খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার দাবিতে উত্তাল রাজপথ

খালেদা জিয়াকে কি স্লো পয়জনিং করা হয়েছে, প্রশ্ন বিএনপির

খালেদা জিয়াকে কি স্লো পয়জনিং করা হয়েছে, প্রশ্ন বিএনপির ফটো: বাবুল তালুকদার।

বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে ‘স্লো পয়জন’ দেওয়া হয়েছিল কি না, প্রশ্ন করেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

আজ বৃহস্পতিবার খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়ে বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠানোর দাবিতে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে জাতীয়তাবাদী যুবদল বিক্ষোভ সমাবেশ করে। সেখানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মির্জা ফখরুল এ প্রশ্ন তুলেন।

সকাল দশটায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এ সমাবেশ শুরু হয়। এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে এদিন সকাল থেকেই বিভিন্ন ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে সমাবেশস্থলে হাজির হন রাজধানী ঢাকাসহ যুবদলের বিভিন্ন ইউনিটের নেতৃবৃন্দ। বেলা বাড়ার সাথে সাথে প্রেস ক্লাব এলাকা লোকে-লোকারণ্য হয়ে যায়। এদিকে সমাবেশকে ঘিরে সকাল থেকেই মৎস্য ভবন মোড়, হাইকোর্ট মোড়, পুরনো পল্টন মোড়, সচিবালয় মোড়, প্রেস ক্লাব এলাকায় বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়। রাস্তায় বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মানুষজনকে তল্লাশি করতে দেখা যায়।

আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়ে বিদেশে না পাঠালে গণভবন ঘেরাও করে সরকার পতনের আন্দোলন করা হবে বলে সমাবেশ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়।

বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘খালেদা জিয়ার বয়স ৭৫ বছরের বেশি। তাঁকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দিতে এক–এগারোর সময়ে যে চক্রান্ত শুরু হয়েছিল, সেই চক্রান্তের অংশ হিসেবে একটি সম্পূর্ণ মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে পুরান ঢাকার পরিত্যক্ত কারাগারে দুই বছরের বেশি সময় আটক রাখা হয়েছিল। স্যাঁতসেঁতে কারাগারের কক্ষে ইঁদুর, চিকা ঘোরাঘুরি করত। পরে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল, সেখানে চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। এখন অনেকের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে, সেই সময়ে খালেদা জিয়াকে কোনো স্লো পয়জনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল কি না, আমরা পরিষ্কার করে জানতে চাই। তাদের পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়। এই দেশটাকে তারা বিক্রি করে দিয়েছিল। গণতন্ত্রকে তারা পুরোপুরি নির্বাসনে পাঠিয়েছে। যারা মিথ্যা মামলা দিয়েছে, গণতন্ত্রকামী নেতা–কর্মীদের গুলি করে হত্যা করেছে, তাঁদের পঙ্গু করে দিয়েছে। আমাদের ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলমসহ ৫০০ নেতা–কর্মীকে গুম করেছে, তাদের পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়।’

মির্জা ফখরুল আরও বলেন, ডাক্তাররা বলছেন ‘আমাদের সব বিদ্যা, জ্ঞান শেষ, আমরা এখানে আর কিছু করতে পারব না।’ তাদের এমপি–মন্ত্রীরা বলছেন, মানবিক কারণে যেতে দেওয়া উচিত। তিনি (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) এটা শুনতে চান না। কেন শুনতে চান না? এটা তাঁর প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ। খালেদা জিয়াকে রাজনীতি নয়, জীবন থেকে নিশ্চিহ্ন করতে এই চক্রান্ত করছেন।’

ফখরুল বলেন, ‘খালেদা জিয়া জীবন নিয়ে লড়াই করছেন। আমরা কি আর ঘরে বসে থাকব? আমরা ঘরে বসে থাকব না। আমরা সমস্ত শক্তি দিয়ে তার জীবন রক্ষার জন্য অবশ্যই কাজ করব। এই সরকারকে অবিলম্বে খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে বাধ্য করতে হবে। এজন্য সবাইকে রাস্তায় বেরিয়ে আসতে হবে।’

খালেদা জিয়ার চিকিৎসার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘ডাক্তাররা বলেছেন, অবিলম্বে তাকে বিদেশে পাঠানো দরকার। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা শুনতে চান না। তার মন্ত্রী, এমপি, বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপকরাও একই কথা বলছেন, আন্তর্জাতিকভাবেও তার ওপরে চাপ আসছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কোনোটাই শুনছেন না।’

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘বাংলাদেশে স্বাস্থ্য, সড়ক, যোগাযোগ, প্রতিরক্ষা, প্রশাসন সব জায়গাতেই দুর্নীতি। দেশে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে দুর্নীতি নেই।’

সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘এই দেশটাকে আপনারা বিক্রি করে দিয়েছেন। এই দেশের যে গণতন্ত্রের জন্য যুদ্ধ হয়েছিল, লড়াই করে যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, সেই গণতন্ত্রকে পুরোপুরি নির্বাসনে পাঠিয়েছেন। তার প্রমাণ এখন পত্রিকায় দেখছি। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাইডেন গণতান্ত্রিক দেশগুলোর একটা ভার্চ্যুয়াল সম্মেলন করতে যাচ্ছেন। সেখানে বাংলাদেশের নাম নাই। নেপাল, পাকিস্তান, ভারতের নাম আছে কিন্তু বাংলাদেশের নাম নাই। ওই জায়গায় নিয়ে এসেছেন।’

