এরশাদের ভয় জেঁকে ধরেছে জিএম কাদেরকে

এরশাদের ভয় জেঁকে ধরেছে জিএম কাদেরকে

হুসেইন মুহম্মদ (এইচএম) এরশাদ ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি গঠন করেন জাতীয় পার্টি। এরপর দলটি ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে গিয়েছে। শত প্রতিকূলতার মাঝেও শক্ত হাতে দলকে তিনি নেতৃত্ব দিয়ে গিয়েছেন। তার মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টির হাল ধরেন ছোট ভাই গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদের। পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়েই তিনি বেশকিছু পদক্ষেপ নেন। বহিষ্কার করেন বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতাকে। এর মধ্যে এক সময় মহাসচিবের দায়িত্ব সামলানো মশিউর রহমান রাঙ্গা রয়েছেন, আছেন চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা জিয়াউল হক মৃধাও। তখন জিয়াউল হক উল্টো চেয়ারম্যানকেই অবৈধ ঘোষণার ডিক্রি চেয়ে আদালতে মামলা করেন। এরপর থেকে বড় ভাইয়ের মতোই মামলার ভয় জেঁকে বসেছে জিএম কাদেরের ওপরও।

রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে ১৯৯০ সালে এইচএম এরশাদের পতনের পর পরই তার বিরুদ্ধে ২৭টি মামলা করা হয়। পরবর্তী সময়ে সে তালিকা দীর্ঘই হয়েছে। মামলা দিয়েছিলেন সাবেক স্ত্রী বিদিশাও। সব মিলিয়ে সাবেক এ রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে মামলা দাঁড়িয়েছিল ৪৩টিতে। জাতীয় পার্টির নেতারা অবশ্য মনে করেন, এরশাদকে চাপে রাখার হাতিয়ার হিসেবেই মামলাগুলো করা হয়েছিল। একইভাবে জিএম কাদেরকেও চাপে রাখতে মামলাকে হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয়া হচ্ছে।

এরশাদের মৃত্যুর পর থেকেই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হওয়া নিয়ে ভাবি রওশন এরশাদের সঙ্গে জিএম কাদেরের দ্বন্দ্ব। পরবর্তী সময়ে রওশনকে পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা এবং জিএম কাদের পান দলের ভার। প্রায় এক বছর ধরে অসুস্থ রওশন, ব্যাংককের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সেই কারণ দেখিয়ে তাকে সরিয়ে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতার আসনে জিএম কাদেরকে স্থলাভিষিক্ত করার পক্ষে মত দেয় জাপার সংসদীয় দল। এর মধ্যেই গত ৩০ আগস্ট রওশন এরশাদের নামে গণমাধ্যমে একটি বিজ্ঞপ্তি আসে। জাপার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির নানা বিষয় বর্ণনার পর তিনি ২৬ নভেম্বর দলের জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করেন। নিজেকে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক করে আট সদস্যের একটি কমিটিরও ঘোষণা দেন। আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে যখন রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত, তখন হঠাৎ করেই জিএম কাদেরের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে অসুস্থ রওশন এরশাদের এমন উদ্যোগ দলের অনেককেই চমকে দিয়েছে। কেননা সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে রওশন এরশাদ বেশ আস্থাশীল বলে আলোচনা রয়েছে।

এদিকে রওশন এরশাদ ইস্যুতে মসিউর রহমান রাঙ্গার পর পার্টি থেকে চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য জিয়াউল হক মৃধাকে অব্যাহতি দেন চেয়ারম্যান জিএম কাদের। কারণ জিয়াউল হককে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক করেছিলেন রওশন এরশাদ। এরপর উল্টো জিএম কাদেরকেই জাপার চেয়ারম্যান হিসেবে অবৈধ ঘোষণার ডিক্রি চেয়ে ৪ অক্টোবর প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালতে মামলা করেন জিয়াউল হক। দল থেকে তার বহিষ্কারাদেশকে বেআইনি ঘোষণা এবং দলীয় গঠনতন্ত্রের ২০-এর উপধারা ১(১) অবৈধ ঘোষণার আবেদন জানানো হয়। মামলায় জিএম কাদের ছাড়াও নির্বাচন কমিশনের সচিব, জাপার মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদক ও যুগ্ম দপ্তর সম্পাদককে বিবাদী করা হয়।

