কারাগারে পঞ্চম ঈদ খালেদা জিয়ার

কারাগারে পঞ্চম ঈদ খালেদা জিয়ার

বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ও দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। সাবেক সেনাপ্রধান শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী তিনি। জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী রাজনীতিক হিসেবে তার খ্যাতি রয়েছে। তিনি ব্যাপক জনপ্রিয় এবং এক ক্রান্তিককালে তার নেতৃত্বে বিএনপি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে পেয়েছেন ‘আপসহীন নেত্রীর’ খেতাব। শুধু দলের নেতাকর্মীই নয় দেশজুড়ে তার কোটি ভক্ত অনুসারী রয়েছেন। কিন্তু আজ প্রায় এক বছর চার মাস ধরে কারাবন্দী খালেদা জিয়া। মামলা জামিনে দীর্ঘসূত্রিতা আর নতুন মামলায় গ্রেফতার দেখানোর কারণে জামিন পাচ্ছেন না তিনি। ফলে মুক্তিও হচ্ছে না। সবারই প্রত্যাশা ছিল ঈদের আগেই কারামুক্ত হবেন খালেদা জিয়া। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। ফলে ৭৪ বছরে পা দেয়া বয়স্ক এই সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে কারাগারে বন্দিদশার মধ্যেই পঞ্চমবারের মতো ঈদ করতে হচ্ছে। এর আগে গত ঈদুল ফিতরও জরাজীর্ণ পরিত্যক্ত কারাগারেই কেটেছে তার। এ বছরও রোজার ঈদ কাটছে বন্দী অবস্থায়। এ দিকে দলীয় প্রধানের মুক্তি না হওয়ায় বিএনপি ও বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের মাঝেও ঈদ নিয়ে তেমন আগ্রহ নেই। ঈদের আনন্দও অনেকটা ম্লান হয়ে গেছে তাদের। অনেকেই বেগম জিয়ার মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত ঈদ আনন্দ উপভোগ করতে চান না।

আলাপকালে বিএনপি ও বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা জানান, আমাদের কিসের ঈদ? গণতন্ত্রের নেত্রী কারারুদ্ধ, গোটা দেশ এখন গণতন্ত্রহীন অবরুদ্ধ। গণতন্ত্রের মা (খালেদা জিয়া) কারামুক্ত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের কোনো ঈদের আনন্দ নেই। আমাদের মা, আমাদের নেত্রী যতদিন কারামুক্ত হবেন না ততদিন আমরা কোনো আনন্দ-উৎসব করব না। অনেকেই ফেসবুকে খালেদা জিয়ার মুক্তি চেয়ে পোস্টার শেয়ার করেছেন। তারা বলেছেন, দেশনেত্রীর মুক্তি ছাড়া তাদের মনে ঈদের কোনো উৎসব নেই।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেদনাদায়ক ঈদ হবে এবার। কারণ সবচেয়ে জনপ্রিয় দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে অবৈধ ক্ষমতার জোরে কারাবন্দী রাখা হয়েছে, কারণ গণতন্ত্রহীন দেশে অশান্তি, প্রতিহিংসা, হানাহানি ও বিচারহীনতার রাজত্ব কায়েম রাখার জন্য। বিএনপিসহ বিরোধী দলের ৫০ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, তারা বাড়িছাড়া, ঘরছাড়া অথবা কারাগারে, তাদের ঘরেও ঈদ আনন্দ নেই। তিনি বলেন, কারাগারে এটাই চেয়ারপারসনের প্রথম ঈদ নয়। এর আগেও তিনি সংসদ ভবন এলাকার সাব জেলে দুটি ঈদ পালন করেছেন। ওই সময় তার পরিবারের সদস্যরা ঈদের দিন তার সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। জীবনে দ্বিতীয়বার কারাবন্দী হয়ে এবার পঞ্চমবার কারাগারে ঈদ করতে হচ্ছে তাকে।