পত্রিকার সংবাদের উদ্ধৃতি দিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘কয়েকদিন আগে খবরের কাগজে খবর বেড়িয়েছে যে বাংলাদেশের সড়ক, খাত, স্বাস্থ্য খাত, যোগাযোগ খাত, প্রতিরক্ষা, প্রশাসন খাত, সবগুলোতে দুর্নীতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বলা হচ্ছে এটা এখন এক ঝুঁকির মুখে আছে। আজকে দেশে এমন কোনো জায়গা নাই, যেখানে দুর্নীতি নাই।’

তিনি বলেন, ‘আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের জন্য লাখ লাখ পুলিশ নিয়োগ করা হচ্ছে। তাদের নিয়োগ করা হয় দলীয় ভিত্তিতে। একজন কনস্টবলকে ২০লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। সেই আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চরমভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এখন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতাকর্মী, কাউন্সিলর, তারা পরস্পরকে গুলি করে হত্যা করছে। কুমিল্লায় পরশুদিন একজন কাউন্সিলরকে ব্রাশ ফায়ার করে মেরে দিয়েছে। এটা অত্যন্ত অশনী সংকেত। কারণ আমরা ৭২ থেকে ৭৫ সালে এই আওয়ামী লীগ আমলে ঈদের জামাতে প্রকাশ্যে ব্রাশ করে লোক মারতে দেখেছি। আমরা দেখেছি রাস্তার ধারে গুলি করে লোকে মেরে ফেলে রাখা হতো। এখন একই কায়দায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু একটা জায়গায় তারা ব্যর্থ হয়নি। বিরোধী দলের যে ভোট দেওয়ার আন্দোলন, গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলন সেটা দমন করতে তারা খুব সিদ্ধহস্ত। এটাকে আমাদের পার করতে হবে, উত্তরণ ঘটাতে হবে, ওদের এই পারদর্শীতাকে পরাজিত করতে হবে।’

বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর দরকার। একথা চিকিৎসকেরা বার বার বলছেন। তারা বলছেন আমাদের এখানে আর চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষমতা নেই। কিন্তু হাসিনা শুনতে চায় না। তার মন্ত্রীরাও বলে দেওয়া উচিত, আওয়ামী লীগের এমপিরাও বলে এটা মানবিক কারণে দেওয়া উচিত। সারাদেশের সব মানুষ, ডাক্তার, উকিল, বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপকেরা বলছেন, কিন্তু তিনি এটা শুনতে চান না। কেন চান না, তার প্রতিহিংসা। তার প্রতিশোধ। এই যে স্প্রীহা। দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে শুধু নয়, এখন জীবন থেকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য এই চক্রান্ত।’

তিনি বলেন, ‘আমরা জানি আন্তর্জাতিকভাবেও তার ওপরে চাপ আসছে চিকিৎসা করতে দেওয়ার জন্য। তিনি কথাই শুনছেন না। আমাদের বেঁচে থাকার লক্ষ্য হচ্ছে বেগম জিয়া। আমাদের রাজনীতির বাতিঘর হচ্ছে বেগম খালেদা জিয়া। এই নেত্রী হচ্ছেন সেই নেত্রী যিনি আমাদের সঙ্গে নিয়ে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া ছুটে বেড়িয়েছেন। সেখানেই তাদের ভয়, ভয়টা ওখানেই যে দেশনেত্রী যদি বাইরে থাকে তাহলে বাংলাদেশের মানুষকে আর ঘরে রাখা যাবে না।’

বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করার জন্য যুবদলকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘সামনের দিনগুলিতে আরও বেশি শক্তি নিয়ে বেড়িয়ে আসতে হবে। ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই সরকারকে বাধ্য করতে হবে। আর এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে দেশনেত্রীকে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন। অন্যথায় এই জনগণ আপনার বিচার করবে। জবাবদিহি করতে হবে। তখন আর কাউকে খুঁজে পাবেন না। পেছনের দরজাটাও খুঁজে পাবেন না।’

বিএনপির ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালাম বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশে না পাঠালে অনেক প্রশ্ন সামনে আসবে। এত দিন তাঁকে চিকিৎসা না দিয়ে স্লো পয়জনিং করা হয়েছিল কি না, সে প্রশ্নও আসবে। কেন বিদেশে পাঠানো যাবে না? বিদেশের হাসপাতালে পাঠালে কি সেগুলো ধরা পড়ে যাবে?’

বিএনপির ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান বলেন, ‘খালেদা জিয়ার মুক্তির একমাত্র বাধা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।’

যুবদলের সভাপতি সাইফুল আলম নিরবের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়ন ও সাংগঠনিক সম্পাদক মামুন হাসানের পরিচালনায় সমাবেশে বিএনপি মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান, দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালাম, স্বেচ্ছাসেবক দলের মোস্তাফিজুর রহমান, আবদুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল, কৃষক দলের শহিদুল ইসলাম বাবুল, যুবদলের মোরতাজুল করীম বাদরু, আলী আকবর চুন্নু, মোনায়েম মুন্নাসহ কেন্দ্রীয় নেতারা বক্তব্য দেন।