জি কে শামীমের টাকার পাহাড়

৩৪ ব্যাংক হিসাবে লেনদেন হাজার কোটি টাকা

৩৪ ব্যাংক হিসাবে লেনদেন হাজার কোটি টাকা

‘টেন্ডার কিং’খ্যাত ঠিকাদার জি কে শামীমের ব্যাংক হিসাব ও আর্থিক লেনদেন প্রবাহ যাচাইয়ে মাঠে নেমেছে একাধিক সংস্থা। প্রাথমিক তদন্তে যেসব তথ্য বেরিয়ে আসছে, তাতে তদন্ত সংস্থাগুলো হতবাক।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তো রীতিমতো চক্ষু চড়কগাছ অবস্থা। শুধু নগদে নয়, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকেও মোটা অঙ্কের অর্থ প্রভাবশালীদের ব্যাংকে ট্রান্সফার করেছেন জি কে শামীম। বিপুল অঙ্কের টাকা পাঠানো হয় বিদেশের একাধিক ব্যাংকেও।

অবৈধ অর্থ লুকিয়ে রাখতে নামে-বেনামে ব্যাংক হিসাব খোলা হয়। বাড়ির কেয়ারটেকার, নিরাপত্তারক্ষী থেকে শুরু করে দূর সম্পর্কের একাধিক আত্মীয়র নামেও একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সন্ধান মিলেছে। বেনামে খোলা হলেও অ্যাকাউন্টগুলোয় লেনদেন হয় কয়েক শ কোটি টাকা।

সূত্র জানায়, জি কে শামীমের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত অর্থ পাচার মামলার বিশেষায়িত তদন্তের জন্য এরই মধ্যে এ সংক্রান্ত মামলা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। দায়িত্ব পেয়ে দ্রুততার সঙ্গে আনুষঙ্গিক কাজও শুরু করেছে সিআইডি।

এরই মধ্যে জি কে শামীমের সব ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দেয়া হয়েছে। অর্থ পাচার সংক্রান্ত তথ্য চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটেও।

এছাড়া শূন্য থেকে ধনকুবের বনে যাওয়া জি কে শামীমের জীবনবৃত্তান্ত সংগ্রহের চেষ্টা করছে সিআইডি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জি কে শামীমের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত অর্থ পাচার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আবু সাঈদ মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, ‘তদন্তের অংশ হিসেবে আমরা তার আর্থিক অপরাধের তথ্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করছি। তিনি দেশের বাইরে কী পরিমাণ অর্থ পাচার করছেন, সে বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে। জি কে শামীমের শতাধিক ব্যাংক হিসাবের তথ্য চাওয়া হয়েছে।’

সূত্র বলছে, এরই মধ্যে ৩৪টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জি কে শামীমের হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। বিভিন্ন ব্যাংকে খোলা এসব অ্যাকাউন্টের বেশির ভাগই জি কে শামীম ও তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান জিকেবি অ্যান্ড কোম্পানির নামে খোলা।

এছাড়া কয়েকটি অ্যাকাউন্ট খোলা হয় ৩টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে। শামীমের স্ত্রী, ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ভাই ও মায়ের নামেও কয়েকটি অ্যাকাউন্টে বিপুল অঙ্কের অর্থ জমা রয়েছে। এরই মধ্যে অ্যাকাউন্টগুলো ফ্রিজ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

সূত্র বলছে, জি কে শামীমের একাধিক ব্যাংক হিসাবে সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। তার কোম্পানির একাধিক অ্যাকাউন্ট থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ বেশ কয়েকটি সন্দেহজনক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরের পরই টাকা উঠিয়ে নেয়া হয়।

ধারণা করা হচ্ছে, ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে তিনি ঘুষ বা কমিশন হিসেবে এসব অর্থ অন্যত্র পাঠান। জি কে শামীমের নামে যে ক’টি ব্যাংক হিসাবে বিপুল অঙ্কের অর্থ লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে, এর মধ্যে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের মহাখালী শাখার হিসাব নম্বর ৪০৩৮১১১০০০০০৩৫৪, ৪০৩৮১২৪০০০০০০২৫ অন্যতম। এছাড়া গুলশান লিংক রোডস্থ ইসলামী ব্যাংকিং ধারার একটি শাখায় হিসাব নম্বর ১৬৪১০২০০০০৮২৫, ১৬৪১২২০০০০০৮৫ ও ১৬৪১০২০০০১১৪১ এবং উত্তরা ব্যাংক লিমিটেড নর্থ শাহাজাহানপুর শাখার অ্যাকাউন্ট নম্বর ০০১১১০০১১৪৮৯২ ও ০০১২১০০০২১৮০১তে হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়।

