সরকারের বিরুদ্ধে বলার চেয়ে ভারতের বিরুদ্ধে কথা বলা কঠিন: ভিপি নুর

সরকারের বিরুদ্ধে বলার চেয়ে ভারতের বিরুদ্ধে কথা বলা কঠিন: ভিপি নুর

বর্তমানে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা যতোটা সহজ ভারতের বিরুদ্ধে কথা বলা তার থেকেও কঠিন। আর এর সব থেকে বেশি ভূক্তভোগী আমরা বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুর।

জাতীয় প্রেস ক্লাবে শুক্রবার ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ আয়োজিত আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে একথা বলেন ভিপি নুর। এই সভার আলোচনার বিষয় ছিল “ভারতীয় অগ্রাসনের স্বরুপ: আমাদের স্বাধীনতার সংকট”।

ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, মিডিয়ার আলোচিত অনেক ব্যক্তিবর্গই এই বিষয়ের নাম শুনেই আলোচনায় আসার সাহস করবেন না। কারণ তারা সত্যি জানলেও ব্যক্তিগত ক্ষতির আশঙ্কায় এগুলো নিয়ে কথা বলতে ভয় পেয়ে থাকেন।

তিনি বলেন, কিছুদিন আগে ডিসেম্বরে ভারত সরকারের করা বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে ভারতীয়রা প্রতিবাদ শুরু করে। ভারতের হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, জৈন, শিখ সবাই মিলে ওই আইনের প্রতিবাদ জানিয়ে বলে আমরা সবাই ভারতের নাগরিক।

যেখানে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত সাহা সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, এক কোটি অবৈধ মুসলিম অভিবাসী এরা বাংলাদেশি। যা বাংলাদেশের সার্বমত্ত্বের উপর আঘাত ছিল। আমরা যদি প্রতিবাদ না জানাতাম তাহলে, ভারত কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম অভিবাসীদের রোহিঙ্গাদের মতো বাংলাদেশের উপর চাপিয়ে দিত। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এর বিরুদ্ধে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানানো হয়নি।

আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডাকসুর পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানিয়েছেলাম। সেই প্রতিবাদের জন্য প্রকাশ্য দিবালোকে সিসি ক্যামেরার সামনে প্রায় ২৪ জন ছাত্রকে আহত করা হয়। তারপর খুব সুপরিকল্পিতভাবে সেই ক্যামেরার হার্ড ডিস্ক সরিয়ে নেয়া হয়। আমরা সরকারকে নিয়ে কিছু বলিনি আমরা বলেছিলাম ভারতকে নিয়ে।

নুর আরো বলেন, আমাদের দেশে এমন অনেকে আছেন যারা ভারতীয় না হলেও ভারতের পক্ষে চিন্তা করেন। এই করোনাকালীন সময়ে আমরা দেখতে পাই সীমান্ত দিয়ে পরিকল্পিত উপায়ে পাগল ঢুকে পড়ছে আমাদের দেশে। এখন তারা আসলেই পাগল নাকি গোয়েন্দা সেটা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।

অথচ চলতি বছরে মহামরির মধ্যেও জানুযারি থেকে জুন পর্যন্ত ২৫ জন বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। করোনার প্রকোপে যেখানে মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে চিকিৎসা পাচ্ছে না, সীমান্ত বন্ধ হয়ে আছে তার মধ্যে ভারত মানুষ মানুষ হত্যা করেছে। অথচ ভারতের সাথে বাকি যে পাঁচ দেশ যুক্ত রয়েছে সেখানে কিন্তু কোনো গুলির আওয়াজ পাওয়া যায় না।

২০১৭ সালে নেপালের সীমান্তে ভারতীয়রা এক নেপালী তরুণকে গুলি করে হত্যা করে। এই জন্য ভারতের মন্ত্রী সমমর্যাদার নেতা ওয়াজিদ দৌহাল নেপালের সরকারের কাছে হাত জোর করে ক্ষমা চান। কিন্তু সীমান্তে বাঙালী হত্যার জন্য ভারত কি কখনো বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চেয়েছে? সরকার কি কখনো কোনো বিবৃতি জানিয়েছে?

