।

রায়ের আগেই তারেক রহমান বলেছিলেন, “অতীতের বাস্তবতায় বলা যায় ২১ আগস্ট মামলার রায়ের দিন আগের মতোই আরেকটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রায় শুনবে জনগণ। যেটাকে আমরা বলতে পারি ফরমায়েশি রায়। এই রায়কে পুঁজি করে বর্তমান ব্যাংক ডাকাত সরকার হয়তো আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে আমার বিরুদ্ধে তাদের চলমান অপপ্রচারের মাত্রা আরেকটু বাড়িয়ে দিবে।”

মঙ্গলবার (লন্ডনের স্থানীয় সময়) সকাল ৮টায় দেশবাসীর উদ্দেশ্যে দেওয়া এক ভাষণে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এই রায়ের বিষয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন।

এদিকে মামলার রায় প্রতিহিংসামূলক জানিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি। প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ মিছিল করেছে দলটি। এ ছাড়াও আগামীকাল বৃহস্পতিবার সারাদেশে বিক্ষোভসহ ৭ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।

রায়ের প্রতিক্রিয়ায় আইনজীবী সমিতি ভবনের সামনে বিক্ষাভ সমাবেশ করেছে আইনজীবীরা। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেছেন, “এ মামলায় তারেক রহমান ন্যায়বিচার পাননি। এমনকি যাদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছে তারাও ন্যায়বিচার পাননি। এই মামলায় সাজা দেওয়ার মতো কোনো ইনগ্রেডিয়েন্ট (উপাদান) নেই। এই সাজা দেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে।”

এই প্রতিহিংসাপরায়ণ মামলার রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীসহ ১৯ আসামীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এছাড়াও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। মামলাটি প্রমাণে রাষ্ট্রপক্ষে ৫১১ জন সাক্ষীর মধ্যে ২২৫ জনকে আদালতে উত্থাপন করা হয়। মামলার মোট আসামি ছিলেন ৫২ জন। বিচারকালে আসামি জামায়াত নেতা আলী আহসান মুহাম্মাদ মুজাহিদের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এবং ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর হামলার মামলায় হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নান ও শরিফ শাহেদুল ইসলাম বিপুলের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় তাদের এই মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। বর্তমানে মামলা দু’টিতে মোট আসামির সংখ্যা ৪৯।

বুধবার দুপুর ১২টায় রাজধানীর নাজিমুদ্দিন রোডে পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে স্থাপিত ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন এ রায় দেন।

এই রায় ঘোষণার আগে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে দেয়া বক্তব্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছিলেন, “এই হামলার সঙ্গে আমাকে এবং বিএনপিকে জড়ানো সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক। কারণ, ওই জনসভার হামলা থেকে বিএনপি’র কিছুই পাওয়ার নেই। কারণ, বিএনপি তখন ক্ষমতায় ছিলো। আওয়ামী লীগের মতো একটি দলের সমাবেশে হামলা চালিয়ে বিএনপি কেন নিজেই নিজের সরকারকে অস্থিতিশীল করবে?”

এসময় তিনি নেতা-কর্মীসহ জনগণের উদ্দেশে বলেন, “পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখুন। কারো পাতানো ফাঁদে পা দিবেন না। আমাদের ঐক্য বিনষ্ট করতে এবং আবার আমাদের বিশ্বাসে চিড় ধরাতে নানা রকম ফাঁদ পাতা হয়েছে। তাই আমাদেরকে সাহস এবং সতর্কতার সাথে যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে প্রস্তুত থাকতে হবে।”

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, “আমার মা-বাবার মতো আমিও দেশ, জাতি এবং মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিবেদিত রেখেছি। রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব এবং গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী বিএনপিকে সুসংগঠিত করার জন্য সারাদেশে তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের কাছে ছুটে গিয়েছি। কাজ করতে গিয়ে দলের সকল পর্যায়ের নেতা-কর্মী এবং শুভাকাঙ্খীদের আকণ্ঠ সাহায্য ও সহযোগিতা পেয়েছি। বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে মুক্তিযোদ্ধা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন এবং জাতীয়তাবাদী আদর্শের রাজনীতিকে চিরতরে উচ্ছেদ এবং মুছে ফেলার সর্বশেষ অংশ হিসাবে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় আমাকে এবং তৎকালীন সরকারের বেশকিছু উর্দ্ধতন কর্মকর্তা এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বাহিনীর প্রধানকেও জড়ানো হয়েছে।”

