নির্জন কারাবাসের ২ বছর

নির্জন কারাবাসের ২ বছর

৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ থেকে ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০। মোট ৭৩০ দিন। অর্থ্যাৎ দুই বছর ধরে কারান্তরীণ রয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। কারাগারে যাওয়ার পর ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে বিএসএমএমইউ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এখন তিনি সেখানেই চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

কারান্তরীণ থেকেই দলের নেতা-কর্মীদের কাছে উপাধি পেয়েছেন গণতন্ত্রের মা হিসেবে। গৃহবধূ থেকে আপোষহীন নেত্রী হয়ে ওঠা সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর দিনরাত্রি কাটছে হাসপাতালের ছোট কক্ষে। শারীরিকভাবে খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ায় এবং সুচিকিৎসা না পাওয়ায় বেগম জিয়ার পুরনো রোগগুলো বেড়ে গেছে। চোখেও প্রচন্ড ব্যথা, তাঁর পা ফুলে গেছে। একা একা হাটতে পারছেন না। এই অবস্থা থেকেও তিনি তার দল ও দেশবাসীকে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যেতে বলেছেন।

পরিবার, চিকিৎসক ও দলের নেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, অসুস্থ বেগম খালেদা জিয়া চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। তাঁর আর্থারাইটিসের ব্যথা, ফ্রোজেন শোল্ডার, হাত নড়াচড়া করতে পারেন না। হৃস্ট জয়েন্ট ফুলে গেছে, সার্ভাইক্যাল স্পন্ডিলোসিস এর জন্য কাঁধে প্রচন্ড ব্যথা, এই ব্যথা হাত পর্যন্ত রেডিয়েট করে। হিপ-জয়েন্টেও ব্যথার মাত্রা প্রচন্ড। ফলে শরীর অনেক অসুস্থ, তিনি পা তুলে ঠিক মতো হাঁটতেও পারেন না।

ড্যাবের সভাপতি ডাঃ হারুন আল রশিদ ও মহাসচিব ডাঃ মোঃ আব্দুস সালাম বলেন, তার নিকট আত্মীয়রা তার সাথে স্বাক্ষাত শেষে খালেদা জিয়ার শারিরিক অবস্থার যে বর্ননা দেয় তা অত্যান্ত ভয়াবহ। তার বাম হাত সম্পূর্ণ বেঁকে গেছে, গায়ে জ¦র, ব্যাথায় কাতড়াচ্ছেন এবং প্রায়শই বমি করছেন এবং কিছু খেতে পারছেন না। তারা এও বলেছেন হাসপাতালের যে চিকিৎসা চলছে তাতে বেগম খালেদা জিয়ার কোন কাজ হচ্ছে না এবং এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে তাকে জীবিত অবস্থায় বাসায় নিয়ে যাওয়া যাবে না।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও চিকিৎসক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য গঠিত বিএসএমএমইউ’র মেডিকেল বোর্ড বলছে যে, উনার অ্যাডভান্স থ্যারাপি দরকার। অ্যাডভান্স থ্যারাপি দিতে হলে এই প্রতিষ্ঠানটি কি অ্যাডভান্স প্রতিষ্ঠান, মানলাম উনাদের (বিএসএমএমইউ) মধ্যে অনেক চিকিৎসক আছেন যারা সত্যি সত্যি স্বনামধন্য ও আঞ্চলিকভাবে তারা অত্যন্ত স্বীকৃত।

আজকে যদি প্রশ্ন তুলতে হয়- বিএসএমএমইউতে যদি অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্ট দেয়ার সর্বাধুনিক সুযোগ থাকতোই তাহলে কয়েকদিন আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের অসুস্থ হয়ে ভর্তি হওয়ার পরে তাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ট্রান্সফার করতে হয়েছিলো সিঙ্গাপুরে। সিএমএইচ খুব ভালো, কয়েকদিন আগেও প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব জয়নাল আবেদীন সাহেবকে ট্রান্সফার করতে হয়েছিলো সিঙ্গাপুরে। অর্থাৎ এডভান্স ট্রিটমেন্ট দরকার অ্যাডভান্স সেন্টারে। সেই অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্টের সুযোগ বিএসএমএমইউতে কি আছে? উনার সুচিকিৎসার জন্য উনাকে অ্যাডভান্স সেন্টারে নেয়া প্রয়োজন।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ডাক্তারা বলেছিলেন তার (খালেদা জিয়া) অ্যাডভান্স টিট্রমেন্ট দরকার। সেই ট্রিটমেন্ট তিনি পাচ্ছে না। এখন আরো ডেটোরেট করে গেছে। আমরা বরাবর বলে এসছি যে, তাকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে আটক করে রাখা হয়েছে এবং তাকে কষ্ট দেয়া হচ্ছে। আমরা এখন আশঙ্কা করছি, তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। আমরা জানি না যে, উদ্দেশ্যটা তাই কিনা। আমরা মনে করি, তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে সরকার।

