জীবন বাঁচানো-মেশিনটি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরাসরি হাসপাতালে

জীবন বাঁচানো-মেশিনটি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরাসরি হাসপাতালে

এখন কি আর বাছ-বিচার করার সময় আছে! একটি মৃত্যুও যদি ঠেকানো যায়, তো তাই-ই করতে হবে! জীবন বাঁচানোটাই বড় কথা! কানাডাও, সারা পৃথিবীর মতোই করোনা-আক্রান্ত সকল রোগীকে আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) পরিচর্যা দিতে হিমশিম খাচ্ছে!

কিন্তু কানাডা তা দিতে চায়, তার সর্বশক্তি ব্যয় করে হলেও প্রতিটি প্রাণ বাঁচাতে প্রাণপন চেষ্টা করতে চায়! রোগী যে-বয়সীই হোন না কেন, যতরকম রোগ-বালাই-ই সঙ্গে থাকুক না কেন, তাকে পৃথিবীর আলো-বাতাসে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য শেষ চেষ্টাটুকু করতে চায়! প্রতিটি প্রাণ গুরুত্বপূর্ণ!

সবাই জানে, প্রতিটি বড় বড় হাসপাতালেই সংখ্যায় খুব কম আইসিইউ বিছানা থাকে। সেগুলোর চারপাশে নানা আকারের, বড় বড় মেশিনপত্র আর ভেন্টিলেটর যুক্ত থাকে! সংকটময় মুহূর্তে জীবন বাঁচানোর জন্য নানা জরুরি জিনিসপত্র থাকে। এ মেশিনগুলো একটা আরেকটার সাথে এমনভাবে যুক্ত থাকে, সহজে স্থানান্তরও করা যায় না! ফলে করোনা-আক্রান্ত রোগীর শ্বাসকষ্ট শুরু হবার পর তাকে দ্রুত আইসিইউতে স্থানান্তর করা না-গেলে রোগীটি মারা যাবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
দ্রুত বেড়ে যাওয়া রোগীর চিকিৎসা দেবার জন্য সম্প্রতি যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার উপযোগী একটি ছোট্ট যন্ত্রকে সংশোধন ও উন্নত করে ভ্রাম্যমাণ আইসিইউ হিসেবে কাজে লাগানো শুরু করেছে কানাডা। এতে রোগীকে টেনে হাসপাতালের আইসিইউ পর্যন্ত টেনে আনতে হবে না। যে-কোনো জায়গাতেই ভেন্টিলেশনসহ আইসিইউ সুবিধা দেয়া যাবে!

কানাডার ডাক্তারদের একটি দল মেশিনটির উদ্ভাবক এবং বর্তমানে উৎপাদনের নেতৃত্ব দিচ্ছে। ইতিমধ্যেই কিছু বানানো হয়ে গেছে ও ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রায় ৩০ হাজার ডিভাইস দরকার কানাডার।

মুহূর্তেই যে-কোনো পরিবেশকে আইসিইউ করে তুলতে-পারা এ ডিভাইসটির ওজন ৪০ পাউন্ডেরও কম এবং রোগীর বিছানার সাথেই লটকে রাখা সম্ভব। সবচেয়ে বড় কথা, কোনো অক্সিজেন ট্যাংক থেকে নলের মাধ্যমে এটিকে অক্সিজেন নিতে হয় না, সরাসরি বাতাস থেকে অক্সিজেন নিয়ে রোগীর ফুসফুসে সরবরাহ করতে পারে! কাজেই রোগী যেখানেই থাকুক, বারান্দায়, মাঠে, তাঁবুতে, লনে, ক্যাফেতে বা বাড়িতে, সেখানেই লাইফ-সাপোর্ট ও অক্সিজেন দেয়া সম্ভব!

