আদালতে খালেদা জিয়ার আড়াই ঘণ্টা অপেক্ষা

আদালতে খালেদা জিয়ার আড়াই ঘণ্টা অপেক্ষা

ঢাকা, ২৪ জানুয়ারি (জাস্ট নিউজ) : জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় হাজিরা দিতে আদালতে গিয়ে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর বক্‌শীবাজার আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত বিশেষ আদালতে পৌঁছেন তিনি। কিন্তু ডেথ রেফারেন্সের কারণে (২০১৭ সালে মৃত্যুবরণকারী আইনজীবীদের স্মরণসভা) আদালতের কার্যক্রম শুরু হয় দুপুর ২টায়।

ফলে খালেদা জিয়াকে দীর্ঘ আড়াই ঘণ্টা শুনানির অপেক্ষায় এজলাসে অপেক্ষা করতে হয়। যদিও মঙ্গলবারের যুক্তিতর্কে খালেদা জিয়ার অংশগ্রহণ ছিল না। অন্য আসামিদের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন হয়েছে। তবে শুনানিতে অনুপস্থিত থাকার আবেদন আদালত নাকচ করে দেয়ায় মামলার কার্যক্রম চলাকালে খালেদা জিয়াকে হাজির থাকতে হচ্ছে প্রতি কার্যদিবসেই।

এদিকে মঙ্গলবার আদালতে এসে খালেদা জিয়া জানতে পারেন দুপুর ২টায় আদালত শুরু হবে। এতে বিরক্তি প্রকাশ করেন তিনি। আদালত বিলম্ব করছেন কেন জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল সাংবাদিকদের বলেন, ডেথ রেফারেন্সের কারণে আজ আদালত ২টা পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।

উল্লেখ্য, প্রতিবছর সিনিয়র আইনজীবীদের স্মরণসভা উপলক্ষে দেশের সব আদালত ২টা পর্যন্ত মুলতবি থাকে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন বলেন, সুপ্রিম কোর্টও ডেথ রেফারেন্স করে থাকে। তবে তার জন্য আগে থেকে নোটিশ দেয়া হয়। এখানে তা করা হয়নি। ওদিকে খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ।

বিএনপি চেয়ারপারসনের আইনজীবীরা বিষয়টি আদালতকে অবহিত করেন। খালেদা জিয়ার আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া আদালতের কাছে মামলার কার্যক্রম বুধবারের জন্য মুলতবির আবেদন জানান। আদালত তা নাকচ করে দিয়ে খালেদা জিয়াকে ওইদিনের জন্য ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দেন।

আদালত জানান, আসামি সরফুদ্দিন আহমেদ ও কাজী সালিমুল হকের পক্ষে যথারীতি যুক্তিতর্ক চলবে। পরে গণমাধ্যমের কাছে সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুবার্ষিকীতে খালেদা জিয়া আদালতে আসবেন কিনা সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে বিএনপি চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইং জানিয়েছে, আদালতের যুক্তিতর্ক মুলতবি না রাখায় ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে একদিনের অব্যাহতি পেলেও আজ বুধবার যথারীতি আদালতে যাবেন খালেদা জিয়া।

এর আগে আদালতের কার্যক্রম শুরু হলে আসামি শরফুদ্দিন আহমেদের পক্ষে শুনানি করেন তার আইনজীবী আহসান উল্লাহ। ২০১৭ সালের ২৬শে জানুয়ারি আদালতে শরফুদ্দিনের দেয়া আত্মপক্ষ সমর্থনকারী বক্তব্যটির ওপর শুনানি করেন তিনি।

বক্তব্যে শরফুদ্দিন আহমেদ আদালতকে নিজের পরিচয় ও অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেছেন- আমি শরফুদ্দিন আহমেদ একজন ব্যবসায়ী। বিগত ১০ বছর যাবত আমি সপরিবারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী। সে সুবাদে আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশে নিয়মিত যাতায়াত ও অবস্থান করি এবং বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনা ও বাড়িসহ জমাজমি দেখাশোনা করি।

শরফুদ্দিন আহমেদ বলেছেন, আমি একজন জমি বিক্রেতা মাত্র। আমি কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জমি বিক্রয়ের চুক্তি সম্পাদন করিনি বা আমি কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো অর্থ গ্রহণ করিনি। জমি বিক্রয়ের অগ্রিম বাবদ প্রাপ্ত অর্থ এবং দোকান কেনা বাবদ ওই অর্থ প্রদান এবং পরবর্তীতে আদালতের নির্দেশে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টকে অগ্রিম নেয়া অর্থ ফেরত দেয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো আমার আয়কর হিসাবে নিয়মিত উল্লেখ করেছি। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের কাছ থেকে আমার গ্রহণকৃত অর্থ কোনো বেআইনি লেনদেন নয়। কোনো অসৎ উদ্দেশ্যও এর পেছনে কাজ করেনি। আমার জমি বিক্রয়ের অগ্রিম বাবদ প্রাপ্ত অর্থের বিষয় মামলার বাদীসহ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা সাক্ষীরা জানেন। আমার উপরোক্ত বক্তব্যের সমর্থনে দালিলিক ও মৌখিক সাক্ষ্য প্রদান করবো। এ মামলায় আমার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ মিথ্যা।

