সেমিনারে বক্তাদের অভিযোগ

সুষ্ঠু নির্বাচনের পদক্ষেপ নিচ্ছে না ইসি

সুষ্ঠু নির্বাচনের পদক্ষেপ নিচ্ছে না ইসি

ঢাকা, ২৪ ফেব্রুয়ারি (জাস্ট নিউজ) : অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন সমাজের বিশিষ্টজনরা। তাদের মতে, সরকার অব্যাহতভাবে ক্ষমতায় থাকার জন্য রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করছে।

শনিবার সকালে ঢাকা ফোরামের আয়োজনে জাতীয় প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ও বাংলাদেশে গণতন্ত্র’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন।

অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যে পরিবেশ সৃষ্টি করা প্রয়োজন নির্বাচন কমিশন তা করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে দাবি করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হাফিজ উদ্দিন খান। তিনি বলেন ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের যে পদক্ষেপগুলো নিতে হবে সেগুলো নেওয়া হয়নি। নির্বাচন কমিশনের সেই তৎপরতা আমরা দেখতে পারছি না। নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব তাদের সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হবে। এটা তার সাংবিধানিক দায়িত্ব। এই সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করার জন্য যা যা লাগে করবে। যদি সরকারের কোনো আইন পরিবর্তন করতে হয়, তাহলে তারা সেটি প্রস্তাব করবে, এ ব্যাপারে চাপ দিবে। এটি আমরা তাদের কাছে চাই।’

একদল রাষ্ট্রীয় খরচে নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছে, আর অন্য দল ঘরের মধ্যেও রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে পারছে না- এটা সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায় উল্লেখ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এই মুহূর্ত পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষের কোনো প্রত্যাশা বর্তমান নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে নাই। এক দল এক বছর আগ থেকে নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছে, রাষ্ট্রীয় খরচে। আর আরেক দল ঘর থেকে বের হতে পারছে না। তাহলে নির্বাচন কমিশন যে বলছে, একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা, তার কোনো আলামত তো দেখা যাচ্ছে না।

সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, স্বাধীনতার পক্ষ বা বিপক্ষ শক্তি বলে নাগরিকদের বিভক্ত করা হচ্ছে। রোহিঙ্গা নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ সারা বিশ্ব সোচ্চার হলে আমরা নীরব হয়ে গেছি। ভারতীয় সেনা প্রধান অযাচিত বক্তব্য দিলে খোদ ভারতে এর প্রতিবাদ হলেও আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোনো প্রতিবাদ জানায়নি। আমরা কি ভারতে অংশ হয়ে যাচ্ছি? প্রশ্ন রাখেন তিনি।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি ড. জাফর উল্লাহ বলেন, আমাদের দেশে সুষ্ঠু গণতন্ত্র আনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা ভারত। ২০১৪ সালে আমরা নির্বাচন দেখেছি। বাংলাদেশে যদি সরকার পরিবর্তন হলে ভারত নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ে যাবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ভারতকে অনুনয় বিনয় করে বলেছেন, আসেন না হলে আপনাদের সেভেন সিস্টারে শান্তি থাকবে না। সাথে সাথে ভারতের একটি সংস্থা বিএনপিকে বলেছে, আপনারা সাবধান থাকেন অনুপ্রবেশকারী যেন দলে না ঢুকে। এতে বোঝা যায় ভারত কিভাবে আমাদের জীবন যাত্রা কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ছয়টি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত চারটি নির্বাচনে বিরোধী দল বিজয়ী হয়েছে। সেই শিক্ষা আমরা নাও নিতে পারি।

প্রশ্নফাঁসের ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রশ্নফাঁস রোধে গঠিত কমিটিতে একজন শিক্ষাবিদও নাই। দু’জন মন্ত্রী ও ছয়জন আমলা রয়েছে। প্রশ্নফাঁসের সাথেও ভারতের হাত রয়েছে। আগে এক থেকে দেড়লাখ শিক্ষার্থী ভারতে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে যেত। এখন কতজন যায়। কাজেই তারা বিভিন্ন ভাবে এই ক্ষতিটা পুষিয়ে নিতে চায়।

তিনি বলেন, যমুনা সেতু পারাপারে আমাদের দেশের যানবাহনে কম করেও হলে ৭শ’ টাকা ট্যাক্স দিতে হয়। সেখানে ভারত দিচ্ছে মাত্র ১৯ পয়সা। আর কত চায় তারা।