আজকের এই সংকটময় মুহূর্তে যেখানে আইসিইউ-এর সংখ্যা করোনা-রোগীর তুলনায় অপ্রতুল, তখন এই ডিভাইসটি জীবন রক্ষা করার দায়িত্ব নিতে যাচ্ছে হাজার হাজার রোগীর।

টরন্টোর গুটিকয় উদ্ভাবক ডাক্তাররা যে মেশিনটিকে শুধুমাত্র যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য বানিয়েছিলো, তা আজকের করোনা-আক্রান্ত রোগীদের জরুরি দরকারে পৃথিবীতে সরাসরি ব্যবহারের উপযোগী করে তোলা হয়েছে! আহত সৈন্যের জায়গা নিয়েছে আজ সংকটাপন্ন নাগরিক!

টরন্টোর থর্ণহিল মেডিকেল এবং গুয়েলফ-এর লিনামার কোম্পানী যৌথভাবে সম্প্রতি এই মেশিন উৎপাদনে নেমেছে। কানাডার নানা প্রভিন্সে সাপ্লাই দেয়া শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যেই পৃথিবীর নানা দেশ থেকে এটি কিনে নেবারও অর্ডারও আসছে। কিন্তু থর্ণহিল মেডিকেল এর সিইও লেসলি গোল্ডি বলেন, আগে আমরা কানাডার চাহিদা পূরণ করে তারপর বাইরে সরবরাহের চিন্তা করবো।

এই ডিভাইসটি উদ্ভাবিত হয়েছিলো নব্বই দশকেরে শেষের দিকে। ছোট্ট একটি গল্পও আছে এর পেছনে। টরন্টো জেনারেল হাসপাতালের গবেষক এবং ডা. ফিশারের একটি গবেষণা দল তখন মাত্র দক্ষভাবে অক্সিজেন সরবরাহ করার একটি তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছে! সেই তত্ত্বের খবর পায় আমেরিকার সেনা সংস্থা।

সেসময় আমেরিকার সমুদ্র-সেনারা তাঁদের অক্সিজেন ট্যাংক সাথে নিয়ে ঘোরাঘুরির ব্যাপারে একটা বিরাট ঝামেলায় ছিলো! দেখা গেলো, ট্যাংকের সাইজ একটি বিরাট সমস্যা ও তাদের নিজেদের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ, সহজেই আগুন লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল! তারা ডা. ফিশারের দলটিকে আহ্বান জানালো, তত্ত্বটির বাস্তব রূপ দেবার জন্য যাতে যুদ্ধক্ষেত্রে অতি সহজে ও নিরাপদে অক্সিজেন সরবরাহ করা যায়। সে অনুযায়ী তারা টাকাও ঢাললো। তাতে কাজ হলো!

হালকা ও আরামসে অক্সিজেন সরবরাহ করার মেশিনটি টরন্টোর গবেষণাগার থেকে আমেরিকার যুদ্ধক্ষেত্রে চলে এলো! কিছুদিন পর মেরিনসেনারা আবদার জানায়, তোমরা কি এটার সাথে কিছু মনিটর জুড়ে দিতে পারো পালস-প্রেশার ইত্যাদি মাপার জন্য? তারা পারলো! কয়েকদিন পর তারা আবার বলে, তোমরা কি আর এটা এটা জুড়ে দিতে পারো? আবার কয়েকদিন পরে, “তোমরা কি এই মেশিনটাকে আরেকটা হাল্কা আর ছোট্ট করে দিতে পারো?” এমন করে করে পরবর্তী ৬ বছরে মেশিনটি দক্ষতার চূড়ান্ত রূপ নিয়ে নেয়।

ডা. ফিশার বলেন, “আসলে যুদ্ধক্ষেত্রে আহত সৈন্যদের জীবন-বাঁচানোর কাজে মেশিনটি ব্যবহৃত হতো। প্রকৃতপক্ষে একটি আইসিইউতে যা যা লাগে, এই ছোট্ট মেশিনটি তা তা দিতে সক্ষম।”

লেখক: কানাডার কমিউনিটি নার্স। (ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

এমজে/