নুর বলেন, ভারত আসলে বাংলাদেশকে মনে করে তাদের ইতিহাসের একটি পাদটিকা মাত্র। অর্থাৎ তাদের দীর্ঘ ইতিহাস লিখতে গেলে বাংলাদেশের নামটা আসবে, তারা রাজেনৈতিক অঙ্গ সংগঠনের মতো আমাদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। কিন্তু মাঝেমধ্যে যখন আমাদের মতো কিছু মানুষ তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করি তখন ভারত এক ধরণের অস্বস্তিতে ভোগে।

তিনি বলেন, তারা বাংলাদেশকে গুরত্ব দেয় না। কারণ জানে বাঙালিদের ক্ষমতা, প্রসাশন ও রাজনীতির নাটাই সব তাদের হাতে। আপনি চাইলেও ভারতের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারবে না। ২০১১ সালের সেনা প্রধান মইনুল আহাম্মেদ তার বইতে ভারতের সহযোগীতার কথা উল্লেখ করেছিলেন। এমন কি ২০০৮ সালের নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে ভারতের প্রভাব নিয়ে লন্ডনের ইকোনমিক্স পত্রিকায় বেশ কয়েকটি প্রতিবেদনও প্রকাশ হয়েছিল। তারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব আঁচ করতে পেরেছিলেন।

ভারতের সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক যদি দেখি সেখানে নব্বইয়ের দশকে সক্রিয় সম্পর্ক ছিল। ভারত আমাদের যুদ্ধ জয়ে সহযোগিতা করছে। তার জন্য আমরা ভারতকে ধন্যবাদ জানাই, ভারতের ভালো চাই।

তার মানে তো এই না তারা আমাদের সীমান্তে মারবে, বর্ষার সময় বন্যায় পানি দিয়ে মারবে। তাই যারা বলে ভারতের সাথে আমাদের রক্তের সম্পর্ক তারা হয় আহাম্মক নয় তো ভারতের দালাল।

সীমান্ত বর্বরতা নিয়ে নুর বলেন, এই সীমান্ত হত্যাকাণ্ড নিয়ে রাজনৈতিক কোনো দলই প্রতিবাদ করে না। এটি কিন্তু কোনো দেশের জন্যই স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এনআরসি নিয়ে বাংলাদেশের কোনো দলই প্রতিবাদ জানায়নি। কারণ হলো, বাংলাদেশে ভারত তোষণের রাজনীতি চলছে দীর্ঘ সময় ধরে।

তিনি আরো যুক্ত করে বলেন, আমরা মানে করি বঙ্গবন্ধু ও জিয়া হত্যার পেছনে আন্তর্জাতিক কোনো চক্র ছিল। সেখানে ভারতের হাত থাকতে পারে। যদি খেয়াল করে দেখি ভারত বাংলাদেশকে ব্যবহার করার স্বার্থে সাহায্য করেছিল। ১৯৭৪ সালে ইসলামিক সহযোগী সংস্থার (ওআইসি) দাওয়াতে বঙ্গবন্ধুকে ইন্দিরা গান্ধী না যাওয়ার জন্য বার্তা পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সার্বিক বিবেচনা করে সেখানে গিয়েছিলেন।

নুর আরো বলেন, ১৯৭৪ সালের পানি বন্টনের চুক্তি নিয়ে ভারতের সাথে বাংলাদেশের কিন্তু মনোমালিন্য দেখা দেয়। তখন তৎকালীন ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’র প্রধান বঙ্গবন্ধুকে তার প্রাণনাশের আশঙ্কা আছে বলে সতর্ক করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু নিজের মানুষের উপর আস্থার ছিল বলে তিনি সতর্ক হননি। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, ভারত হয় সতর্ক করেছিল না হয় তারা হুমকি দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে তাদের প্রতি অনুগত্য বানাতে চেয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তা করেননি। তাই অনেকের ধারণা বঙ্গবন্ধু হত্যায় হয়তো ভারতের হাত ছিল। তাই আমরা একটি আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিটির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ও জিয়াউর রহমান হত্যার বিচার দাবি করি।

ভিপি নুরু জোর দিয়ে বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সার্বভৌমত্বের স্বার্থের জন্য এটা প্রয়োজন। বাংলাদেশের দুই শীর্ষ দল একে অন্যকে দোষারোপ করে চললে হবে না। সবাইকে এটা মানতেই হবে যে জিয়াউর রহমান ও বঙ্গবন্ধু দুজনই প্রকৃত দেশ প্রেমিক ছিলেন।

তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালে যখন ভারতের সাথে সম্পর্কের টানাপোড়ন তখন কিন্তু জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে সার্ক গঠন করা হয়েছিল। আমরা কিন্তু সব সময় সকল দেশের সাথে সুসম্পর্ক চেয়েছি। ওই একই উদ্যেশে বঙ্গবন্ধু পররাষ্ট্রনীতি ঠিক করেছিলেন ‘কারো সাথে বৈরিতা নয় সবার সাথে বন্ধুত্ব’।

