আওয়ামী লীগ শুধু ভোট চুরি নয়, সবকিছু খেয়ে ফেলছে: বিএনপি মহাসচিব

আওয়ামী লীগ শুধু ভোট চুরি নয়, সবকিছু খেয়ে ফেলছে: বিএনপি মহাসচিব

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আওয়ামী লীগ শুধু ভোট চুরি নয়, সবকিছু চুরি করে খেয়ে ফেলছে। এখন বাংলাদেশের মানচিত্রও খেয়ে ফেলতে শুরু করেছে। তিনি বলেন, ‘এই সরকারের দুর্নীতির ফিরিস্তি যদি আমরা দিতে চাই, তাহলে এক দিনে এক মিটিংয়ে হবে না, এক মাস লাগবে।’

আজ শনিবার বিকেলে রাজধানীর নয়াপল্টনে ‘সরকারের সর্বগ্রাসী দুনীতির প্রতিবাদে এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের ১০ দফা দাবিতে’ এক প্রতিবাদ সমাবেশে মির্জা ফখরুল ইসলাম এসব কথা বলেন।

মির্জা ফখরুল বলেন, আওয়ামী লীগের মূলনীতি হচ্ছে টাকা পাচার আর দুর্নীতি। এই দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে এই সরকারকে সরাতে হবে। নাইলে দেশ টিকবে না।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘ভারতে একটা সরকার নির্বাচনে হেরে গিয়েছিল মাত্র একটি স্লোগানে। সেটি হচ্ছে, অলিগলিমে শোর হ্যায়, অমুক নেতা চোর হায়। আমি তাঁর নাম বললাম না। আজকে একসঙ্গে আওয়াজ তুলতে হবে আওয়ামী লীগের মূলনীতি, টাকা পাচার আর দুনীতি। গলি গলি মে শোর হ্যায়, আওয়ামী লীগ চোর হ্যায়।’

সরকারের বিরুদ্ধে সর্বগ্রাসী দুর্নীতির অভিযোগ করে মির্জা ফখরুল বলেন, আজকে আওয়ামী লীগের দুর্নীতি গোটা বাংলাদেশকে একটা ফোকলা অর্থনীতিতে পরিণত করেছে। আজকে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, চাল, ডাল, তেল, লবণের মূল্যবৃদ্ধি, ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি—সবকিছুর মূলে হচ্ছে আওয়ামী লীগের দুর্নীতি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পশ্চিমা বিশ্বের বিখ্যাত পত্রিকা ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ বলেছিল, বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে উন্নয়নের একটা মডেল। সেই পত্রিকা এখন বলছে, উন্নয়নের যে বেলুন উড়ছিল, তা দুর্নীতির কারণে চুপসে পড়েছে।

‘প্রতি ক্ষেত্রে দুর্নীতি, যেখানে যাবেন সেখানেই দুর্নীতি’—এমন মন্তব্য করে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছে, ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ’২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ১২ মাসে ঘুষ দেওয়ার টাকার পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। এই সময়কালে প্রতিটি পরিবারকে গড়ে ঘুষ দিতে হয়েছে ৬ হাজার ৬৪০ টাকা। দেশের চার ভাগের তিন ভাগ মানুষ মনে করে, ঘুষ না দিলে কোনো সেবা পাওয়া যায় না। তারা সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির শিকার হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে। এরপর পাসপোর্ট, বিআরটিএ, বিচারিক সেবা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার ও ভূমিসেবা খাত রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও দুর্নীতি থেকে বাদ যায়নি।

‘এই দেশে আর কিছু অবশিষ্ট নেই’

মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘এই দেশ আর নেই, এই দেশে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। এই রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে ফেলেছে এই আওয়ামী লীগ। গত দুই দিন আগে আমরা দেখেছি, এই হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্টে তারা যে ঘটনা ঘটিয়েছে, সরকারি দল পুলিশ ঢুকিয়ে আইনজীবীদের অন্যায়ভাবে অত্যাচার করেছে, নির্বাচন ভন্ডুল করে দিয়েছে।’

এ প্রসঙ্গে দুজন প্রখ্যাত আইনজীবীর বক্তব্য তুলে ধরে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘যাঁরা তাঁদের আইনজীবী ছিলেন, আইনমন্ত্রী ছিলেন—ব্যারিস্টার শফিক সাহেব (শফিক আহমেদ), তিনি বলেছেন এটা এত বেশি একটা বাজে-জঘন্য কাজ হয়েছে, সেটা আমরা চিন্তা করিনি। আর আইনজীবী পান্না (জেড আই খান পান্না) সাহেব বলেছেন, আমরা যে অর্জন করেছিলাম, সে অর্জনগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে।’

আক্ষেপ করে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার সবচেয়ে কষ্ট হয়েছে, আইনজীবীরা যখন প্রধান বিচারপতির কাছে গেলেন যে এর একটা সুরাহা করেন। তিনি বললেন, আমার কী করার আছে আমি জানি না। যদি কিছু করার থাকে আমি দেখব। তিনি সংবিধানের অভিভাবক, রাষ্ট্রের অভিভাবক। তাঁর কাছে যখন আইনজীবীরা ছুটে যান যে সুরাহা করেন, ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তখনো তিনি সেভাবে নিতে পারেননি। কেমনভাবে নেবেন, তিনি দেখেছেন আগের প্রধান বিচারপতিকে গলা ধাক্কা দিয়ে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।’