তিনি বলেন, “আমি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি’র পক্ষ থেকে সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই- আমাদের দল কখনোই এভাবে ঘৃণ্য হত্যার রাজনীতিতে বিশ্বাস করেনা। এই নৃশংস ঘটনার সঙ্গে তৎকালীন সরকার কিংবা বিএনপি’র কেউ জড়িত নয়। কেন জড়িত নয় এর অনেকগুলো সুনির্দিষ্ট কারণ এবং প্রমাণ রয়েছে। আমি এখানে কয়েকটি কারণ সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করতে চাই।

২০০৪ সালের ২১ শে আগস্ট পুলিশ প্রশাসন রাজধানীর মুক্তাঙ্গনে আওয়ামী লীগকে জনসভার অনুমতি দেয়। জনসভার দিন এবং তার আগের দিন পুলিশ প্রশাসন যথানিয়মে মুক্তাঙ্গনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিল। ২১ আগস্ট মুক্তাঙ্গনে আওয়ামী লীগের জনসভার খবর সে সময়ের সকল পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এমনকি ২১ আগস্ট মুক্তাঙ্গনে সমাবেশে লোকজনও আসতে শুরু করেছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই কে কেন কার আদেশে কি উদ্দেশ্যে পুলিশ প্রশাসনকে না জানিয়ে মুক্তাঙ্গন থেকে সমাবেশের স্থান হঠাৎ করে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। কেনো সরিয়ে নেয়া হয়েছিল? শেষ মুহূর্তে সমাবেশের স্থান পরিবর্তনকে কে কার পরামর্শে করেছিল? তা আজ পর্যন্ত জনগণকে জানতে দেয়া হয়নি, জনগণকে জানানো হয়নি। জনগণ তা জানতে চায়।

এ মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তাদের জবানবন্দি উদ্ধৃত করে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। সেই সকল খবর থেকে আমরা দেখতে পাই এবং জানতে পাই আওয়ামী লীগের জনসভায় হামলা পরিকল্পনা সাজাতে মুফতি হান্নানসহ কিছু কিছু জঙ্গি সংগঠনের নেতারা আগে থেকেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছিল। তাহলে কেমন করে ওইসব জঙ্গি সংগঠনের লোকেরা আগেই জেনেছিল সমাবেশ মুক্তাঙ্গনে নয় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে আওয়ামী লীগের অফিসের সামনে।”

তিনি বলেন, “বর্তমান সরকার আইন আদালতকে ব্যবহার করে যাই করুক বা যাই বলুক তথ্য উপাত্ত এবং বাস্তবতা প্রমাণ করে এই জঘন্য হত্যাকান্ডের সঙ্গে বিএনপি’র কোনো পর্যায়ের কেউ জড়িত নয়। আপনারা নিশ্চয়ই ইতিমধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে জেনেছেন এ মামলার সাথে সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তা বিভিন্ন সময় পরিবর্তন করা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তিত হওয়ার সাথে সাথে সাথে সমানভাবে তদন্ত প্রতিবেদন পরিবর্তিত হয়েছে। ষড়যন্ত্রের পথ ধরে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে পুলিশের চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত একজনকে চাকরিতে পুনর্বহাল করে ২১ আগস্ট মামলার তদন্ত দায়িত্ব প্রদান করে। তাকে দিয়েই এই মামলার বিচার চলা অবস্থায় পুনরায় তদন্ত করানো হয়। তিনি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে নতুন করে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করে এবং সেখানে জড়ানো হয় আমার নাম।“

দেশবাসীকে তিনি বলেন, “শুধুমাত্র একজন ব্যক্তিকে ১০০ দিনের বেশি সময় রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের মাধ্যমে তার মুখ থেকে বের করা হয় আমার নাম। পরবর্তীতে ঐ ব্যক্তি আদালতে গিয়ে নিজেই তার বক্তব্য প্রত্যাহারের আবেদন করতে আদালতকে জানায় তাকে নির্মম নির্যাতন করে তার মুখ দিয়ে আমার নাম বলানো হয়েছে।

আপনারা আরো আশ্চর্য হবেন, যেই ব্যক্তির মুখ থেকে আমার নাম বের করে আমাকে একুশে আগস্ট মামলায় জড়ানো হয়েছে ইতিমধ্যে অন্য একটি মামলায় সেই ব্যক্তির ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। এটি কি আপনাদের কাছে কোন একটি স্বাভাবিক ঘটনা মনে হয়?”

(জাস্ট নিউজ/এমআই/১৮১৯ঘ.)