আ’লীগের মনোনয়ন বাগিয়েছেন অর্ধশত বিতর্কিত কাউন্সিলর

আ’লীগের মনোনয়ন বাগিয়েছেন অর্ধশত বিতর্কিত কাউন্সিলর

প্রশ্নের মুখে শুদ্ধি অভিযান * ১২৯ ওয়ার্ডের মধ্যে মাত্র ২টিতে নারী প্রার্থী * সংরক্ষিত ৪৩ নারী কাউন্সিলর পদের ২৫টিতে নতুন মুখ *

চলমান শুদ্ধি অভিযানের ফাঁক গলে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বাগিয়ে নিয়েছেন প্রায় অর্ধশত বিতর্কিত কাউন্সিলর। এসব প্রার্থীর বিরুদ্ধে ক্যাসিনো-কাণ্ড, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, মাদক কারবার, সরকারি ও ব্যক্তির জমি দখল, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি, বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি অনেকের ব্যাংক হিসাব তলব বা জব্দ করা হয়েছে।

এসব ব্যক্তি মনোনয়ন পাওয়ায় ক্ষমতাসীন দলের চলমান শুদ্ধি অভিযান প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এদিকে দুই সিটির ১২৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে মাত্র দুটিতে নারী প্রার্থী দিয়েছে আওয়ামী লীগ। আর সংরক্ষিত ৪৩টি নারী ওয়ার্ডের ২৫টিতে এসেছে নতুন মুখ।

বিতর্কিত প্রার্থীর বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান গণমাধ্যমকে বলেন, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তাদের কয়েকজনকে ইতিমধ্যে বাদ দিয়ে নতুন প্রার্থী দেয়া হয়েছে। আরো বিতর্কিত ব্যক্তি আছে কি না, আমার জানা নেই।

তিনি বলেন, ‘রাজনীতি করতে গেলে ছোটখাটো অভিযোগ থাকেই। বিএনপিও আমাদের নেতাদের বিরুদ্ধেও অনেক অভিযোগ ও মামলা-হামলা করেছে। আমরা তো সেগুলো আমলে নিতে পারি না। তবে কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোগ ওঠলে সেখানে প্রার্থী পরিবর্তন হতে পারে।’

আলোচিত ও বিতর্কিত কাউন্সিলররা ফের মনোনয়ন পাওয়ায় ক্ষুব্ধ স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মনোনয়নবঞ্চিত কয়েক নেতা যুগান্তরকে বলেন, প্রত্যেক ওয়ার্ডে কমপক্ষে দশজন করে ত্যাগী ও যোগ্য প্রার্থী আছেন। তাদের মানোনয়ন না দিয়ে প্রভাবশালী ও অপকর্মকারীদের প্রার্থী করা হয়েছে।

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির ১২৯টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, নতুন মুখ এসেছে ৫১টি ওয়ার্ডে। এর মধ্যে ক্যাসিনো, মাদক, দখল, পরিবহনে চাঁদাবাজি, ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ, বৈঠকে অনুপস্থিত থাকাসহ নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়ায় বাদ পড়েছেন ৪০ জন।

দুই সিটিতে এবার দু’জন নারী প্রার্থীকে কাউন্সিলর (সাধারণ) পদে প্রার্থী করা হয়েছে। তারা হলেন- উত্তর সিটির ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি আলেয়া সারোয়ার (ডেইজি)। দক্ষিণে ৪৫নং ওয়ার্ডে মনোনয়ন পেয়েছেন হেলেন আক্তার। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সংরক্ষিত নারী-১৭ (৪৫, ৪৬, ৪৭) নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তিনি।

আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যাদের মনোনয়ন দেয়া হয়েছে, তাদের সব কার্যক্রম যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে প্রতিবেদন নেয়া হয়েছে তাদের সম্পর্কে। এছাড়া দলের প্রতি আনুগত্য ও ত্যাগের বিষয়টিও বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।

তালিকায় থাকা আওয়ামী লীগের বিতর্কিত কাউন্সিলররা হলেন: ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) ২ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান কাউন্সিলর আনিসুর রহমান। তার বিরুদ্ধে জমি দখল ও মাদক ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, আনিসের বর্তমান বাড়ির (দক্ষিণ গোড়ানের ৪১১/এ নম্বর) জমি দখল করা। এলাকায় নতুন ভবন নির্মাণ করতে গলেও তাকে চাঁদা দিতে হয়। তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে বারবার ফোন করে তাকে পাওয়া যায়নি।

