হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে মানবাধিকার ও মুক্তগণমাধ্যম বিষয়ক সেমিনার

বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে শক্ত অবস্থানে যুক্তরাষ্ট্র : মাইলাম

বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে শক্ত অবস্থানে যুক্তরাষ্ট্র : মাইলাম

বোস্টন থেকে বিশেষ সংবাদদাতা, ১১ নভেম্বর (জাস্ট নিউজ): “গত ১০ বছর ধরে বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা চালিয়ে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা। এ ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার গঠনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পুনঃপ্রবর্তন করতে হবে। আসন্ন নির্বাচন একটি কঠিন পরীক্ষা। বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র এবারের নির্বাচনকে একতরফা হতে দিবে না। নির্বাচনের বিষয়ে অত্যন্ত শক্ত অবস্থানে থাকবে যুক্তরাষ্ট্র”।

শনিবার হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এমন অভিমত তোলে ধরেন উড্রো উইলসন সেন্টারের সিনিয়র স্কলার এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম।

ফোর্জহেইমার হাউসে অনুষ্ঠিত ‘ইম্প্লিকেশন্স অব টার্গেটিং মিডিয়া এন্ড জার্নালিস্টস অন হিউম্যান রাইটস এন্ড ডেমোক্রেসি’ শীর্ষক সেমিনারের আয়োজক বাংলাদেশ প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স অব নর্থ আমেরিকা (বিডিপিএএনএ) এবং হার্ভার্ড ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন কাউন্সিল (আইআরসি)।

বিডিপিএএনএ প্রেসিডেন্ট মোজাম্মেল আল হোসাইনি এবং আইআরসি প্রেসিডেন্ট এলিসা এনিস যৌথ সঞ্চালনায় অন্যান্যের মধ্য প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন হার্ভার্ড ক্যানেডি স্কুলের অধ্যাপক এবং যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট ড. শ্যারমেন টাইচম্যান, কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট’র এশিয়া বিষয়ক গবেষক আলিয়া ইফতেখার, জাতিসংঘের বার্মা টাস্কফোর্সের প্রধান এডেম ক্যারল, জাতিসংঘ ও হোয়াইট হাউস সংবাদদাতা মুশফিকুল ফজল আনসারী, বিডিপিএএনএ এর সাধারণ সম্পাদক তানভীর নেওয়াজ, ব্রান্ডিজ ইউনিভার্সিটির প্রফেসর সাদেক কামাল (কবি সুফিয়া কামালের বড় ছেলে) এবং আজাদ খান।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে সেমিনারে মাইলাম বলেন, "আমি খোঁজ-খবর নিয়ে বলছি, এবারের নির্বাচনে অত্যন্ত শক্ত অবস্থানে থাকবে যুক্তরাষ্ট্র। একতরফা নির্বাচনকে সহ্য করা হবে না।" জনগণের অংশগ্রহণ মূলক নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকার বলে উল্লেখ করেন তিনি।

যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত এই শীর্ষ কূটনীতিক বলেন, বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বে কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা প্রসারিত হতে চলেছে। এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে একটি ভয়ের সংস্কৃতি চালু হয়েছে। অনেককে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি যারা সরকারের দমন নীতির কারণে নিরব ভূমিকা পালন করছেন অথবা আপোস করে চলছেন। দেশের অগ্রযাত্রার পথে এটি একটি অশনি সংকেত বলে মন্তব্য করেন রাষ্ট্রদূত উঠলাম বি মাইলাম।

রাষ্ট্রদূত মাইলাম মনে করেন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী নির্বাচনে অংশ না নিয়ে ভুল করেছে বিএনপি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের বাঁধার মুখে বিজয়ী হতে না পারলেও অন্তত ১০০ আসন নিয়ে বিরোধী দলে দায়িত্ব নিতে পারতো। ফলে একতরফা ভাবে সংসদে পাস হওয়া নিবর্তনমূলক আইনগুলোর ক্ষেত্রে বাঁধা প্রয়োগ করা সম্ভব হতো।