কুটনৈতিক ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা কুটনৈতিকভাবে টোটালই ব্যর্থ হয়েছি। অতীত থেকে কখনোই শিক্ষা নেয়ার চেষ্টা করি না। আজকে রোহিঙ্গারা আমাদের দেশে ঢুকে পড়েছে। তারা কোনো দিন ফেরত যাবে না। ফেরত গেলে ভাষাণচরে হাজার কোটি খরচ করে আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে কেন।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন বলেন, নির্বাচনে দুর্নীতি হলো সব দুর্নীতির প্রধান। ভোটে দুর্নীতির মাধ্যমে সব ধরনের দুর্নীতির পথ সুগম করা হয়। বর্তমান সরকারের ভোটের শক্তি নাই। বিভিন্ন বাহিনীর উপর ভর করে চলছে। শিক্ষিত লোকদের বোকা বানাচ্ছে সরকার। বিনাভোটে সরকার গঠন করে সেই সরকার দিয়ে আবার তাদের অধীনে নির্বাচনের আইন তৈরি করেছে।

তিনি বলেন, যারা ভোটের অধিকার নষ্ট করে তারা স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি হতে পারে না। গণতন্ত্রের বিরোধিতাকারীরা স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি। স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ছিল গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক মুক্তি। দেশে শিক্ষিত লোকদের ভোটের অধিকার নেই। কিন্তু নির্বাচন কমিশন নিজেদের স্বাধীন দাবি করছে। ভোট ছাড়া সরকার গঠন করা শিক্ষিত লোকদের জন্য লজ্জার বিষয়।

আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সরকার বলছে সংবিধানে হাত দেয়া যাবে না। সংবিধানের কাজ হচ্ছে নাগরিকদের সুরক্ষা করা। যেকোনো প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করে নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। কোনো দল বা গোষ্ঠীর জন্য সংবিধান হতে পারে না।

সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের প্রতি দেশের মানুষের প্রত্যাশা নেই। প্রধানমন্ত্রী সারাদেশে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে খালেদা জিয়া জেলে। আমাদের ঘরের মধ্যে সভা সমাবেশ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা কি? একদল রাষ্ট্রীয় খরচে প্রচারণা চালাচ্ছে অন্য দল ঘর থেকে বের হতে পারছে না। নির্বাচন কমিশন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বললেও কার্যত কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।

রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনা করে আলী ইমাম মজুমদার বলেন, যখন যে দল ক্ষমতায় আসে সেই দলই নিজেদের ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে চায়। ২০০১ সালে তৎকালীন সরকার একজন বিচারকের জন্য অবসরের ব্যয় ৬৭ করা হয়। যার ফল হিসেবে আসে ১/১১। এরপর বিচারপতি খায়রুল হকের দেয়া রায়ের সাজা জনগণ পাচ্ছে। এর শেষ হতে কতদিন লাগবে তা এখনো পরিষ্কার নয়।

আবুল হাসান চৌধুরী বলেন, উন্নয়ন ও গণতন্ত্র সমান্তরাল হলে সেই দেশ উন্নতির চরম শিখরে উঠতে পারে। গণতন্ত্র না থাকলে শুধুমাত্র উন্নয়ন নাগরিকদের কাজে আসে না। যেসব প্রতিষ্ঠান জনগণকে টিকিয়ে রাখে সেসব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। সামাজিক মুল্যবোধ নষ্ট হচ্ছে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে শেষ করে দেয়া হয়েছে। শেষ করা হচ্ছে ব্যাংকগুলোও। দেশের ৫ শতাংশ মানুষের হাতে অর্থনীতি পঞ্জিভূত হচ্ছে।

ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, গণতন্ত্র না থাকলে উন্নয়ন ধরে রাখতে পারব না। আসল উন্নয়ন হলো মানবিক উন্নয়ন। দেশের ৮০ শতাংশ তরুণ আজ মাদকাসক্ত। বেশিরভাগ তরুণ দেশে ভবিষ্যত দেখতে পায় না। তারা বিদেশে চলে যেতে চায়। গণতন্ত্র ও উন্নয়ন একসাথে চলতে হবে। আমাদের দেশের দুর্বলতা হল নাগরিক সমাজের দুর্বলতা। নাগরিক সমাজ শক্ত না হলে গণতন্ত্র শক্তিশালী হয় না।

ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, সভ্য রাষ্ট্রে এ ধরনের সভা সেমিনারের প্রয়োজন নেই। আজকে মানুষের মনে প্রশ্ন, আগামি নির্বাচন কি হবে? হলেও কেমন নির্বাচন হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সবার দায়িত্ব রয়েছে। বড় ভূমিকা রয়েছে নির্বাচনকালীন সরকারের। সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন পৃথিবির কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। সরকার নির্বাচনে সেনাবাহীনিকে চায় না। ব্রিজ কালভার্ট তৈরিতে সেনাবাহীনিকে ব্যবহার করতে পারলে ভোটে কেন নয় প্রশ্ন রাখেন তিনি।

এসময় উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (সিইও) সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, সাবেক রাষ্ট্রদুত এফ এ শামীম আহমেদ, আহমেদ মাহমুদুর রেজা চৌধুরী, ইফতেখারুল করিম, মাসুদ আজিজ, শাহেদ আখতার প্রমুখ।

(জাস্ট নিউজ/একে/১৮২৪ঘ.)