তিনি আরো বলেন, কিন্তু এটা আমরা বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে কিছুটা অন্য রকম দেখতে পাই।

প্রধানমন্ত্রী যখন তার বক্তব্যে বলেন, ভারতকে যা দিয়েছি তা সারাজীবন মনে রাখবে। তার এই কথা জনগণ হিসেবে আমাদের ক্ষুব্ধ করে। কিছুদিন আগে পেঁয়াজ কাণ্ড খেয়াল করলে দেখা যায়, আমরা ভারতকে এক জাহাজ ভরে পূজার রিলিফ পাঠালাম কিন্তু ঠিক তার পরদিনই ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিল। কিন্তু আমাদের সরকারের এই বিষয়ে প্রশ্ন করার সামর্থ্য হয়নি যে বিনা বার্তায় কেন চুক্তি ভঙ্গ করে ভারত পেয়াজ বন্ধ করছে।

সরকারের উদ্দেশে ভিপি নুর বলেন, এগুলো কিন্তু সরকার আমলে নিচ্ছে না। স্বাধীনতার পর থেকে এখনো ভারত প্রতিক্ষেত্রে নাক গলিয়ে যাচ্ছে। অনেকেই বলে হুজুররা মসজিদ কেন্দ্রিক রাজনীতি করে কিন্তু ‘ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ’ একটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়ায় আমি তাদের সাধুবাদ জানাই।

তিনি আরো বলেন, আজকে বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হতে চীন কিন্তু বাংলাদেশের সাথে বিনিয়োগ ও ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে চাচ্ছে, ভারতের আমাদের উপর আগ্রহ রয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রও কৌশলগত কারণে আমাদের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে চাচ্ছে। তাহলে আমরা কেন একটা দেশের উপর নির্ভরশীল হব। যে তিস্তা চুক্তি এতো বছরেও হয়নি সেখানে চীন ১০০ কোটি ডলারে সেই তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পে সহায়তা করতে চেয়েছে। সুতরাং ভারত অখুশি হতে পারে কিন্তু আমরা কেন সুযোগ নেব না। শুধু তিস্তা না ৫৪টি নদীর ন্যায্য হিস্যা ভারত আমাদের দিচ্ছে না। অথচ এই ফারাক্কা বাধ কিন্তু শুধু পরীক্ষামূলকভাবে ৪১ দিনের জন্য চালু করা হয়েছিল।

মওলানা ভাসানী কিন্তু বলেছিলেন, আমরা দিল্লীর গোলামী করার জন্য আমরা পিন্ডি (পাকিস্তান) ত্থেকে মুক্তি হয়নি। আমরা রাজনৈতিক ছাড়াও সাংস্কৃতিকভাবেও বঞ্চিত। আমাদের বিটিভি চ্যানেল পর্যন্ত সরকার ভারতে দেখাতে পারেনি। কিন্তু ভারতের সকল চ্যানেল এখানে দেখানো হয়। তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়।

মাদরাসা ছাত্রদের বঞ্চিত হওয়া নিয়ে তিনি বলেন, দাওরা হাদিসকে মাস্টার্সের সম্মান দেয়া হয়েছে। কিন্তু দাওরা হাদিস সম্পূর্ণ একজন ছাত্র কি মাস্টার্সের ছাত্রের সাথে চাকরী প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে? পারবে না। কারণ তার পড়াশোনার পদ্ধতি আলাদা। সুতরাং যে সেই জায়গার জন্য যোগ্য তাকে সেই জায়গায় সুযোগ করে দিতে হবে। একজন রাষ্ট্রপতিও কিন্তু নামাজ পড়ার সময় ইমামের পিছনে যেয়ে দাঁড়ান। কারণ ইমামকে ওখানে প্রয়োজন। সুতরাং আপনাদের নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য আওয়াজ তুলতে হবে। সবার সাথে মিশতে হবে নিজেদের নিয়ে সবার কাছে বৈরী মনোভাব ভাঙতে হবে। মাদ্রাসার ছাত্ররা যে বঞ্চিত সে বিষয়েও তুলে ধরার আহবান জানিয়েছেন তিনি।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ-এর সিনিয়র নায়েবে আমীর মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম। আলোচনা সভায় বিভিন্ন ইসলামিক দলের নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন।