দেশে উন্নয়নের নামে চলছে বল্গাহীন লুণ্ঠন : রিজভী

দেশে উন্নয়নের নামে চলছে বল্গাহীন লুণ্ঠন : রিজভী

গণতন্ত্রের অভাবে শাসন কাঠামো ভেঙে পড়েছে মন্তব্য করে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, বর্তমান অবৈধ সরকার তথাকথিত উন্নয়নের ফাঁপড়বাজির মাধ্যমে সাধারণ জনগণকে ধোঁকা দিয়ে জোর করে ক্ষমতার মসনদ দখল করে স্বৈরশাসন চালাচ্ছে। রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে গোষ্ঠীশাসনতন্ত্র বা অলিগোর্কি।

আজ বৃহস্পতিবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বাস্তবে জনগণের কোনো উন্নয়ন হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীকে বলবো- উন্নয়ন প্রোপাগান্ডার ঢোল বাজানো বন্ধ করুন। দেশের দরিদ্র মানুষকে নিয়ে তামাশা করবেন না। দ্রুত দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা দিন।

নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ আযম খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবুল খায়ের ভুইয়া, সহ সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম আজাদ, তাঁতী দলের আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ, কৃষকদলের সদস্য সচিব হাসান জাফির তুহিন প্রমুখ।

লিখিত বক্তব্যে রুহুল কবির রিজভী বলেন, সরকারের রথী-মহারথীরা গণতন্ত্রের চাইতে উন্নয়নকে প্রাধান্য দেয়ার নামে সব সামাজিক চুক্তি ভঙ্গ করে জনগণকে শৃঙ্খলিত করেছে। জনগণের ভাগ্যের উন্নয়নের নামে চলছে বল্গাহীন লুণ্ঠন। প্রায় আড়াই কোটি মানুষ তিন বেলা পেটভরে খেতে না পারলেও এই মিডনাইট সরকার উন্নয়নের দোহাই দিয়ে গরিবের পেটে লাথি মারতেই গণতন্ত্রের কবর রচনা করেছে, জনগণের ভোটের অধিকার হরণ করেছে। একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। মিডনাইট নির্বাচনকে জায়েজ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতা হলো এই উন্নয়ন হলো ক্ষমতাসীন দলের লোকজন আর তাদের সহযোগীদের পকেটের উন্নয়ন। আর নিরন্ন মানুষের সংখ্যা বাড়ানোর উন্নয়ন।

তিনি বলেন, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থা (এফএও), শিশু তহবিল ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিওএইচও), আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল (আইএফএডি) ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির উদ্যোগে ‘বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি বাস্তবতা ২০১৯’ শিরোনামে যৌথভাবে প্রণীত নতুন প্রতিবেদনে বলেছে, ‘বাংলাদেশে ২ কোটি ৪২ লাখ মানুষ ভালোভাবে খেতে পায় না। পর্যাপ্ত খাবারের অভাবে বাংলাদেশে প্রতি ছয়জন মানুষের মধ্যে একজন অপুষ্টিতে ভুগছে। গত এক দশকে এদেশে অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের সংখ্যা অন্তত ১০ লাখ বেড়েছে।’

রিজভী বলেন, অথচ প্রধানমন্ত্রী বলে আসছেন, ‘দেশে কোনো হাহাকার নেই, অভুক্ত মানুষ নেই।’ জনগণের টুঁটি চেপে ধরা এই সরকারের চাপাবাজ মন্ত্রীরা বলছেন, বাংলাদেশ নাকি উন্নয়নে সিঙ্গাপুর, কানাডা এবং ইউরোপের মতো উন্নত দেশে পরিণত হচ্ছে। এই সরকারের অর্থমন্ত্রী গতবছর বলেছিলেন, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ কানাডার সমান হয়ে যাবে। এক বছরের মধ্যে স্পেন, থাইল্যান্ডের সমান হয়ে যাবে। দেশে কোন গরীব নেই। এমনকি এক বছর আগে ২০১৮ সালের ২৫ জুন জাতীয় সংসদে বাজেটের উপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সেই সময়ের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন দেশের দারিদ্র্যের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে ৪ কোটি লোক দরিদ্র, ২ কোটি লোক অভুক্ত থাকে। পুষ্টি ঠিকভাবে পায় না। তার চেয়ে বড় কথা দেশে আয় বৈষম্য বেড়েছে বিপুলভাবে।’

তিনি বলেন, প্রবাদ আছে-মিথ্যা বলা মহাপাপ, আর এখন বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সত্য বলা মহাভয়। মিথ্যা বলা যদি কোনো ‘শিল্প’ হতো তাহলে অনর্গল মিথ্যা বলা এই সরকারের মন্ত্রী-নেতারা হতেন সেই শিল্পের নায়ক-মহানায়ক। এরা তাদের রাজনৈতিক পাঠশালায় সত্য কথা বলার শিক্ষা অর্জন করেননি। জাতিসংঘের ‘বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি বাস্তবতা ২০১৯’ প্রতিবেদন হলো চাপাবাজ সরকারের ‘উন্নয়নের বিহাইন্ড দ্যা সিন’। রাষ্ট্রকে ধনীর তোষণে পরিণত করা হচ্ছে আর তার জনগণকে ভাতের মাড় খাওয়ানো হচ্ছে।

বিএনপির এই নেতা প্রশ্ন রেখে বলেন, গত বছর ২৩ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের হিলটন হোটেলে এক সংবর্ধনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তিনি নাকি দেশের ১৬ কোটি মানুষকে খাওয়াচ্ছেন। তাহলে এই হলো তার খাওয়ানোর নমুনা! ক্ষমতাসীনরা করছে নিজেদের ভাগ্যের উন্নয়ন, আর বলে বেড়াচ্ছে সেটাই নাকি জনগণের উন্নয়ন। গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে মিথ্যা উন্নয়নের প্রপাগান্ডা চালানো হচ্ছে। জনগণের টাকায় পরিচালিত বাংলাদেশ টেলিভিশন করমচা আর লেবুর বাম্পার ফলন নিয়ে ব্যস্ত।