কারান্তরীণ হওয়ার পর থেকেই বেগম জিয়ার মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন, অনশন কর্মসূচি, বিক্ষোভ, স্মারকলিপি প্রদান, গণসাক্ষর অভিযান, বিভাগীয় সমাবেশ, দোয়া মাহফিলসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি। এর মধ্যে চলে আইনি লড়াইও। যদিও দলটির আইনজীবী ও নেতারা বলছেন খালেদা জিয়াকে আইনি লড়াইয়ে মুক্ত করা যাবে না। কারণ তাকে কোন অপরাধের কারণে কারাবন্দি করা হয়নি। বন্দি করা হয়েছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে। তাকে মুক্ত করতে রাজপথে নামতে হবে। তাদের ভাষায়, যেহেতু রাজনৈতিক কারণে তিনি জেলে আছেন, তাই তাকে রাজনৈতিকভাবেই মুক্ত করতে হবে।

খালেদা জিয়া কারাগারে থাকাবস্থায় গত ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে। যে নির্বাচনে বিএনপির ভূমিধ্বস পরাজয় হয়েছে। এই দলের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট মাত্র ৮টি আসনে বিজয়ী হয়েছে। এরপর থেকেই দলের নেতাকর্মীরা হতাশাগ্রস্থ হলেও তারা সবচেয়ে বেশি চিন্তিত দলের প্রধান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেন, তিনি (খালেদা জিয়া) প্রচন্ড অসুস্থ। চোখেও প্রচন্ড ব্যথা, তাঁর পা ফুলে গেছে। কিন্তু তাঁকে যথাযথ চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না। অসুস্থতার কারণে তিনি হাটতেও পারছেন না। কতটা নৃশংস, কতটা নিষ্ঠুর, কতটা প্রতিহিংসাপরায়ণ, কতটা হিংস্র আর বিষাক্ত মানসিকতার হলে ৭৩ বছরের একজন মহিয়সী নারীকে এভাবে জিঘাংসা চরিতার্থ করতে কতটা উন্মত্ত হওয়া যায়, সেই চিত্রটাই দেশবাসী লক্ষ্য করছে। তিনি বলেন, ক্ষমতার অন্ধলিপ্সায় ন্যুনতম মনুষ্যত্বটুকুও সরকার হারিয়ে ফেলেছে। বিএনপি নেতা বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে একজন সম্মানিত বয়স্কা জনপ্রিয় নেত্রীকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় জ্বলে-পুড়ে এমনভাবে সাজানো মিথ্যা মামলায় সাজা দেয়ার দেয়ার কোন দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে নেই। বেগম জিয়ার অপরাধ মাত্র একটাই-সেটা হলো জনগণের মাধ্য তাঁর অপরিসীম ও অভাবনীয় জনপ্রিয়তা।

এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা এবং জামিন না পাওয়ায় উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় রয়েছে বিএনপি নেতাকর্মীরা। নেতাকর্মীরা বলেন, ‘বিএনপি’ শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল হলেও দলটির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া শুধু একজন রাজনীতিক নন; তিনি একটি আদর্শ-দর্শন একটি প্রতিষ্ঠান। তিনি হাসলে আলোকিত হয় হাজারো মুখ; মুখ ফেরালে লাখো মানুষের জীবনে নামে গভীর অন্ধকার। কর্মময় জীবনে তিনি হয়ে উঠেছেন দেশের কোটি কোটি মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার বিমূর্ত প্রতীক। গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে এসে ৯ বছর এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে দেশবাসীর কাছে তিনি ‘আপোষহীন নেত্রী’র খেতাব অর্জন করেছেন। জনগণের ভোটে তিন বারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়ার কোটি কোটি অনুসারী সারাদেশে ছড়িয়ে রয়েছে। মা, মাটি ও মানুষের এই নেত্রী দেশের নারীদের কাছে ‘আইডল’। দেশের জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী তরুণ-তরুণীরা তাঁকে নিয়ে আগামীর স্বপ্ন বোনেন। নতুন প্রজন্ম দেখেন জেগে ওঠার স্বপ্ন। রাজধানী ঢাকার অভিজাত এলাকা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জ এবং সমাজের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে রয়েছে বেগম জিয়ার অনুসারী। শিশু, যুবা, বয়স্ক, বৃদ্ধা সব স্তরের মানুষ খালেদা জিয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল; তাঁকে চেনেন, জানেন, মানেন।

আজ দোয়া কাল সমাবেশ: বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আগামীকাল শনিবার ঢাকায় সমাবেশসহ দুইদিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার কারাগারে থাকার দুই বছর তথা ৭৩০ দিন হচ্ছে। এই দিনে তার মুক্তি দাবিতে সমাবেশ ডেকেছে বিএনপি। গত মঙ্গলবার রাতে দলের এক যৌথসভায় এই সিদ্ধান্ত হয়। সভা শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কর্মসূচি ঘোষণা করে বলেন, খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি ও সুস্বাস্থ্য কামনায় শুক্রবার দেশব্যাপী বাদ জুম্মা মসজিদে মসজিদে দোয়া মাহফিল এবং ৮ ফেব্রুয়ারি (আগামীকাল) বেলা ২টায় ঢাকায় নয়া পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ ও সারাদেশে জেলা সদরে বিক্ষোভ সমাবেশ। এছাড়া খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় কারা বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনগুলো পোস্টার ও লিফলেট প্রকাশ করবে বলে জানান বিএনপি মহাসচিব। সুত্র: ইনকিলাব।