মামলার শুনানি নিয়ে গত ৩০ অক্টোবর জিএম কাদেরের দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত। ওই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার চেয়ে ৮ নভেম্বর আবেদন করেন জিএম কাদের। তার পক্ষে আদালতে লিখিতভাবে বলা হয়েছে, মামলার বিবাদী জিএম কাদের জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান। হয়রানি ও সম্মানহানির উদ্দেশ্যে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করা হয়েছে। গতকাল আদেশের দিন ধার্য করেছিলেন আদালত। পূর্বনির্ধারিত দিনে সে আবেদন খারিজ করে দেন ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ মাসুদুল হক। এরই মধ্য দিয়ে জিএম কাদেরের ওপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার সময় আরো বাড়ল। ফলে জাপার সিদ্ধান্ত গ্রহণে তিনি যুক্ত থাকতে পারবেন না।

মামলাটি নিয়ে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা আদালতে পিটিশন করেছিলাম। আজ (বুধবার) আদালত সেটিকে খারিজ করে দিয়েছেন। তার অর্থ হলো ইনজাংশন বা নিষেধাজ্ঞা এখনো আছে। এখন আমরা সার্টিফায়েড কপি বের করেই আপিলে যাব। এ নিষেধাজ্ঞার ফলে জিএম কাদের দলের কোনো সাংগঠনিক নির্দেশনা দিতে পারবেন না। তবে তিনি বক্তৃতা-বিবৃতি দিতে পারবেন। এতে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। যার ফলে সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে এ বাধা কোনো প্রভাব ফেলবে না। এরই মধ্যে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের জন্য আমরা নমিনেশন দিয়েছি। জাপার মহাসচিব হওয়ায় আমি সেটিতে স্বাক্ষরও করেছি। মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, শুধু একটি নয়, এমন একই ধরনের আরো একটি মামলা আছে জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে। জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য থেকে বহিষ্কৃত নেতা মসিউর রহমান সেই মামলাটি করেন।

জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ সব পদপদবি থেকে গত সেপ্টেম্বরে হঠাৎ করেই অব্যাহতি পাওয়া মসিউর রহমান রাঙ্গা ২৩ অক্টোবর সেই মামলাটি করেন বলে জানা গিয়েছে। ওই মামলার শুনানি নিয়ে আদালত ‘কেন দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে জিএম কাদেরের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হবে না’, সে বিষয়ে তাকে কারণ দর্শাতে বলেছেন। ১৫ দিনের মধ্যে নোটিসের জবাব দিতে বলা হয়েছে। ওই মামলায়ও আপত্তি দাখিল করার জন্য সময় চেয়ে আবেদন করেছেন জিএম কাদের। আগামী ২ জানুয়ারি এ মামলার পরবর্তী শুনানির দিন রাখা হয়েছে।