৫ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়েছেন কাউন্সিলর আশ্রাফুজ্জামান ফরিদ। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ- জমি দখল, মাদক ব্যবসা, সরকারি জমিতে বাজার বসিয়ে অর্থ বাণিজ্য, সিএনজি স্টেশন থেকে মাসিক চাঁদা আদায় করেন ফরিদ। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে ফরিদ বলেন, ‘আমাকে হেয়প্রতিপন্ন করতে ও ঈর্ষান্বিত হয়ে একটি গ্র“প এসব করছে।’

নাটকীয়ভাবে ১২নং ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়েছেন বর্তমান কাউন্সিলর গোলাম আশরাফ তালুকদার। প্রথমে এ ওয়ার্ডে সমর্থন দেয়া হয় মামুনুর রশিদ শুভ্রকে। পরে তা প্রত্যাহার করে তালুকদারকে সমর্থন দেয় দলটি। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সভাপতি থাকাকালে নিয়োগ ও ভর্তি বাণিজ্যের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।

এছাড়া ২০ নম্বর ওয়ার্ডে মানোনয়ন পাওয়া ফরিদ উদ্দিন রতন, ২৬নং ওয়ার্ডে হাসিবুর রহমান মানিক, ৫১নং ওয়ার্ডে হাবিবুর রহমান (হাবু), ৫৩নং ওয়ার্ডে নূর হোসেন, ৫৫নং ওয়ার্ডে নূরে আলম, ৫৬নং ওয়ার্ডে মোহাম্মদ হোসেন, ৫৯নং ওয়ার্ডে আকাশ কুমার ভৌমিক, ৬৯ নম্বর ওয়ার্ডে মনোনয়ন পাওয়া হাবিবুর রহমান হাসুর বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অভিযোগ।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৪নং ওয়ার্ডে দলীয় সমর্থন পেয়েছেন কাউন্সিলর মো. জামাল মোস্তফা। তার ছেলে রফিকুল ইসলাম রুবেলকে ইয়াবাসহ গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। পুলিশের মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনার আগে এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে আসা ৪৫ জন শীর্ষ মাদক কারবারির মধ্যে জামাল মোস্তফার ছেলের নাম ১২ নম্বরে। জামাল মোস্তফার বিরুদ্ধেও রয়েছে সরকারি জমি দখলের অভিযোগ।

তবে এসব অভিযোগ ‘ফালতু’ দাবি করেছেন জামাল মোস্তফা। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন এলেই ষড়যন্ত্র শুরু হয়। এগুলো ষড়যন্ত্র। এলাকায় আমার ও আমার ছেলের নামে কোনো অভিযোগ নেই।’

৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবদুর রউফ নান্নু মনোনয়ন পেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে রাস্তা দখল করে মার্কেট নির্মাণ ও মাদক ব্যবসায় মদদ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এ কাউন্সিলর কয়েক বছর আগে মিরপুর ১১ নম্বর এলাকায় সড়কের একটি বড় অংশ দখল করে অর্ধশত দোকান বানিয়েছেন।

এ স্থানটি বর্তমানে ‘নান্নু মার্কেট’ নামে পরিচিত। সরকারের শুদ্ধি অভিযান শুরু হওয়ার পর বেশ কিছুদিন তিনি আত্মগোপনে ছিলেন বলে জানা গেছে। অভিযোগের বিষয়ে নান্নুর বক্তব্য হল, নির্বাচনের আগে তার সুনাম ক্ষুণ্ন করতে একটি পক্ষ ওঠেপড়ে লেগেছে।

তিনি বলেন, ‘নান্নু মার্কেট আমার না, ঢাকায় আমার কোনো বাড়ি নেই। ব্যাংকে টাকাও নেই।’ ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়েছেন নতুন মুখ জাহিদুর রহমান। তার বিরুদ্ধেও দখল, মাদক ব্যবসা, জুয়া, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী বাহিনী সৃষ্টিসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। ক্যান্সার হাসপাতালে রোগী ভর্তি বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে।

এছাড়া ১নং ওয়ার্ডে আফছার উদ্দিন খান, ১৮নং ওয়ার্ডে জাকির হোসেন বাবুল, ২৭নং ওয়ার্ডে ফরিদুর রহমান খান, ২৯নং ওয়ার্ডে নুরুল ইসলাম রতন, ৩০নং ওয়ার্ডে আবুল হাসেমের (হাসু) বিরুদ্ধেও আছে নানা অভিযোগ। উল্লেখ্য, রোববার আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমণ্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দুই সিটিতে কাউন্সিলর পদে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

ওই রাতেই দুই সিটির ৪৩টি সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হয়। সেখানে উত্তরের ১৮টি সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদের মধ্যে ১৩টি ও দক্ষিণের ২৫টির মধ্যে ১২টিতে বর্তমান কাউন্সিলররা মনোনয়ন পাননি। এসব ওয়ার্ডে এসেছে একেবারেই নতুন মুখ।