রিজভী বলেন, এদেশের প্রায় আড়াই কোটি মানুষের ঘরে খাদ্য নাই, অথচ সরকারের লোকজন ১ টাকার কাজ ১০ টাকায় দেখিয়ে ডিজিটাল লুটপাট করে দেশে-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ছে। বাংলাদেশের ১ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ এবং ১ কিলোমিটার ফ্লাইওভার নির্মাণ ব্যয় চীন, ভারত ও যুক্তরাজ্যের চেয়ে বহুগুন বেশি। নানা অজুহাতে মেগা প্রজেক্টগুলোর প্রকল্প ব্যয় কয়েকশ গুন বৃদ্ধি করে মেগা চুরির সুবন্দোবস্ত করা হয়েছে। পদ্মা সেতুর প্রকল্প ব্যয় ছিল ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। আর তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। প্রায় সবগুলো ফ্লাইওভারের প্রকল্প ব্যয় এভাবে কয়েকগুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। মেগা চুরির সুযোগ সৃষ্টি করতে সরকার মেগা প্রকল্প গ্রহণে বেশি আগ্রহী। আর এটাকে জনগণের ভাগ্যের উন্নয়ন বলে চালানো হচ্ছে। উন্নয়নের নামে চুরির রোল মডেল হচ্ছে বর্তমান আওয়ামী সরকার।

তিনি আরো বলেন, বিনা নির্বাচনে শুধু লুটপাটের জন্য ক্ষমতায় থাকা এই অবৈধ সরকারের গত দশ বছরে ধনী আরো ধনী, গরীব আরো গরীব হয়েছে। নজীরবিহীন দলীয়করণ, প্রশাসন ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল ও ক্ষয়িষ্ণু করেছে। জবাবদিহিতার অভাব, অকার্যকর পালার্মেন্ট দুর্নীতিকে লাগামহীন পর্যায়ে নিয়ে গেছে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় ধ্বংসের মুখে। শেয়ার মার্কেট লুট, ব্যাংক লুট, দলীয় ব্যক্তিদের জন্য ঋণ সুবিধা ও ফেরত না দেবার প্রবনতা একনায়ক সরকারের সমর্থক ও তল্পীবাহকদের বা লাগামহীনভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহার ও গণলুট বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ভেতরে ভেতরে অন্তঃসারশূন্য করে ফেলছে। বার বার জিডিপি হিসেবের বিভ্রাটে ফেলা হচ্ছে জাতিকে। সরকারের জিডিপি’র হিসাব ডাহা মিথ্যাচারের একটি নমুনা।

তিনি বলেন, এদেশের জনগণ নিশ্চয়ই ভুলে যায়নি যে, স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও তার সহধর্মিনী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সুবর্ণ শাসন আমলের কথা। এখনো যে প্রবাদটি চালু আছে তা হলো জিয়ার আমলে মানুষ দরজা খুলে ঘুমাতে পারতো, আর এখন দুষ্কৃতিকারীরা ঘরের ভিতর ঢুকে মানুষ খুন করছে। বিএনপি শাসনামলের ২০০৫-০৬ অর্থ বছরে গোল্ডম্যান স্যাকস বাংলাদেশকে ‘নেক্সট ইলেভেন’ উন্নয়নশীল দেশভুক্ত করেছে, আর বিশ্বখ্যাত বিদেশী পত্রিকা বাংলাদেশকে ইমার্জিং টাইগার আখ্যা দিয়েছিল। সাম্প্রতিককালের মিডিয়াতে বলা হচ্ছে, বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জিডিপির হিসেবের যে ইংগিত দিয়েছে তা সরকারের দাবির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। শুভংকরের ফাঁকি হলো আয় বৈষম্য বেড়েই চলেছে। উন্নয়নের সুফল সরকারের কিছু অনুগ্রহপুষ্ট ব্যক্তিদের কাছে কুক্ষিগত হচ্ছে। দরিদ্র ও নিম্নমধ্যবিত্তের অবস্থা আরো শোচনীয় হচ্ছে। দেশে খুন, গুম, হত্যা, ধর্ষণ মহামারি আকারে বেড়েই চলছে। ২২ জেলায় বন্যায় অসহায় অভুক্ত মানুষকে ত্রাণ দেয়া হচ্ছে না।

রিজভী বলেন, সম্প্রতি আওয়ামী নেতা হানিফ সাহেব বলেছেন- বিএনপি আন্দোলন করে বেগম জিয়াকে মুক্ত করতে পারবে না। এই কথায় প্রমাণিত হলো যে, প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার কারণেই বেগম খালেদা জিয়া কারাবন্দী। এদেশের মুক্তিকামী জনগণের আশাস্থল দেশনায়ক ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে সাজানো মিথ্যা মামলায় অন্যায়ভাবে সাজা দেয়া হয়েছে। বিচার বিভাগসহ প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে দলীয় ক্যাডারদের নিয়োগ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

তিনি জানান, বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও দ্রুত নতুন নির্বাচনের দাবিতে আজ বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হবে বিএনপির বিভাগীয় মহাসমাবেশ। পর্যায়ক্রমে সবগুলো বিভাগে এই মহাসমাবেশ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। এটা আমাদের আন্দোলনের একটি ধাপ। আজ বরিশালে আমাদের মহাসমাবেশ হবে। মহাসমাবেশ ঘিরে মুক্তকামী জনতার মাঝে ব্যাপক সাড়া পড়েছে।

এমজে/