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফটোসাংবাদিক ড. শহীদুল আলমকে আটকে রাখার তীব্র নিন্দা জানিয়ে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক শ্যারমেন বলেন, তিন মাস ধরে ড. শহীদুল আলমের মতো খ্যাতিমান ফটোসাংবাদিককে আটক করে রাখা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা একটি সভ্য গণতান্ত্রিক সমাজে চিন্তাও করা যায় না।

সম্প্রতি সৌদি কনস্যুলেটে বর্বর হত্যাকান্ডের শিকার সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে তার ব্যক্তিগত বন্ধু বলে উল্লেখ করে শ্যরমেন বলেন, শাসকশ্রেণী কতোটা ভয়নাক হলে এমন নারকীয় ঘটনা ঘটাতে পারে। তিনি বাংলাদেশ সরকারের অগণতান্ত্রিক নীতির সমালোচনা করে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠার আহবান জানান। এবং অনতিবিলম্বে ফটো সাংবাদিক ড. শহীদুল আলমের মুক্তি দাবি করেন।

রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর মিয়ানমারের জান্তা সরকারের ভয়াভহ হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতনের চিত্র তোলে ধরে জাতিসংঘের বার্মা বিষয়ক টাস্কফোর্স প্রধান এডেম ক্যারল বলেন, মুসলিম জাতিগত নিধনে মিয়ানমার সরকার যে বর্বরতার সাক্ষর রেখেছে তা সাম্প্রতিক সময়ে বিরল। তিনি বলেন, ইসলামী ফোবিয়াকে সামনে এনে তারা পশ্চিমা শক্তিকে এই অপকর্মে কাছে টানতে চেয়েছিলো। কিন্তু কেবলমাত্র চীনের সহযোগিতা ছাড়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন পেতে ব্যর্থ হয়েছে। নৃশংস এসকল হত্যাযজ্ঞ বিশ্ববিবেককে নাড়া দিলেও নোবেল বিজয়ী অং সান সুচিকে স্পর্শ করতে পারেনি।

দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আশ্রয়দানে জনগণ ও সরকারের উদারতার প্রশংসা করে ক্যারল বলেন, প্রত্যাবর্তনের নামে তাদেরকে আবার কারাগারে প্রেরণ করা ঠিক হবে না। বাংলাদেশ সরকার শরণার্থী আশ্রয় দিয়ে উদারতার পরিচয় দিলেও এ ক্ষেত্রে তারা বিপরীতমুখী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এখন রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরত পাঠানো মানে কারাগারে নিক্ষেপ করা বলে উল্লেখ করেন জাতিসংঘের এই উর্ধতন কর্মকর্তা।

সিপেজে’র আলেয়া ইফতেখার বলেন, মুক্ত মত প্রকাশের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত নিম্নমুখী।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছাড়াও সরকার সমর্থক কর্মীবাহিনীদের হাতে সাংবাদিকরা নির্যাতিত হচ্ছেন উল্লেখ করে সিপিজে'র এই কর্মকর্তা বলেন, একের পর এক সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটিয়ে স্বাধীন মতপ্রকাশের সকল পথকে রুদ্ধ করে দিতে চায় দেশটির সরকার। তিনি বলেন , ড. শহীদুল আলমের জামিন পাবার সব ধরনের ক্ষেত্র থাকার পরেও সরকারের ইশারায় তাকে জামিন দেওয়া হচ্ছে না। কারা হেফাজতে তিনি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সাংবাদিক নির্যাতনের সকল ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করে আসছে সিপিজে বলে জানান তিনি।

 

সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারী বলেন, বিশ্বের সকল স্বৈরশাসকরাই অবৈধ ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করার জন্য মিডিয়াকেই প্রথম টার্গেট করে। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা অনেকটা এরকম- আপনি অবাধে কথা বলতে পারবেন কিন্তু সব কথা হতে হবে শাসক দলের পক্ষে।