জানা যায়, ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ভোরে খালেদা জিয়াকে তৎকালীন ক্যান্টনমেন্টের মইনুল রোডের বাসভবন থেকে গ্রেফতারের পর সোজা নিয়ে যাওয়া হয় সিএমএম আদালতে। সেখানে তার জামিন নামঞ্জুর হলে তাকে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় স্থাপিত সাব জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তিনি মুক্তি পান। এরমধ্যে ২০০৭ সালের ১৪ অক্টোবর প্রথম কারাগারে পালিত হয় তার রোজার ঈদ। ওই দিন তার বড় ছেলে তারেক রহমান, ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী ও তাদের সন্তানেরা দেখা করতে পারলেও এবার সেটা হচ্ছে না। কারণ তারেক রহমান (বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান) স্ত্রী ও মেয়েসহ লন্ডনে অবস্থান করছেন। ২০১৫ সালে মৃত্যুবরণ করেছেন ছোটে ছেলে আরাফাত রহমান কোকো। ২০০৭ সালের কোরবানির ঈদও ওই সাব জেলেই পালন করেন তিনি। তবে এবারই প্রথম দ্বিতীয়বার বন্দী ও সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে ঈদ পালন করছেন বেগম খালেদা জিয়া। এ নিয়ে তার পঞ্চমবার ঈদ কাটছে বন্দী অবস্থায়।

উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছর কারাদণ্ড দেন। ওইদিনই তাকে আদালত থেকে সরাসরি নাজিমউদ্দিন রোডে অবস্থিত সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। পরিত্যক্ত ওই কারাগারে একমাত্র বন্দী ৭৪ বছর বয়সী সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। সর্বশেষ গত ১ এপ্রিল থেকে বিএসএমএমইউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিনি। দলের চেয়ারপারসনের মুক্তি দাবিতে বিভিন্ন ধরনের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করে আসছে বিএনপিসহ বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন। গত প্রায় ১৫ মাস ধরে বন্দী খালেদা জিয়া বিভিন্ন সময় গুরুতর অসুস্থ হন। বিএনপির পক্ষ থেকে বারবার সংবাদ সম্মেলন করে বলা হয়েছে কারাগারে প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েছেন খালেদা জিয়া। তাকে তার পছন্দ অনুযায়ী হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়ার দাবিও জানানো হচ্ছে। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর শারীরিক অবস্থার এখনো তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। এ জন্য পরিবারের সদস্য, ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও রাজনৈতিক সহকর্মীরা রয়েছেন দুশ্চিন্তায়।

নয়া পল্টনেই ঈদ করবেন রিজভী : এদিকে নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়েই ঈদ কাটাবেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহগাসচিব রুহুল কবির রিজভী। বেগম খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার আগেই ৩০ জানুয়ারি থেকে বিএনপির নয়াপল্টনের কার্যালয়ে একরকম অবরুদ্ধ জীবন-যাপন করছেন তিনি। বেগম জিয়াকে কারাগারে পাঠানোর পর এখনো তিনি সেখানেই অবস্থান করছেন। মাঝে মাঝে হঠাৎ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে রাজপথে সহযোদ্ধাদের নিয়ে মিছিলও করছেন। কিন্তু প্রিয় নেত্রীর মুক্তি না হওয়ায় গতবছরও রোজার ঈদ একা একাই কাটিয়েছেন নয়াপল্টনেই। এবারো রোজার ঈদ সেখানেই কাটছে বলে জানিয়েছেন তিনি। দলীয় কার্যালয়ে একপ্রকার অবরুদ্ধ অবস্থায় আছেন জানিয়ে তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে মামলার কোনো অভাব নেই। এখান থেকে বের হয়ে বাসায় গেলেই পথে যে গ্রেফতার হবো না তার নিশ্চয়তা নেই। পুলিশ যে আমাকে তুলে নিয়ে যাবে না তার কী নিশ্চয়তা? নেত্রী মুক্ত হলেই তিনি ঘরে ফিরবেন বলেও জানান।

সাক্ষাতের অনুমতি মেলেনি : ঈদের দিন খালেদা জিয়ার সাথে তার স্বজন ও বিএনপির সিনিয়র নেতারা সাক্ষাতের জন্য অনুমতি চেয়েছেন। কিন্তু এখনো জানানো হয়নি। আর ঈদের দিন সকালে মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতারা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাজার ও বিকেলে বনানীতে বেগম জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর কবর জিয়ারত করবেন বলে জানান বিএনপির চেয়ারপারসনের প্রেস উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান। তিনি জানান, গতবছর রোজার ঈদে ম্যাডামের স্বজন ও সিনিয়র নেতারা সেমাই নিয়ে কারাগারে গেলেও কর্তৃপক্ষ তাদের ফিরিয়ে দেয়। ফলে ঈদের খাবার খাননি তিনি। এবারো অনুমতি চাওয়া হলেও কোনো সাড়া মেলেনি।-নয়া দিগন্ত