জিয়াউল হক ও মসিউর রহমান দুজনই মামলায় দাবি করেছেন, জাপার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর ছয় মাস আগে তার ছোট ভাই জিএম কাদের ভুল বুঝিয়ে ‘জাতীয় পার্টির জন্য ভবিষ্যৎ নির্দেশনা’ শিরোনামে একটি চিঠিতে স্বাক্ষর করান। এরপর জিএম কাদের প্রথমে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, পরে চেয়ারম্যান হন, যা ছিল গঠনতন্ত্রের পরিপন্থী। এ নিয়ে দলের ভেতরে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে এরশাদ ২০১৯ সালের ২২ মার্চ জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরিয়ে দেন। পরে ৪ মে পুনরায় তাকে জাপার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়। তখন এরশাদ গুরুতর অসুস্থ থাকায় তিনি স্বাভাবিক বিবেচনা প্রয়োগে সক্ষম ছিলেন না বলে মামলায় দাবি করা হয়েছে। এরশাদের মৃত্যুর পর ২০১৯ সালের ১৮ জুলাই সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা দেন জিএম কাদের। অথচ দলের গঠনতন্ত্রে এভাবে চেয়ারম্যান ঘোষণার কোনো বিধান নেই।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অবশ্য বলছেন, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে মামলাগুলো দেয়া হতো মূলত তার সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের দরকষাকষির জন্য। যখনই এরশাদ সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেন তখনই শোনা যেত আগের মামলা পুনরায় শুরু হওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। কখনো দুর্নীতির মামলা, কখনোবা হত্যা মামলা। এভাবেই কেটেছে জাপার প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধানের রাজনৈতিক জীবন। জাতীয় পার্টির প্রধানের বিরুদ্ধে মামলার সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি এখন আবার দেখা যাচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত মামলার মধ্যে একটা তফাৎ আছে। এরশাদের বিরুদ্ধে মামলাগুলো ছিল ওই সময়কার সরকারের দায়ের করা। এখন করছেন নিজ দলের বহিষ্কৃত নেতারা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বণিক বার্তাকে বলেন, এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। যেহেতু উনি (জিএম কাদের) বিরোধিতা করতে শুরু করেছেন, তাই সরকার চাইছে তিনি যেন কথা বলতে না পারেন।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বণিক বার্তাকে বলেন, মামলার রায় এখনো দেননি, তবে আমাদের বিপক্ষেও কিছু বলেননি আদালত। এ মামলা আমার ও দলের জন্য প্রেসার। পার্টি যদিও খুব শক্তিশালীভাবেই এটাকে হ্যান্ডেল করছে। আমরাও এটার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, যদি সুবিধাবাদী কোনো লোক পার্টিতে থাকে তারা দূর হবে এবার। তিনি বলেন, এতদিন জাতীয় পার্টি কোনো না কোনোভাবে সরকারের সঙ্গে ছিল। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল—সময়টাতেও দলের ক্রিটিক্যাল অবস্থা ছিল। এরপর থেকে কোনো না কোনোভাবে সরকারের সঙ্গেই ছিলাম আমরা। ফলে এখনকার মতো ক্রিটিক্যাল সময় খুব কমই ছিল।

মামলা নিয়ে জাপা চেয়ারম্যান বলেন, যে কাউন্সিলের মাধ্যমে আমি নির্বাচিত হয়েছি এবং এদেরকে (বহিষ্কৃত নেতারা) মনোনীত করেছি। পরবর্তী সময়ে আমিই তাদের সরিয়ে দিয়েছি। কাজেই তারা যে পদগুলো থেকে বহিষ্কার হয়েছেন সেই পজিশনও তো আমার দেয়া। এগুলো তো কোনো মামলা হওয়ার বিষয় না। কিন্তু হঠাৎ করে যখন দেখা গিয়েছে উনি (রওশন এরশাদ) কাউন্সিল ডেকে দল ভাগ করার চেষ্টা করছেন, তখনই সংসদীয় দল থেকে আমাকে বিরোধী দলের প্রধান করার কথা বলা হচ্ছে। আসলে তারা (রওশনপন্থী নেতারা) ভেবেছেন যদি দল আরেকটা ভাগ হয় তাহলে তো আমরা বিপদে পড়ব।

ভাই এরশাদের প্রসঙ্গ টেনে জিএম কাদের বলেন, সব সরকারই উনার বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। আমার বিরুদ্ধে যে পরবর্তী সময়ে আরেক সরকার করবে না, তাও তো নয়। এ মামলাগুলো কোথায় গিয়ে তারা শেষ করবে, শেষ করবে কি করবে না, সেটাও বলতে পারছি না। তবে এর চেয়ে বড় কিছুও হতে পারে।-বণিক বার্তা