সূত্র বলছে, জি কে শামীম তার লাইসেন্স ভাড়া দিয়েও বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেন। অন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগের নামে বড় বড় কাজ বাগিয়ে নেয়া হয়। কাগজেকলমে থাকলেও অনেক টেন্ডারে জি কের প্রতিষ্ঠান বাস্তবে কখনোই যুক্ত হয়নি। জি কে শামীমের সঙ্গে ট্রাস্ট ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ শাখায় জামাল অ্যান্ড কোং নামের অপর একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ হিসাব খোলা হয়। এর নম্বর ০০৩৫০২১০০০৩০৮৩।

এই অ্যাকাউন্টে কয়েক শ কোটি টাকার লেনদেন হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঠিকাদার বলেন, জামাল অ্যান্ড কোং-এর মালিকের নাম জামাল হোসেন। তার বাড়ি নোয়াখালী। স্বল্পশিক্ষিত এই ঠিকাদার জি কের সংস্পর্শে এসে এখন অঢেল টাকার মালিক। ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর রোডে তিনি সম্প্রতি ২০০ কোটি টাকায় একটি ভবনসহ জায়গা কিনেছেন। সেখানে লাগিয়ে দিয়েছেন জামাল অ্যান্ড কোম্পানির বিশাল সাইনবোর্ড।

জি কে শামীমের সঙ্গে বিশেষ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তিনি নোয়াখালীতে বিশ্ববিদ্যালয়, নার্সিং ইন্সটিটিউট, মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের একক ঠিকাদার। জামাল অ্যান্ড কোং-এর সঙ্গে জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠান দেশের বিভিন্ন স্থানেও যৌথভাবে কাজ করত। এছাড়া জামাল অ্যান্ড কোম্পানি শুধু লাইসেন্স ভাড়া দিয়েই কয়েক শ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।

জামাল এবং জি কে উভয় প্রতিষ্ঠান দেশের বাইরে মধ্যপ্রাচ্যের দুবাইয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছে।

ট্রাস্ট ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ শাখায় প্রজেক্ট বিল্ডার্স লিমিটেডের সঙ্গেও যৌথভাবে একটি অ্যাকাউন্ট খোলা হয় (নম্বর ০০৩৫০২১০০০৩০০১)। অনেক প্রকল্পের কাজ বাগিয়ে নিতে মূলত প্রজেক্ট বিল্ডার্সের লাইসেন্স কাজে লাগায় জি কে বিল্ডার্স। প্রজেক্ট বিল্ডার্সের সঙ্গে যৌথভাবে কাজের সাইনবোর্ডে কাজ আনা হলেও প্রজেক্ট বিল্ডার্সকে কানাকড়িও দেয়া হয়নি।

মূলত জি কের চাঁদাবাজির কারণেই একসময় বৃহৎ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত প্রজেক্ট বিল্ডার্স এখন বিলুপ্তির পথে। এছাড়া জিকেবি অ্যান্ড টিইএ কনসোর্টিয়ামের সঙ্গেও যৌথ উদ্যোগে কাজ করে জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠান। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক এশিয়ায় খোলা যৌথ অ্যাকাউন্ট নম্বর হচ্ছে- ০০৩৫-০২১০০০২৬৪৬।

পদ্মা অ্যাসোসিয়েট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড বা পায়েল নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে প্রচুর নির্মাণকাজ করে জি কে। পায়েলের মালিক মিনারুল চাকলাদার। তার বাড়ি যশোর।

তিনি অজ্ঞাত কারণে কিছুদিন পর পরই সিঙ্গাপুর ও ব্যাংকক ভ্রমণ করেন। মিনারুল চাকলাদার এখন গা ঢাকা দিয়েছেন।

দি ইঞ্জিনিয়ার অ্যান্ড আর্কিটেক্ট নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক সাতক্ষীরার সাবেক এমপি ইঞ্জিনিয়ার মজিবুর রহমান ও তার ছেলে চঞ্চল। কিছুদিন আগে কুষ্টিয়ায় একটি নির্মাণাধীন ভবন ভেঙে পড়লে হতাহতের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ব্ল্যাক লিস্ট করা হয়। পরে উচ্চ আদালতের রায় নিয়ে তারা ফের নির্মাণকাজ শুরু করে।

জি কে শামীমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে মূলত তাদের কিছুই হয়নি। জি কের অন্যতম অংশীদার হিসেবে জয়েন্টভেঞ্চারে কাজ করে এনডিই বা ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স। এনডিই’র মালিক বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ভাতিজা রেজওয়ান মুস্তাফিজ।