তিনি বলেন, ২০০৬ সালে ইউনাইটেড সিটি টুইন টাওয়ার ডেভেলপারস লিমিটেডের গুলশান-২ এ অবস্থিত ইউনাইটেড হাইটস প্রজেক্টের ২টি দোকান ক্রয়ের জন্য অর্থের প্রয়োজন হওয়ায় আমি আমার সাভার থানার বড় আশুলিয়া মৌজার ৭৪.৫ শতক জমি বিক্রয়ের মনোস্থির করি। ইচ্ছুক ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের প্রচেষ্টা নেই। এক পর্যায়ে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের সঙ্গে ৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা মূল্য নির্ধারণে উক্ত জমি বিক্রয়ের কথাবার্তা হয়। ২০০৬ সালের ১৬ই নভেম্বর জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের সঙ্গে একটি চুক্তিনামা সম্পাদন করি। সে অনুযায়ী ২টি এফডিআর যার ফেস ভ্যালু ২ কোটি টাকা এবং ম্যাচিউর ভ্যালু ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট থেকে অগ্রিম নিই। ওইদিনই একটি এফডিআর ভাঙিয়ে আমার বন্ধু কাজী সালিমুল হক ও পুত্র সাঈদ আহমেদের নামে একটি যৌথ এফডিআর করি।

শরফুদ্দিন তার বক্তব্যে আদালতকে বলেছেন, পরবর্তীতে কাজী সালিমুল হক তার নামে এফডিআর রাখতে অনিচ্ছুক হলে দুটি এফডিআর ভাঙিয়ে ২০০৭ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি আমার ভাই গিয়াসউদ্দিনের নামে ২টি এফডিআর করি। উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে আমার ব্যবসা ও জমি বিক্রয়ের অর্জিত অন্যান্য অর্থ কাজী সালিমুল হক ও পুত্র সাঈদ আহমেদের নামে কয়েকটি যৌথ এফডিআর করেছি যেগুলো আমার আয়কর হিসেবে উল্লেখ করা আছে। যথারীতি আয়করও প্রদান করা হয়েছে।

তিনি বলেন, আমি উপরোল্লিখিত দোকান ২টি ক্রয়ের অর্থ পরিশোধকালে আমার ভাই গিয়াসউদ্দিনের নামীয় এফডিআর ২টি ভাঙিয়ে ৬টি পে-অর্ডারের মাধ্যমে ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬শ’ টাকা ৮০ পয়সা আমার প্রাইম ব্যাংকের নিউ ইস্কাটন শাখার অ্যাকাউন্টে জমা দেই। পরে আমি ওই অর্থ ও নিজ জমাকৃত অর্থসহ ৩ কোটি টাকা প্রাইম ব্যাংকের নিউ ইস্কাটন শাখা থেকে ৬টি পে-অর্ডার তৈরি করে গত ২০০৭ সালের ১৬ই এপ্রিল ইউনাইটেড সিটি টুইন টাওয়ার ডেভেলপারস লিমিটেডকে পরিশোধ করি।

শরফুদ্দিনের আইনজীবী আহসান উল্লাহ বলেন, আমার মক্কেল শরফুদ্দিনের সঙ্গে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের জমি বিক্রয়ের চুক্তির শর্ত মোতাবেক ২০০৭ সালের ৩১শে মের মধ্যে বিক্রয় দলিল সম্পাদনের তারিখ নির্ধারিত ছিল। কিন্তু বিগত ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি বাংলাদেশে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন ও রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি হওয়ায় জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের কোনো কর্মকর্তা বা প্রতিনিধির সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব না হওয়ায় এবং জমির বিক্রয় মূল্য না পাওয়ায় বিক্রয় দলিল রেজিস্ট্রি করা সম্ভব হয়নি। পরে শরফুদ্দিন আহমেদ ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকার বিজ্ঞ যুগ্ম জেলা ৩য় আদালত থেকে মানি স্যুট নম্বর- ১/২০১২ মোকদ্দমার বিবাদী হিসেবে নোটিশ পান।

নোটিশ মারফত জানতে পারেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট জমি ক্রয় বাবদ প্রদেয় অগ্রিম ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা ফেরত দাবি করছে। এতদিনে ওই জমির মূল্য অধিক পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় শরফুদ্দিন আহমেদ অগ্রিম বাবদ নেয়া অর্থ ফেরত দিতে মনস্থ করেন। এই বিষয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে একটি সোলেনামা সম্পাদিত হয় এবং তা আদালতে দাখিল করা হয়। আদালত ২০১৩ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি সোলেনামার ভিত্তিতে শরফুদ্দিন আহমেদকে ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা ট্রাস্টের অনুকূলে ফেরত দেয়ার নির্দেশ দিয়ে রায় দেন। তারপর তিনি প্রাইম ব্যাংকের নিউ ইস্কাটন ও গুলশান শাখা থেকে ১৩টি পে অর্ডার তৈরি করে (যার মোট মূল্য ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা) জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের অনুকূলে হস্তান্তর করেন।

পে-অর্ডারগুলোর অর্থ উত্তরা ব্যাংক গুলশান শাখায় রক্ষিত জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট এবং এর হিসাবে জমা হয়েছে বলে জেনেছেন। বিকালে সোয়া তিনটায় আদালত মুলতবি ঘোষণা করেন। আজ ২৪ ও আগামীকাল ২৫শে জানুয়ারি আসামি শরফুদ্দিন আহমেদ ও কাজী সালিমুল হকের পক্ষে চলমান যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের দিন ধার্য রয়েছে। মঙ্গলবার শরফুদ্দিন আহমেদের পক্ষে শুনানি শেষ হওয়ায় আজ কাজী সালিমুল হকের পক্ষে শুনানি করবেন তার আইনজীবী আহসান উল্লাহ।

এ মামলায় আসামিদের মধ্যে- বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব ড. কামালউদ্দিন সিদ্দিকী ও সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান পলাতক রয়েছেন। খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা জানান, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় আসামিপক্ষের শুনানি শেষ পর্যায়ে। তারপরই শুরু হবে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার শুনানি। ওই মামলার অপর আসামিরা হলেন- খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হারিছের তখনকার সহকারী একান্ত সচিব ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান।

(জাস্ট নিউজ/ওটি/১১১১ঘ.)