ভিন্নমতের কোনো জায়গা অবশিষ্ট নেই উল্লেখ করে আনসারী বলেন, যারাই স্বাধীনমত প্রকাশের চেষ্টা করছেন তারাই নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অনেকে আবার আপোষ রফা করে সরকারের সকল অনৈতিক কাজে সমর্থন যোগাচ্ছেন। স্বাধীন সাংবাদিকতার কারণে সাগর-রুনির মতো সাংবাদিক দম্পতিকে নৃশংস হত্যাকন্ডের শিকার হতে হয়েছে। আজ পর্যন্ত তাদের হত্যার রহস্য উদঘাটিত হয়নি। দিনের পর দিন কারাবরণ করতে হয়েছে সাংবাদিক শফিক রেহমান, মাহমুদুর রহমান, শওকত মাহমুদ, প্রবীর শিকদার, একুশেটিভির সিইও আব্দুস সালাম, সংস্কৃতিকর্মী নওশাবাসহ মুক্তমতের অসংখ্য মানুষ। সর্বশেষ আটক হয়েছেন নিউ নেশন পত্রিকার প্রকাশক ব্যরিস্টার মইনুল হোসেন।

আন্তর্জাতিক প্রেস ফ্রিডম কমিটির সদস্য মুশফিকুল বলেন, অমানবিক নির্যাতনের মুখোমুখি হয়ে তিন মাস যাবত কারাগারে আটক রয়েছেন দেশে-বিদেশে স্বনামধন্য ফটো সাংবাদিক ড. শহীদুল আলম। তাকে মেরে রক্তমাখা জামা ধুইয়ে সেটা আবার পরানো হয়েছে বলে আদালতে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেছেন শহীদুল।

জাতিসংঘের এই স্থায়ী সংবাদদাতা বলেন, কেবল সাংবাদিকই নয় সকল বিরোধীমতকে দমন করতে অব্যাহত স্টীম রোলার চালিয়ে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন শাসকশ্রেণী। তার সর্বশেষ সংস্করণ ডিজিটাল অ্যাক্ট নামের একটি কালো আইন। এ আইনের মাধ্যমে সাংবাদিকদের তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পুলিশকে। প্রধানমন্ত্রী বা তার পরিবারের বিরুদ্ধে কথা বললেই এই আইনের আওতায় জেল-জরিমানা। শেখ হাসিনা আবারো একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকার স্বপ্নে বিভোর। তার এই অনৈতিক অভিপ্রায় বাস্তবায়ন হতে দেয়া যাবে না বলে মত দেন তিনি।

বিডিপিএএনএ সাধারণ সম্পাদক ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সদস্য ইঞ্জিনিয়ার তানভীর নেওয়াজ বলেন, পৃথিবীর দেশে দেশে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে চলেছে। সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যাকান্ড সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বর্বরতম উল্লেখ করে তিনি বলেন, একজন ক্যারিয়ার সাংবাদিককে তার নিজ দেশের কনস্যুলেটের ভিতরে নির্মমভাবে জীবন দিতে হয়েছে। মিয়ানমারে রয়টার্সের দুই সাংবাদিক অনুসন্ধানী রিপোর্টের কারণে কারাবরণ করতে হচ্ছে। তাদেরকে মধ্যহ্ন ভোজের জন্য ডেকে নিয়ে গ্রেফতার করেছে দেশটির পুলিশ। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বলকারি সাংবাদিক ড. শহীদুল আলমকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে কারাগারে আটকে রেখেছে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকার। এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ক্ষমতার ধারাবাহিকতার পথ মসৃণ করতেই স্বৈরাচারি শাসকরা একের পর এক মিডিয়াকর্মীদের উপর আক্রমণ চালাচ্ছে।

তানভীর বলেন, বিশ্বসম্প্রদায়কে এই বিষয়ে সোচ্চার হতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রেকে নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকতে হবে।

(জাস্ট নিউজ/জিএস/১৩১৫ঘ)