র‌্যাব জানায়, গ্রেফতারের পর পরই জি কে শামীমকে স্থানীয় সাক্ষীদের সামনে জিজ্ঞাসাবাদ করেন র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সরোয়ার আলম। এ সময় তিনি স্বীকার করেন বিদেশে পাচারের জন্য নিজের অফিস কক্ষে বিপুল অঙ্কের অর্থ মজুদ করেন। এছাড়া তিনি টেন্ডারবাজি, গরুর হাটে চাঁদাবাজি ও ক্যাসিনো ব্যবসায় জড়িত থাকার কথাও স্বীকার করেন।

তার ৭ দেহরক্ষী আগ্নেয়াস্ত্রের বৈধ লাইসেন্সধারী হলেও শর্ত ভেঙে ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টিতে অস্ত্রগুলো ব্যবহার করেন বলে নিজেরাই স্বীকার করেন। এদিকে সন্দেহভাজন যুবলীগ নেতাদের বড় অঙ্কের আর্থিক লেনদেনের ওপর নজরদারি চালানো হচ্ছে।

দুর্নীতিবাজদের কেউ যাতে বড় অঙ্কের অর্থ তুলে অন্যত্র সরিয়ে নিতে না পারে, সেজন্য কোটি টাকার ওপর লেনদেনের ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক সিআইডিকে তথ্য জানাতে বলা হয়েছে। এছাড়া প্রভাবশালী যুবলীগ নেতাদের নামে-বেনামে কত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে, তার অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। দুটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে যুক্ত দুই যুবলীগ নেতার ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে একাধিক সংস্থা চিঠি দেয়।

এই দুই যুবলীগ নেতার একজনের নাম আলমগীর হোসেন। তিনি যুবলীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার। ঋণ কেলেঙ্কারির কারখানা হিসেবে পরিচিত বেসিক ব্যাংকের অন্যতম পরিচালক আলমগীর হোসেন।

কিরণ নামের আরেক যুবলীগ নেতার ব্যাংক লেনদেনের অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। কিরণ রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের পরিচালক। এছাড়া যুবলীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক সফিকুল ইসলাম সফিক এখন কড়া গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছেন। ৫-৬ বছরে তার ধনসম্পদ ফুলেফেঁপে ওঠে।

সফিকুল ইসলামের বাড়ি বাগেরহাটে। যুবলীগে তিনি প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত। স্বাস্থ্য সেক্টরের মাফিয়া হিসেবে ধরা হয় তাকে। কারণ স্বাস্থ্য খাতের ৮০ শতাংশ উন্নয়ন কাজ নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। রাজধানীর হাতিরপুল মোতালেব প্লাজায় তার বিশাল অফিস। সকাল ১০টার পর থেকেই তার অফিসের সামনে স্বাস্থ্য খাতের ঠিকাদারদের ভিড় লেগে থাকে।

আরেক যুবলীগ নেতা মিজানুর রহমান ওরফে মিজানের বিরুদ্ধে শ্রম মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ থেকে শুরু করে উন্নয়ন সংক্রান্ত কাজ নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ আছে। একাধিক সংস্থা এসব অভিযোগ তদন্তে মাঠে নামার পর মিজান গা ঢাকা দেন।

মিজানের সঙ্গে ক্যাসিনো সম্রাট ইসমাইল চৌধুরীর ঘনিষ্ঠতা ওপেন সিক্রেট। মিজান সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের এপিএস ছিলেন। যুবলীগ উত্তরের সাধারণ সম্পাদক ইসমাইলের অঢেল সম্পদের খোঁজে মাঠে নেমেছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। ইতিমধ্যে ইসমাইলের নামে একাধিক ফ্ল্যাট, প্লট ও ব্যাংকে কয়েক কোটি টাকার সন্ধান মিলেছে।

এর মধ্যে রাজধানীর জোয়ার সাহারা এলাকার নিকুঞ্জে ৫ কোটি টাকার মূল্যবান প্লট, পূর্বাচল ৩০০ ফিট সংলগ্ন ১৫ কাঠার প্লট, মিরপুর ও পল্লবীতে একাধিক প্লট থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। ইসমাইলের বৈধ আয়ের কোনো উৎস না থাকলেও ছেলেকে তিনি বিপুল অঙ্কের অর্থ খরচ করে অস্ট্রেলিয়ায় পড়াচ্ছেন।

এদিকে যুবলীগ নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের নামে সুইস ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে বলে অভিযোগ পায় বাংলাদেশ ব্যাংক। ইতিমধ্যে চাঞ্চল্যকর এই তথ্য যাচাইয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জেনেভায় সুইস ব্যাংকে চিঠি দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট।

এমজে/