বিএনপির মহাসচিব বলেন, বক্তব্য একটাই, এই সরকার যারা জোর করে বসে আছে, যারা রাষ্ট্রযন্ত্রগুলোকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করছে, তাদের জনগণের শক্তি দিয়ে সরে যেতে বাধ্য করতে হবে। তিনি বলেন, ‘এই রাষ্ট্রকে যদি অবিলম্বে সংস্কার করা না যায়, এই রাষ্ট্রের সংবিধান যদি সংশোধন না করা যায়; এই রাষ্ট্র যারা ধ্বংস করছে, তাদের সরিয়ে সত্যিকার অর্থে দেশপ্রেমিকদের এই দেশ পরিচালনার দায়িত্বে আনা না যায়; তাহলে বাংলাদেশে নামক যে রাষ্ট্রটা অমরা ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করে অর্জন করেছিলাম, সে রাষ্ট্র আর থাকবে না।’

দুর্নীতির প্রধান ক্ষেত্র বিদ্যুৎ

বিএনপির মহাসচিব বলেন, এই সরকার বিদ্যুৎ খাতকে দুর্নীতির প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে। এক যুগে কেবল রেন্টাল ও আইপিপি খাতে সরকার শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ পরিশোধ করেছে ৯০ হাজার কোটি টাকার বেশি। যার মধ্যে সরকারের অতি ঘনিষ্ঠ ১২টি কোম্পানিই নিয়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে প্রিয় কোম্পানি সামিট গ্রুপ। তারা ১১ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে। তিনি বলেন, জ্বালানি তেল আমদানি ও তরল গ্যাস আমদানিতেও ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে।

মির্জা ফখরুল বলেন, একটি হচ্ছে এলএনজি, আরেকটা এলপিজি—দু-তিনটি প্রতিষ্ঠান এই গ্যাস আমদানি করে। তারা সরকারের বড় বড় জায়গায় বসে আছে। কেউ উপদেষ্টা, কেউ আত্মীয়, কেউ তাদের বন্ধু। তিনি এ সরকারের সময় বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচারের অভিযোগ করেন।

মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ২০১৫ সালে বলেছিল, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ২৬ লাখ ডলার পাচার হয়। ২০২২ সালে পুলিশের সিআইডি বলেছে, হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে গড়ে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। বণিক বার্তায় (একটি পত্রিকা) এসেছে, দুবাইয়ে বাংলাদেশিদের গোপনে কেনা প্রোপার্টির অর্থমূল্য কম করে হলেও এক বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। এই দেশটাতে আর কিছু থাকে?

মেগা প্রকল্পে মেগা দুর্নীতি

মেগা প্রকল্পে মেগা দুর্নীতির অভিযোগ করে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে একটা বালিশ কিনেছে ৫ হাজার ৯৫৭ টাকা দিয়ে। পদ্মা সেতুতে ১০ হাজার কোটি থেকে ২০ হাজার কোটি টাকায় গেছে। এভাবে আওয়ামী লীগ প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে আমাদের পকেট কেটে টাকা নিয়ে বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে। আর তার খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।’

মির্জা ফখরুল পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগে ২১ হাজার ৩৫ কোটি টাকার বেশি বিদেশি ঋণ গ্রহণ, পায়রা থার্মাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে ২০ হাজার কোটি টাকা, রামপালে ৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, মহেশখালী মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৫২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে দুর্নীতি হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, এখন নতুন একটা শুরু করেছে ৫২ হাজার কোটি টাকার পাতাল রেল। উদ্দেশ্য লুট।

ব্যাংক খাতকে ধ্বংস করার অভিযোগ করে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৮০০ কোটি টাকা লোপাট হয়ে গেছে। বেসিক ব্যাংকের পতন দেখেছেন। জনতা ব্যাংক, ডেসটিনি, হল–মার্ক, ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারি দেখেছেন। ফারমার্স ব্যাংকের এই ভদ্রলোক (মহীউদ্দীন খান আলমগীর) আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। দুর্নীতির দায়ে তাঁর সাজা হয়েছে। কিন্তু বহাল তবিয়তে এখন পর্যন্ত এমপি আছেন—এটাই হচ্ছে আমাদের দেশ।’

এই অবস্থায় দেশের তরুণ-যুবকদের দায়িত্ব পড়েছে, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করা, ভোটচোর, বাংলাদেশের অর্থনীতি চোরদের সরিয়ে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা।

বাংলাদেশে সড়ক নির্মাণ ব্যয় ‘পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি’

বিএনপির মহাসচিব বলেন, বাংলাদেশের সড়ক নির্মাণ ব্যয় পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু সড়কের বেহাল দশা। দেখার কেউ নেই।

এ প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদেরের নাম উল্লেখ না করে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘আমাদের সেতুমন্ত্রী সাহেব আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। অত্যন্ত সুবেশী মানুষ, খুব চমৎকার পোশাকপরিচ্ছদ পরেন। ভালো এবং নাটকীয় ভঙ্গিতে কথাবার্তা বলেন। আমি খুব পছন্দ করি। কিন্তু একবারের জন্যও কি তিনি তাঁর রাস্তাগুলো দেখেছেন? কালকে (গতকাল শুক্রবার) আমি সাভারে গিয়েছিলাম। ফিরছিলাম রিং রোড দিয়ে দিয়াবাড়ির ওদিক দিয়ে। রাস্তাগুলো সব ভেঙে পড়ছে, সেদিকে কোনো খেয়াল নাই।’

ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমানের সভাপতিত্বে সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ আজম খান, মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম, জয়নাল আবদিন ফারুক, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন, কেন্দ্রীয় নেতা শহীদ উদ্দীন চৌধুরী, ফজলুল হক, নাজিমউদ্দিন আলম, মহিলা দলের সভাপতি আফোরাজা আব্বাস, যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাহউদ্দিন, ছাত্রদলের সভাপতি কাজী রওনাকুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ প্রমুখ।